নেতানিয়াহুর চারদিকে পতনের শব্দ

- সংগৃহীত

  • অনলাইন ডেস্ক
  • ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:৩৩

ভালো নেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ঘরে কিংবা বাইরে- পাশ থেকে সবকিছু সরে যাচ্ছে। যে-দিকে হাত বাড়াচ্ছেন, সে-দিকেই শূন্যতা। কোথাও কেউ নেই অবস্থা!

ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের একটি অভিযান তাকে এমন খাদে ফেলেছে, সেখান থেকে উঠে আসার কোনো উপায় দেখছেন না তিনি। ৭ অক্টোবর এক অবিশ^াস্য অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েলে ঢুকে টার্গেট কিলিং চালিয়ে সফলতার সঙ্গে ফিরেও এসেছেন হামাসের যোদ্ধারা। ইসরায়েলের তরফে মাঝেমধ্যে দাবি করা হয়, তারা অভিযানে যাওয়া সব যোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। এই তথ্যের ভিত্তি নেই বললেই চলে।

অভিযানে যাওয়ার আগে, অভিযান চলাকালীন কিংবা অভিযানের পর ফিরে আসা- সব স্তরে তারা নেতানিয়াহুর গোয়েন্দাবাহিনীকে পরাস্ত করেছেন। তাদের দম্ভকে ধুলোয় মিশিয়েছেন। এরপর থেকে দেশে-বিদেশে চরম এক ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়কের নাম নেতানিয়াহু। বলা হচ্ছে, তার ব্যর্থতার কারণেই প্রায় দেড় হাজার ইসরায়েলিকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তারা এখন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না।

নেতানিয়াহু মাঝখানে চেষ্টা করেছিলেন, গোয়েন্দা-প্রধানদের ওপর দায়টা তুলে দিয়ে পার পেয়ে যাবেন। তিনি বলেছিলেন, হামাস অভিযান চালাতে পারে- এমন ধারণা গোয়েন্দারা তাকে দেননি। এতে জনগণ আরও ক্ষেপেছে। দুঃসময়ে দোষারোপের রাজনীতিতে ভর করে প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসুলভ নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে চাচ্ছেন, এ-ধরনের বক্তব্য এসেছে নিজদলের রাজনীতিকদের কাছ থেকেও। এই মন্তব্যের পর প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ তৈরি হয়। এই ক্ষোভ এখন তুষের আগুনের মতো জ¦লছে।

ব্যর্থতা যখন আসে, চারদিক থেকেই আসে। ইসরায়েলে এখন প্রতিদিন আন্দোলন হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নামছেন। তাকে কেউ বলছেন যুদ্ধবাজ, কেউ বলছেন অথর্ব। আন্দোলন হচ্ছে তার বাসভবন এবং পার্লামেন্ট ভবন নেসেটকে ঘিরেও। যুদ্ধ সামলাবেন নাকি, নিজের দেশের আন্দোলন সামলাবেন, হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন বিরোধীদল। বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাাপিদ বলেছেন, হামাসের হাতে থাকা বন্দিদের মুক্তি ত্বরান্বিত করে- এমন যে কোনো চুক্তির প্রতি তার সমর্থন রয়েছে। ইসরায়েলি বন্দিদের পরিবারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি বলেন, অপহৃতদের ফিরিয়ে আনার জন্য যে-কোনো ধরনের পদক্ষেপ বা চুক্তিতে সম্মত তিনি। দৃশ্যত, দেশটির অধিকাংশ মানুষ বন্দিদের ক্ষুব্ধ স্বজনদের সঙ্গে রয়েছেন। হামাসের সঙ্গে চুক্তির বিনিময়ে হলেও তারা স্বজনদের মুক্তি চাচ্ছেন। বন্দিদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে রাতদিন বোমাবর্ষণ এবং স্থল অভিযানকে সমর্থন দিচ্ছেন না তারা।

কথা ছিল, ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। সেই দিকেই সব এগোচ্ছিল। বাহরাইন, আরব আমিরাত, সুদান ও মরক্কোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। এই সুযোগে নেতানিয়াহুর সমর্থনেও ঢেউ লেগেছিল। কিন্তু হামাস এসে সবই জলে ঢেলে দিয়েছে। সম্প্রতি সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া চার দেশও এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছে। পরস্পরের মধ্যে এতদিন বিরোধ থাকলেও গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই এখন সরব।

নেতানিয়াহুকে নিয়ে আলোচনা এলে এখন বৈশি^কভাবে কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে রয়েছে- বর্বর, পাশবিক, নৃশংস, নির্বিচার, উন্মত্ত- ইত্যাদি। এই শব্দগুলোকে নেতানিয়াহু নিজের এবং ইসরায়েলের চরিত্রের সঙ্গে একাকার করে ফেলেছেন। হামাস ইসরায়েলে অভিযান চালানোর পর ইসরায়েলের প্রতি কিছু দেশের সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু, সেটি পাল্টে নিজেকে বিশ^-দরবারে বর্বর, পশু, নৃশংস, বিচারবুদ্ধিহীন ও উন্মাদ হিসেবে পরিচিত করেছেন নেতানিয়াহু। যেভাবে তিনি ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদের হত্যা করে চলেছেন, তাতে বৈশি^কভাবে ইসরায়েলের নির্মমতা স্পষ্ট হচ্ছে। একইসঙ্গে ধীরে ধীরে হামাসের অভিযানের যৌক্তিকতাও তৈরি হচ্ছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বলেছেন, হামাসের হামলা শূন্য থেকে হয়নি। ফিলিস্তিনের মানুষ ৫৬ বছর ধরে শ^াসরুদ্ধকর দখলদারির শিকার হয়েছেন। তারা তাদের ভূখণ্ড অবৈধ বসতিতে পরিণত এবং সহিংসতায় জর্জরিত হতে দেখেছেন। তাদের অর্থনীতি থমকে গেছে। এখানকার বাসিন্দারা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

কূটনীতিতে স্পষ্টভাবে ব্যর্থ হয়েছেন নেতানিয়াহু। ৭ অক্টোবরের পর বেশ কিছু পশ্চিমা দেশ একসুরে ইসরায়েলের পক্ষে কথা বললেও অনেক দেশ এখন সরে গেছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার হামলার পর নেতানিয়াহুর প্রতি তাদের অনেকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেও নেতানিয়াহু তার স্বভাবসুলভ একগুঁয়েমির মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জাতিসংঘসহ অনেক পশ্চিমা মানবিক সংস্থা বারবার এই নির্বিচার হামলা থামাতে বলেছে; নেতানিয়াহু শোনেননি। পশ্চিমাদের অনেকেই এখন ইসরায়েল থেকে নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছেন। ইসরায়েল নিয়ে ইউরোপ এখন স্পষ্টভাবে বিভক্ত।

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বিষয়টি বুঝতে পেরে বলেছেন, পশ্চিমা সরকারগুলো গাজা-যুদ্ধের ব্যাপারে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার আগেই হামাসকে ধ্বংস করে দিতে হবে। তিনি বলেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ সময় আছে। মার্কিন গণমাধ্যম পলিটিকো-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এহুদ বারাক বলেন, ‘ইউরোপে আমরা জনমত হারাচ্ছি এবং আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা ইউরোপের সরকারগুলোর সমর্থন হারাব। এর এক সপ্তাহ পর যুক্তরাষ্ট্রের জনমত ভীষণভাবে বিভক্ত হয়ে পড়বে।’

ইসরায়েলি পাশবিকতার প্রতিক্রিয়ায় এ-পর্যন্ত তুরস্ক, বাহরাইন, জর্ডান, দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া, চিলি, হন্ডুরাস, চাদ ও কলম্বিয়া- মোট নয়টি দেশ তেলআবিব থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ইসরায়েলি বর্বরতা চলতে থাকলে আরও অনেক দেশ এই পথে হাঁটবে।

নিজের ধর্মাবলম্বীদের কাছেও ঘৃণিত হয়েছেন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলের ভেতরে তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিরা নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবাজ আখ্যা দিয়ে ফিলিস্তিনে হামলা এখনই বন্ধ করার দাবি জানিয়ে তুমুল আন্দোলন করছেন। তারা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন। ইহুদিরা বলছেন, ‘আমাদের নাম ভাঙিয়ে যুদ্ধ করছেন নেতানিয়াহু; আমরা যুদ্ধ চাই না।’ তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে ফিলিস্তিনি নারী-শিশু হত্যায় সহায়তার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও স্লোগান দিচ্ছেন। এই যুদ্ধে স্পষ্ট বিভক্তি তৈরি হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে। দলের বড় একটি অংশ আসন্ন নির্বাচনে বাইডেনকে ভোট দেবে না বলে এরইমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে।

সর্বশেষ অবস্থা হলো- ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। এখন যদি ভোট হয়, নেতানিয়াহু ভয়াবহভাবে হেরে যাবেন বলে জনমত জরিপে দেখা গেছে। ইসরায়েলি দৈনিক মারিভের জন্য লাজার রিসার্চ ইনস্টিটিউট পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, এখন নির্বাচন হলে নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি মাত্র ১৯ আসন পাবে। অথচ, বর্তমানে দলটির ৩২ আসন রয়েছে। জরিপে দেখা যায়, ১২০ আসনবিশিষ্ট ইসরায়েলি পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন উগ্র জাতীয়তাবাদী জোট মাত্র ৪২ আসন পাবে। আর বিরোধী জোট পাবে ৭৮টি আসন।

স্থল-অভিযানে হামাসের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না নেতানিয়াহু। চারদিক থেকে ব্যর্থতা এমনভাবে ঘিরে ধরেছে, নেতানিয়াহুর পতন এখন সময়ের ব্যাপার।