বেলুচদের টার্গেট কেন চীনারা

বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবীদের বিভিন্ন গ্রুপ গত ১৮ মাসে নিজেদের মধ্যে সম্পদ ও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগিও করেছে - দ্যা ইকোনোমিক টাইমস

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০২ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৩৬

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশটি স্বাধীনতা চাচ্ছে সেই কবে থেকে! কিন্তু চাইলেও তারা যেমন সফল হতে পারছে না, তেমনই আবার তাদের স্তব্ধও করে দেয়া যাচ্ছে না। মাঝে-মাঝেই নানাভাবে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সম্প্রতি বেলুচ গেরিলাদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার ১৪ জওয়ান। এ ঘটনা বেলুচিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ করলো ভয়ানক আরেকটি দিক যে এখন থেকে শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপরই নয়, চীনা স্থাপনার ওপরও হামলা চলতেই থাকবে। অবশ্য চীনাদের ওপর বেলুচি বিদ্রোহীদের হামলা নতুন নয়। কিন্তু চীনের প্রকল্প ও চীনা নাগরিকরা কেন এই হামলার টার্গেট হচ্ছে তা নিয়ে এশিয়া টাইমসের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে এ প্রতিবেদক

বেলুচিস্তানে বিদ্রোহীদের তৎপরতা ক্রমেই বাড়ছে দেখে চীন তাদের মাল্টি বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর বা সিপিইসি-র নিরাপত্তা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দেখেও উদ্বিগ্ন চীন সরকার।

সিপিইসি প্রকল্পগুলোতে কর্মরত চীনা কর্মীদের নিরাপত্তা বিধানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গঠন করেছে একটি স্পেশ্যাল সিকিউরিটি ডিভিশন। এতে আছে ১৫ হাজারেরও বেশি সৈন্য। তারা চীনা কর্মীদের রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিয়ে রাখছে। এই সেনা প্রহরার অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে চীনা কর্মকর্তারা নিজেরাও বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী ভাড়া করেছেন।

বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবীদের বিভিন্ন গ্রুপ গত ১৮ মাসে নিজেদের মধ্যে সম্পদ ও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগিও করেছে। এসব সংগঠনের এরকম জোট বাঁধা বেলুচিদের বিদ্রোহে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ তাদের ওয়েবসাইটে নিজেদের গত ছয় মাসের, অর্থাৎ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের কার্যক্রমের একটি তালিকা আপলোড করেছে। এতে দাবি করা হয়েছে, ওই সময়ে পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর ৬৭টি হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১৩১ জন সৈন্যকে খতম এবং শতাধিক জনকে জখম করেছে তারা। এছাড়া এসব অভিযানে একটি সাঁজোয়া গাড়ি, ১০টি সামরিক যান এবং তিনটি মোবাইল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা হয়েছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিরপেক্ষ সংস্থা দ্য আর্মড কনফ্লিকড লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট বা এসিএলইডি দাবি করেছে, বেলুচিস্তানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ৩০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় ৯৫ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। সংস্থাটি বলেছে, গত সাত মাসে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিভিন্ন গ্রুপের সহিংস তৎপরতা আগের চাইতে অনেক বেড়ে গেছে।
সংস্থাটির রিপোর্টে জানানো হয়, পাকবাহিনী বেলুচিস্তাানের কেচ জেলায় নিরাপত্তা অভিযান চালায়। এর প্রতিশোধ নিতে গত মে মাসে বেলুচিস্তানে পাক বাহিনীর ওপর একের পর এক হামলা চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গ্রুপ। এতে পাকিস্তান বাহিনীর ১৭ জন নিহত হয়।

ওসব হামলার পাল্টা হিসেবে ইরান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় পাক বাহিনী শুরু করে ''গ্রাউন্ড জিরো ক্লিয়ারেন্স অপারেশন'' নামে এক সেনা অভিযান। ওই অভিযান বেলুচ বিদ্রোহের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেয়। এসিএলইডি-র হিসাবমতে, জুন থেকে জুলাই মাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বেলুচ বিদ্রোহীরা ১৮টি হামলা চালিয়ে ৫২ জনকে হত্যা করে। সব মিলিয়ে বলা যেত, বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

এই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে জটিল রূপ নিয়েছে চীনাদের ওপর বিদ্রোহীদের হামলা এবং বিদ্রোহীদের একটি জোটের আত্মপ্রকাশে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে গঠিত ওই জোটের নাম বেলুচ রাজি আজোহি সানগার অর্থাৎ বেলুচ জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বা ব্রাস।

এ জোটে আছে বেলুচিস্তান রিপাবলিকান আর্মি বা বিআরএ, বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ। সকলের অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে নিজেদের কার্যক্রমকে সমন্বিত করাই এ জোটের লক্ষ্য।

ব্রাস জোট গঠনের পরপরই পাক বাহিনীর ওপর হামলা বাড়িয়ে দেয় বেলুচ স্বাধীনতাকামীরা। প্রথম ছয় মাসে, অর্থাৎ ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ব্রাসের চারটি হামলায় নিহত হয় পাকিস্তানের ৪০এরও বেশি সৈন্য।

২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর করাচিতে চীনা কনস্যুলেটে হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। হামলায় দুই জন পুলিস কর্মকর্তা ও তিনজন বিদ্রোহীসহ সাত জন নিহত হয়।

পরের মাসেই বেলুচিস্তানের কেচ জেলায় একটি প্যারামিলিটারি ফ্রন্টিয়ার কোরের কনভয়ে হামলা চালিয়ে ১০ সৈন্যকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঞ্জগুর জেলায় একটি সেনা কনভয়ের ওপর হামলা চালানো হয়। সেবার নিহত হয় ছয় জন সৈন্য। এপ্রিল মাসে ওরমারা এলাকায় সংঘটিত এক হামলায় সেনা ও নৌবাহিনীর ১৪ জন নিহত হয়। ওরমারা হচ্ছে সেই এলাকা, যেখানে গত সপ্তাহেও বিদ্রোহীদের হামলায় ১৪ জন সৈনিক নিহত হয়।

গত জুলাইয়ে ব্রাস অর্থাৎ তিন বেলুচ বিদ্রোহী দলের এ জোটটি আরেকটি অভিনব পদক্ষেপ নেয়। তারা পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের স্বাধীনতাকামী সিন্ধুদেশ রেভ্যুলিউশনারি আর্মি বা এসআরএ-র সাথে জোট বাঁধার ঘোষণা দেয়।

এ ঘোষণা বিএলএ-র মতো চীনবিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে উৎসাহিত করে। উলে­খ্য, গত জুন মাসে এ গ্রুপটিই করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে হামলা চালিয়েছিল। ওই স্টক এক্সচেঞ্জে চীনের ৪০ ভাগ স্টেক রয়েছে।

কোনো-কোনো খবরে বলা হয়, করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে হামলার যোগাড়যন্ত্র করার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে এসআরএ। বিএলএ নামের গ্রুপটি সিপিইসি প্রকল্পের বিরোধী। তাই তারা চীন জড়িত আছে এমন সব প্রকল্পেই হামলা চালিয়ে চলেছে। যেমন, গোয়াদরে তারা চীনের নির্মিত একটি হোটেলে এবং করাচিতে চীনা কনস্যুলেটে হামলা করেছে।

এসব গ্রুপ যখন এসআরএ-র সাথে জোট বাঁধে, তখন ব্রাস এক বিবৃতিতে বলে, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান উভয়েই চীনের 'স¤প্রসারণবাদী' ও 'নিপীড়ক' পরিকল্পনার দ্বারা সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

চীন সম্প্রতি পাকিস্তানের উপকূলীয় এলাকা উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের রয়েছে এক হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ উপকূল। সিন্ধুর উপকূলে রয়েছে তিন শ'টি ছোট-বড় দ্বীপ। এসব দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং সেখানে চীনের বিনিয়োগের সুবিধা করে দিতে ইমরান খানের কেন্দ্রীয় সরকার গত ১ সেপ্টেম্বর এক প্রেসিডেন্সিয়াল অধ্যাদেশ জারি করে গঠন করেছে 'পাকিস্তান দ্বীপ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ'। এ সংস্থাই এখন থেকে পাকিস্তানের সব দ্বীপের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকবে। সিন্ধু প্রাদেশিক সরকার এ অধ্যাদেশের বিরোধিতা করেছে এবং অবিলম্বে ওটি প্রত্যাহারের আহবান জানিয়েছে।

এদিকে পাকিস্তানে নিজেদের ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতি হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে দেখে উদ্বিগ্ন চীন। তারা চাইছে, বিদ্রোহীদের জোট ব্রাস এবং তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক পাকিস্তান। ওদের 'সন্ত্রাসবাদী' ঘোষণা করুক। চীন আরো চাইছে, ওই গ্রুপগুলোকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ঘোষণার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যাক পাকিস্তান।

মার্ক্সবাদী ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ ব্রাস জোট লড়ছে একটি স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য। চীন ও পাকিস্তানসহ কোনো ''বিদেশী'' রাষ্ট্র তাদের খনিজ সম্পদ আহরণ করুক - এটাও চায় না তারা। ব্রাস জোটের প্রধান হচ্ছেন নজর বালুচ। তিনি কখনও পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে, কখনও আফগানিস্তানের কান্দাহারে বসে জোট চালান। এই জোটের তৎপরতা প্রধানত বেলুচিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ, যা কিনা আরব সাগর ও ইরান সীমান্ত সংলগ্ন। জোটের কেউ কেউ ইরানে বসেও দলের কাজ চালায়।
এভাবেই চলছে পাকিস্তান সরকারের সাথে বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর স্বাধীনতাকামী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ইঁদুর-বেড়াল খেলা। আর এ খেলার মাঝখানে আটকে গেছে দেশটিতে চীনের ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ।

এ খেলা কোথায় নিয়ে যায় পাকিস্তানকে, চীনকে এবং বেলুচ ও সিন্ধিদেরকে, কে বলবে!

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে