আমেরিকা থেকে কতোটা পাবে ভারত

কার্টুনটি করেছেন কার্লুস ল্যাটুফ - মিন্টপ্রেসনিউজ ডটকম

  • মেহেদী হাসান
  • ০৩ জুলাই ২০২০, ০০:২৩

যুক্তরাষ্ট্র -চীন স্নায়ুযুদ্ধ নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে ভারতের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব আগের তুলনায় আরো বেড়েছে। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনের মোকাবেলায় আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ভারত। বর্তমানে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাতে চীনের বিপরীতে ভারতের সার্বিক নাজুক চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সামরিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে ভারত চীনের বিপরীতে পিছিয়ে থাকলেও পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি ভারতের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে।

চীনের বিরুদ্ধে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় ভারতকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন বর্তমানে প্রধান প্রতিযোগীর পরিবর্তে প্রধান শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। চীনের সাথে সার্বিক বাণিজ্য নীতিতেও আমুল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ভারত এ অঞ্চলে আরো অনেক দিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রের মর্যাদা পাবে যা চীনের বিরুদ্ধে তার শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হিসেবে ভ‚মিকা পালন করবে। অপর দিকে রাশিয়াও একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় রয়েছে ভারতের পক্ষে।

চীন চেষ্টা করছে সীমান্ত অঞ্চলে তার কৌশলগত শক্তি প্রদর্শণ করতে। এজন্য উত্তরের হিমালয় থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বর্তমানে চীনের যে আধিপত্য প্রতিষ্টার চেষ্টা তা বেইজিংয়ের বৈশ্বিক উত্থানের সাথে জড়িত।
জিডিপির হিসেবে চীনের অর্থনীতি ভারতের ৫ গুন। বার্ষিক বাজেট ভারতের তিনগুন। লাদাখে লাইন অব কন্ট্রোলজুড়ে ভারত ৬০টি কৌশলগত সড়ক নির্মান করছে। ২০২২ সালের মধ্যে এসব সড়ক নির্মান শেষ করার পরিকল্পনা। চীনও তার অংশে একইভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিব্বতের পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে সম্প্রতি ৭ হাজার সেনা সমাবেশ ঘটায় চীন।

নরেন্দ্র মোদি ব্যস্ত লাদাখ নিয়ে তার বক্তব্যের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায়। তিনি বলেছেন, চীনা সৈন্যরা ভারতের ভ‚খন্ডে প্রবেশ করেনি। ভারতীয় গণমাধ্যম একে ভারতের পিছু হটা হিসেবে দেখছে। মোদির বক্তব্যে চীনা অভিযোগ এবং দাবি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সীমান্ত সংঘাত বিষয়ে। গোটা গালওয়ান ভ্যালির ওপর চীনা দাবিও সমর্থন পেয়েছে এর ফলে। অপর দিকে এ ঘটনায় ভারত সরকার এবং ভারতীয় আর্মির দক্ষতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

চীনের বিপরীতে ভারত নাজুক পরিস্থিতিতে পড়লেও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শক্তির প্রতিযোগিতায় এখনো দুদেশের মধ্যে ভারসাম্য রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধের কারণে ভারতের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগের তুলনায় বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অবস্থান এবং নীতি চীনকে মোকাবিলায় ভারতের জন্য অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারতের বিকল্প নেই। ফলে চীনের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র-ভারত কৌশলগত সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। ২০১৯ যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করেছে ইন্দো-প্যাসেফিক কৌশলগত প্রতিবেদন। এতে এ অঞ্চলে চীনতে মোকাবিলায় ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের সবেচেয়ে বড় প্রতিযোগী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রæ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। রাশিয়া নয় চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর শত্রæ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

চীনের বিরুদ্ধে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় ভারতকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ইলাস্ট্রেশন করেছেন বিনয় সিনহা। -বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ডটকম
চীনের বিরুদ্ধে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় ভারতকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ইলাস্ট্রেশন করেছেন বিনয় সিনহা। -বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ডটকম

 

কিছুদিন থেকে এশিয়া প্যাসেফিকের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলকে চিহিৃত করছে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল হিসাবে। যাকে দেখা হচ্ছে ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব বৃদ্ধির একটি লক্ষন হিসাবে। ইন্দো-প্যাসেফিক কৌশলগত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মুক্ত এবং দমনমূলক বিশ্ব ব্যবস্থার মাঝে ভ‚-রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মৌলিক উদ্বেগের বিষয়।

এটা পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের এ জাতীয় নিরাপত্তার মূল হুমকি হলো চীন। আর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান পছন্দ হলো ভারত। চীনের মোকাবেলায় ভারতই হলো এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র। এমনকি ভারতকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্যসেফিক কমান্ডের নাম পরিবর্তন করেছে। পূর্বে এর নাম ছিল প্যাফেসিক কমান্ড। বর্তমানে এর নাম ইউএস ইন্দো-প্যাসেফিক কমান্ড।

প্রতিবেদনে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলকে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বের ৬০ ভাগ সমুদ্র বানিজ্য পরিচালিত হয় ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল দিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সামরিক সম্পর্কও বর্তমানে নতুন মাত্রা পেয়েছে। ২০১৮ সালে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সাক্ষর করেছে কমিউনিকেশন কমপ্লায়ান্স এন্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট। এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দিল্লি সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করে ভারত।

ভারতের চাওয়া চীনের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র থাকবে তাদের পাশে। বিশেষ করে চীনের সাথে বিতর্কে ক‚টনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চায় ভারত। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে থাকার চেয়ে ভারত সম্ভবত একটি ঝুকি নেয়ার কৌশল নিয়েছে। যার ফলে এ অঞ্চলে বর্তমানে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল বর্তমানে একটি প্রচন্ড ভ‚-রাজনৈতিক জটিল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। চীন চেষ্টা করছে এ অঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তারে। আর এটি করা ছাড়া চীনের বিকল্প নেই। কারন বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের সার্বিক নিরাপত্তা বা অস্তিতের জন্য অপরিহার্য।

চীনের অর্থনীতি মূলত সমুদ্র বানিজ্যের ওপর নির্ভরশীল । সমুদ্র বানিজ্য আর সমুদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চীনের জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন এডমিনেস্ট্রেশন এর তথ্য অনুসারে বিশ্বে সমুদ্র পথে যত অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বহন করা হয় তার ৩০ ভাগেরও বেশি বহন করা হয় দক্ষিন চীন সাগর দিয়ে। দৈনিক এর পরিমান ১৫ লাখ ব্যারেল।

২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার মূল্যের বাণিজ্য পন্য পরিবহন করা হয় দক্ষিন চীন সাগর দিয়ে। ২০১৬ সালে এর পরিমান ছিল ৩ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ান ডলার। বর্তমানে এ দক্ষিন চীন সাগরের আধিপত্য নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ উত্তেজনা পর্যায়ে রয়েছে।

তন্ময় চক্রবর্তীর ইলাস্ট্রেশন - ইনডিয়াটুডে
তন্ময় চক্রবর্তীর ইলাস্ট্রেশন - ইনডিয়াটুডে

 

গোটা ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলজুড়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি। নিজস্ব ভ‚খন্ডগত অঞ্চল, গুয়াম সামরিক ঘাটি ছাড়াও এখানে রয়েছে জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, তাইওয়ান সহ বিশাল মিত্র বলয়। এসব অনেক দেশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক ঘাটি। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এসব মিত্র দেশের হুমকি ছাড়াও চীনের সাথে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনামের বিভিন্ন দ্বীপ ও সমুদ্র সীমান নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে যে কোনো প্রতিক‚ল পরিস্থিতি মোকাবেলায় চীনের কাছে বর্তমানে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

সমুদ্র নিরাপত্তার সাথে বর্তমানে জড়িত চীনের সামগ্রিক জাতীয় নিরাপত্তা আর সার্বভৌত্বের প্রশ্ন। এ সঙ্কট মোকাবেলায় চীন ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছে তার নৌ শক্তির উন্নয়নে। একই সাথে চীনের লক্ষ্য তার গোটা সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্বমানের সামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা।

সামরিক দিক দিয়ে চীনের উত্থানের সাথে বিশ্বজুড়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা চলছে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান বিষয়ে। যা নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভত হয়েছে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও তার মিত্র বলয়ের জন্য। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও মিত্র দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের শক্তি বৃদ্ধি করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বরাদ্দ করে চলছে বিপুল পরিমান বাজেট।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন চীন ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করলেও এই সময়ে ভারতের সাথে বড় ধরনের কোনো সংঘাতে যেতে চায় না। করোনার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে এর কারন হিসাবে দেখা হচ্ছে। অপর দিকে ভারতের নীতি নির্ধারকরা মনে করে চীনকে ঘেরাও করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার হওয়া দেশটির জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ। আবার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সংঘাতের মাঝে ভারত নিজেকে একটি ভারসাম্যের জায়গায় রাখতে চায়। কিন্তু সীমান্ত সংঘাত এ ভারসাম্য নস্যাত করে দিচ্ছে।

তবে চীনকে প্রতিরোধের যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্ন হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে চীন-রাশিয়া কৌশলগত অংশীদারিত্ব। এছাড়া সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। এ অঞ্চলে তার মিত্র দেশগুলো জানে যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মত তাদের সামরিকভাবে সমর্থন দিতে পারবে না। অপর দিকে চীন তার বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে চেষ্টা করে যাচ্ছে এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে