আমেরিকার কাছে কি সার্বভৌমত্ব হারালো ভারত

কার্টুনটি করেছেন কার্লুস ল্যাটুফ - মিন্টপ্রেসনিউজ ডটকম

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১২ নভেম্বর ২০২০, ২১:০৯

কোভিড-১৯ মহামারীর তান্ডব পৃথিবী যখন কাঁপছে, দেশে দেশে প্রতিদিন মানুষ মরছে হাজারে বিজারে, বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেও এই মহামারী নির্মূলের শতভাগ কার্যকর প্রতিষেধক এখনও উদ্ভাবন করতে পারেননি, তখনও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বা সামরিক সহযোগিতা বন্ধ নেই। তারই জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হলো গত ২৭ অক্টোবর ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত গোয়েন্দা তথ্য শেয়ারিং চুক্তি।

নয়া দিল্লিতে দু' দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের মধ্যে টু প্লাস টু নিরাপত্তা সংলাপ চলাকালে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিকে বলা হচ্ছে বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট বা বিইসিএ। এ চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-স্থানিক মানচিত্র ও স্যাটেলাইট ইমেজগুলো ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারত। এতে করে বিভিন্ন অস্ত্র ও ড্রোনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

এটাকে দেখা হচ্ছে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর ''ক্ষমতার বহুমুখীকরণ'' হিসেবে। সবকিছুই এমন ঢাক ঢাক গুড় গুড় স্টাইলে করা হচ্ছে যে, কেউ বুঝতেই পারবে না আসলে পর্দার পেছনে কী ঘটছে। সমরবিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ভাবছেন, এর ফলে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ও অভিযানের অতি স্পর্শকাতর নার্ভ সেন্টারেও ঢুকে যেতে পারবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই পুরো ব্যাপারটিকে ভারতের রাশিয়ান বন্ধুরা কিভাবে নেবে? এ সিস্টেমের মধ্যে মার্কিনীরা যদি গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে থাকে, তাহলে তা ঠেকানোর জন্য ভারতকে কি আরো উন্নত সামরিক প্রযুক্তি দেবে রাশিয়া? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো, দু'দেশের আন্তঃকর্মসম্পাদন আরো ব্যাপক করা, যাতে উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা আরো জোরদার হয়।

ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার এই প্রক্রিয়া সাম্প্রতিক চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে শুরু হয়েছে, এমন নয়। এ প্রক্রিয়া আরো বহু আগে থেকেই চলে আসছে। সীমান্ত সংঘাতের পর এ প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে।

ভারতীয় বিশ্লেষকরা বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট বা বিইসিএ-কে দেখছেন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা হিসেবে। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার একে মনে করেন বিখ্যাত ''ফাইভ আই অ্যালায়েন্সের'' সমান্তরাল একটি জোট হিসেবে। ফাইভ আই হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজীল্যান্ড, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি গোয়েন্দা জোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এর জন্ম। ওই সময় তারা একে অপরকে বিরামহীনভাবে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করতো।

ভারতের সাথে সম্পাদিত সর্বশেষ চুক্তিকেও ফাইভ আইয়ের মতো দেখতে বা করতে চান মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এসপার। তিনি বলেন, এ জোট ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকার চ্যালেঞ্জসমূহও মোকাবিলা করবে। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দেয়াই ছিল ফাইভ আই জোটের প্রধান লক্ষ্য। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হলে জোটের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় চীনের উত্থানের দিকে।
২০১৮ সালের শুরু থেকে তারা সমমনা অন্যান্য দেশকেও গোয়েন্দা তথ্য দিতে থাকে। লক্ষ্য একটাই, চীনবিরোধী জোটের আওতা বাড়ানো। এর ফলে সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে চীন, এমনকি রাশিয়ার বিরুদ্ধেও, ফাইভ আই জোটের আওতা বেড়ে যেতে থাকে, যদিও তা ইনফর্মাল বা অনানুষ্ঠানিক।

চলতি বছরের গোড়ার দিকে ব্রিটেনের পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে খবর ছাপা হতে থাকে যে, ফাইভ আই জোটে জাপানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, চীনের সাথে পাল্লা দিতে একটি সুসংহত আর্থ-রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলা। এটা এখন আর নিছক কথার কথায় নেই, মোড় নিয়েছে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার দিকে।

অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকে এ নিয়ে আলোচনায় বসেন ফাইভ আই জোটের প্রতিনিধিরা। তাতে আমন্ত্রণ জানানো হয় জাপান ও ভারতকেও। ফাইভ আই জোটের কাছে ভারতের গুরুত্ব ছিল অন্যরকম। কারণ, ভারতের যেমন রয়েছে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের বিপুল নেটওয়ার্ক, তেমনই কেবল তাদেরই রয়েছে চীনের সাথে তিব্বত ও সিনচিয়াংয়ে সীমান্ত। এর ফলে ভারত দীর্ঘকাল ধরে তিব্বতের ঘটনা প্রবাহের ওপর নজরদারি করতে পারছে। চীন-ভারত সা¤প্রতিক সীমান্ত বিরোধের সময় ভারতের সেনাদলে দেখা গেছে তিব্বতী যোদ্ধাদের, যারা সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছে ভারতে। এসবের কিছুই ফাইভ আই জোটের দৃষ্টি এড়ায়নি।

এখন বাকি রইলো নেপাল। এ দেশটিকে যদি ভজিয়ে ভাজিয়ে নিজেদের পক্ষে আনা যায়, তাহলে চীন-ভারত সীমান্তের চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা সহজেই হয়ে উঠতে পারে ফাইভ আই জোটের হান্টিং গ্রাউন্ড।

ভারতকে চীনবিরোধী পশ্চিমা জোটে আনতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই উদগ্রীব। এর সবচাইতে বড় প্রমাণ হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি যখন আর মাত্র এক সপ্তাহ, তখনও নয়া দিল্লিতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র টু প্লাস টু বৈঠকটি অনুষ্টিত হয়।

মার্কিন পক্ষ ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে যে একমেরু বিশিষ্ট বিশ্বের উদ্ভব ঘটেছিল, হালে চীনের ক্রমোত্থানে তা আর থাকছে না। বিশ্ব আবার দ্বিমেরুকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে।

বাস্তবতা হলো, দ্বিমেরু নয়, চীনের উত্থানের মাঝ দিয়ে বরং বহুমেরু কেন্দ্রিক একটি বিশ্বের অভ্যূদয় ঘটতে যাচ্ছে। এখন অনেক দেশই চীন-মার্কিন বিরোধে কোনো পক্ষ নিতে অস্বীকার করছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এর মধ্যে এমন দেশও আছে, যারা একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু ছিল।

এরকম দেশের মধ্যে রয়েছে, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি ও মেক্সিকোর কথা। এসব দেশ এখন পৃথকভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কথা ভাবে, স্বয়ম্ভর হওয়ার চিন্তা করে। বিশ্ব অঙ্গনের এমন অবস্থায় সামরিক প্রভাবাধীন অঞ্চল কিংবা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বøক কতটুকু কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

চীনের অর্থনীতি সত্যিকার অর্থেই বিকশিত হচ্ছে এবং তারা তাদের প্রতিবেশীদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে চলেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই দক্ষিণ এশীয় মিত্র দেশও চীনের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, জাপানের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলেও এর পরেই আছে চীন। চীনের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে দ্বিগুণ।

এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার মার্কিন মিত্ররা কেন তাদের দেশে চীনের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নষ্ট করতে চাইবে? চীনকে ঠেকাতে গিয়ে তারা কি তারা নিজেদের দেউলিয়া করতে চাইবে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট বেঁধে ভারত কিছুটা হলেও এই ঝুঁকিপূর্ণ জুয়ায় জড়িয়ে গেছে। ভারতের নীতি প্রণেতারা একটা বিষয় উপেক্ষা করেই যাচ্ছেন যে, বাজার দখল, কাঁচামাল এবং নিজ দেশীয় ফার্মগুলোর জন্য কাজের ব্যবস্থা ইত্যাদি ইস্যুতে ভারতকে একসময় আমেরিকার মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। তাই ভারতের সামনে এখন যে সুযোগটি রয়েছে সেটি হলো কোনো দেশের সাথে জোট না বেঁধে বরং জোটনিরপেক্ষ থাকা।

অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০৫০ সাল নাগাদ চীনের পরেই ভারত হতে পারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর তার পেছনে থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, রাশিয়া, মেক্সিকো ও জাপান। তখন চীন ও জাপানের অর্থনীতির মধ্যেকার ব্যবধান হবে আজকের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবধানের চাইতেও বেশি।

বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে এমন দিনও আসতে পারে, যখন বিশ্বের সবচাইতে জনবহুল দেশ হিসেবে ভারতই হতে পারে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। এক বা দুই প্রজন্ম পর কেমন হতে পারে ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি?

আজ যেমন আমেরিকাকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে, সেদিনও কি ভারতের জাতীয়তাবাদীরা চাইবে না দিয়েগো গারসিয়া থেকে সিচেলিস দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভারত মহাসাগরে আপন আধিপত্য বজায় রাখতে? তখন আজকের বিরোধ ভুলে গিয়ে চীন ও আমেরিকা জোট বেঁধে ভারত মহাসাগরে ''অবাধ নৌ চলাচলের'' অধিকার চাইতে পারে।

আধুনিক ইতিহাস কিন্তু সে-কথাই বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও জাপানকে হারাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে জোট বেঁধেছিল আমেরিকা। আর গোটা স্নায়ুযুদ্ধকালে সোভিয়েতকে ঠেকাতে জার্মানি ও জাপানের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছিল ইউরোপীয়রা। আবার স্নায়ুযুদ্ধের শেষ দিকে এসে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে চীনের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল আমেরিকা। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ যেই শেষ হলো, অমনি চীন ও রাশিয়া উভয় দেশের বিরুদ্ধে চলে যায়।

মার্কিন পক্ষ ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে যে একমেরু বিশিষ্ট বিশ্বের উদ্ভব ঘটেছিল, হালে চীনের ক্রমোত্থানে তা আর থাকছে না
মার্কিন পক্ষ ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে যে একমেরু বিশিষ্ট বিশ্বের উদ্ভব ঘটেছিল, হালে চীনের ক্রমোত্থানে তা আর থাকছে না

 

এসব ভারতের নীতি নির্ধারকদের অজানা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের কোনো স্ট্র্যাটেজিক কালচার নেই। তাদের কৌশলগত পরিকল্পনাগুলো এখনও স্নায়ুযুদ্ধ আমলের মডেলে তৈরী। চীনের উত্থান ঘটছে আর বিশ্জুড়ে মার্কিন দাদাগিরির প্রভাব ক্রমেই কমে আসছে। আর এটা দেখেই অনেক দেশ এখন চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকছে।

এই বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হলে ভারতকে এর চড়া মূল্য দিতে হবে। সামনের দিনগুলো হবে খুবই ভয়ঙ্কর। চীনের দ্বারা ভারত আক্রান্ত হলে আমেরিকা এসে ভারতকে উদ্ধার করবে - এমন ভাবনা বোকার স্বর্গে বসেই ভাবা যায়। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ তাই ভারতকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কী করবে, কিভাবে করবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে