লাদাখ নিয়ে তিন দেশের জটিল হিসাব

লাদাখের সড়কে ভারতীয় সামরিক যান - ইনডিয়া ডটকম

  • মেহেদী হাসান
  • ২৫ জুন ২০২০, ০০:২৪

দুই দশেরকও বেশি সময় ধরে উপমহাদেশে আলোচিত এক জায়গার নাম লাদাখ। ১৯৯৯ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় কারগিল ঘিরে। কারগিল লাদাখের দ্বিতীয় রাজধানী। বর্তমানে চীন-ভারত রক্তাক্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে গালওয়ান ভ্যালি ঘিরে। গালওয়ান ভ্যালির অবস্থান লাদাখে। সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি বিডি ভিউজে। আজ আমরা লাদাখের কৌশলগত গুরুত্বের নানা দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।

লাদাখের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ সিন্ধু নদ। সিন্ধু নদ পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নদী। প্রায়ই সিন্ধুর পানি বন্ধ করে দিয়ে পাকিস্তানকে কাবু করার হুমকি দেয় ভারত। লাদাখ প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বের অন্যতম একটি বানিজ্য রুট। লাদাখে রয়েছে ঐতিহাসিক কারাকোরাম পাস। লাদাখ সংলগ্ন আকসাই চীনের মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কারাকোরাম হাইওয়ে যা চীনের জিনজিয়াং থেকে পাকিস্তানের পাঞ্জাব পাখতুন খোয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি।

লাদাখ সংলগ্ন আকসাই চীন নিয়ে ১৯৬২ সালে হয় চীন-ভারত যুদ্ধ। ফলে গত দুই দশক ধরে লাদাখ বেশ আলোচিত নাম হলেও ১৯৪৭ সাল থেকে উপমহাদেশে চীন-ভারত, পাকিস্তান- ভারত বিভিন্ন যুদ্ধ সংঘাত চলছে লাদাখ ঘিরে। সে হিসেবে গত ৭৩ বছরেও বেশি সময় ধরে লাদাখ চীন-ভারত ও পাকিস্তান - ভারত সংঘাতের অন্যতম একটি কেন্দ্র আর আলোচিত নাম।

লাদাখ বর্তমানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূণ ইস্যু। কারন চীন ও পাকিস্তনের সাথে রয়েছে এর গুরুত্বপূর্ণ সীমানা। একই সাথে লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি কার নিয়ন্ত্রনে থাকবে তার ওপর নির্ভর করছে চিন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনের ভবিষ্যত। ফলে লাদাখ সীমান্তে ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকান্ড চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনের জন্য হুমকি হিসাবে দেখছে চীন।

ভৌগোলিকভাবে লাদাখ কাশ্মিরের অংশ। বর্তমানে কাশ্মির থেকে আলাদা করে লাদাখ সরাসরি ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আনা হয়েছে। লাদাখের উত্তরে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের গিলগিট- বাল্টিস্তান। পশ্চিমে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু এন্ড কাশ্মির । লাদাখের পূর্বে চীনেরর দখলে থাকা আকসাই চীন। দক্ষিনে ভারতের হিমাচল প্রদেশ।

লাদাখের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বর্তমান সংঘাতপূর্ণ আর উত্তপ্ত গালওয়ান ভ্যালি। এই ভ্যালি বা উপত্যকাটি আকসাই চীনের খুব কাছে। এছাড়া লাদাখের উত্তর-পূর্বের একটি প্রান্ত স্পর্শ করেছে চীনের জিনজিয়াং রাজ্য। লাদাখের উত্তরের এক প্রান্ত তথা কারাকোরাম রেঞ্জ স্পর্শ করেছে শিয়াচেন হিমবাহ। শিয়াচেন হিমবাহের সাথে যুক্ত থাকার কারনে লাদাখের উত্তরে হিমালয় পর্বতের অবস্থান হিসেবে আখ্যায়িত করে কেউ কেউ। আসুন জেনে নেই লাদাখ সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

লাদাখের পশ্চিমে আকসাইচীন রয়েছে চীনের নিয়ন্ত্রনে। ভারতের দাবি আকসাই চীন লাদাখের অংশ। ভারতের যুক্তি সেই হিসেবে আকসাই চীন ভারতের। সম্প্রতি ভারত লাদাখকে কাশ্মির থেকে আলাদা করে সরাসরি কেন্দ্রের অধীনে নেয়ার পর আকসাই চীনও দখলের হুমকি দেয় বিজেপি নেতৃবৃন্দ।

লাদাখ ছিল ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের অংশ। ২০১৯ সালে ভারত কাশ্মিরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করে আর লাদাখ কাশ্মির রাজ্য থেকে আলাদা করে চালু করে সরাসরি কেন্দ্রের শাসন যা ইউনিয়ন অব টেরিটরি নামে পরিচিত। লাদাখের রাজধানী লেহ এবং কারগিল। লাদাখের সবচেয়ে উচু এলাকা কারাকোরামের সালটরো পাহাড়। এটি পৃথবীর ৩১ তম উচু পাহাড়। লাদাখের সবচেয়ে নিচু এলাকা সিন্ধ‚ নদ। লাদাখের আয়তন ২২ হাজার ৮৩৬ বর্গমাইল। জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখ।

বিভিন্ন কারনে বর্তমানে লাদাখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। প্রাচীন কাল থেকে লাদাখ গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য রুট হিসাবে পরিচিত। লাদাখের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সিন্ধু নদ চীন, ভারত আর পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। সিন্ধ‚ নদীর উৎপত্তি হিমালয়ের মানস সরোবরের নিকট তিব্বত মালভ‚মির পাশ দিয়ে । বিখ্যাত এ সিন্ধু নদী ভারত নিয়ন্ত্রিত লাদাখ হয়ে প্রবেশ করেছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের গিলগিট-বাল্টিস্তানে। এরপর গেটা পাকিস্তান অতিক্রম করে এ নদী মিলেছে করাচি বন্দরের কাছ থেকে আরব সাগরে।

সিন্ধু পাকিস্তানের সবচেয়ে দীর্ঘ আর গুরুত্বপূর্ণ নদী। এ নদীর পানি নিয়ে ভারত -পাকিস্তান প্রায়ই দ্ব›দ্ব সৃষ্টি হয়। নদীটির পুরো চলার পথ প্রায় পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে হলেও এর শুরুর দিকের পথ ভারত নিয়ন্ত্রিত লাদাখে। ফলে ভারত পাকিস্তানকে কাবু করার জন্য প্রায়ই রাজনৈতিক কারনে এ নদীর পানি নিয়ন্ত্রনের হুমকি দেয় পাকিস্তানকে। লাদাখে সিন্ধু নদীর পানি বন্ধ করে পাকিস্তানকে জব্দ করতে চায় ভারত। গোটা পাকিস্তানজুড়ে রয়েছে সিন্ধু নদীর অনেক শাখা প্রশাখা।

লাদাখের নুবরা উপত্যকা। ছবি : ইন্টারনেট

 

ঐতিহাসিক সিল্ক রুটের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে লাদাখে। লাদাখের বাণিজ্য রুটের সাথে যুক্ত মধ্য এশিয়া, চীন এবং দক্ষিন এশিয়া। লাদাখের প্রাচীন আর গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য রুট থাকলেও ১৯৬০ সাল থেকে তা বন্ধ রয়েছে । চীন তিব্বতের সাথে লাদাখের এ সীমন্ত রুট বন্ধ করে দেয়ায় অচল হয়ে পড়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বানিজ্য রুট। এর ফলে বন্ধ হয়ে যায় এ রুটের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। তবে ১৯৭৪ সাল থেকে ভারত চেষ্টা করছে এটাকে পর্যটনের গুরুত্বর্পুণ গন্তব্য করার। গোটা কাশ্মিরে লাদাখ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় এখানে রয়েছে ভারতের ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি।

লাদাখের সবচেয়ে বড় শহর লেহ। দ্বিতীয় শহর কারিগল। কারগিল নামটি এ অঞ্চলে পরিচিত হয়ে ওঠে ১৯৯৯ সালে কারগিল নিয়ে ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধের সময়। এ কারগিল যুদ্ধের রেশ ধরে পাকিস্তানে নওয়াজ শরীফকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে তৎকালীন সেনা প্রধান পারভেজ মোশাররফ।

লাদাখ নিয়ে ভারতের চলমান চীন ও পাকিস্তানের সাথে দ্ব›দ্ব, উত্তেজনা আর সংঘাতের সূচনা ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় থেকে। ডোগরা মহারাজা হরিসিং কাশ্মিরকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার চুক্তি করার পরপরই পাকিস্তান অভিযান পরিচালনা করে কাশ্মিরে। সেই থেকে চলছে লাদাখসহ কাশ্মির নিয়ে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ, সংঘাত। এ সংঘাতের এক পর্যায়ে চীন ১৯৪৯ সালে বন্ধ করে দেয় লাদাখের নুবরার সাথে জিনজিয়াং এর সীমান্ত।

১৯৫৫ সাল থেকে চীন আকসাই চীনের মধ্য দিয়ে জিনজিয়াং ও তিব্বতের মধ্যে সংযোগকারী রাস্তা নির্মান শুরু করে। ভারত তখন চেষ্টা করে লাদাখ সংলগ্ন আকসাই চীনের ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার। ফলে আকসাই চীন নিয়ে ১৯৬২ সালে যুদ্ধ হয় চীন ও ভারতের মধ্যে। এ যুদ্ধে পরাজয় ঘটে ভারতের। সেই থেকে আকসাই চীনের ওপর দখল পাকাপোক্ত হয় চীনের।

ভারতের দাবি ১৯৬২ সাল থেকে চীন আকসাই চীন দখল করে রেখেছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর চীন এখানে পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে নির্মান করে গুরুত্বপূর্ণ কারাকোরাম হাইওয়ে। এ কারাকোরাম হাইওয়ে গিলগিট বাল্টিস্তান হয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখোয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। চীনের দিকে এ সড়ক জিনজিয়াং পর্যন্ত । এটি চীন-পাকিস্তান ফ্রেন্ডশিপ হাইওয়ে নামে পরিচিত। যা চীনের একটি ন্যাশনাল হাইওয়ে। এটি এশিয়ান হাইওয়েরও অংশ। বর্তমান চীন পাকিস্তান- বহুমুখী সম্পর্কের অন্যতম মাধ্যম এ সড়ক। সড়কটির দৈর্ঘ্য ৮১০ মাইল। এটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক এবং দুর্গম পবর্তসঙ্কুল পরিস্থিতি অতিক্রম করে এ সড়ক নির্মানের সফলতার কারনে এটি অষ্টম আশ্চর্য নামেও পরিচিত।

চীন-পাকিস্তান কারাকোরাম হাইওয়ের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারত নির্মান করে শ্রীনগর -টু লেহ হাইওয়ে। এর ফলে শ্রীনগর থেকে লাদাখের রাজধানী লেহর দূরত্ব অতিক্রম করতে আগে যেখানে ১৬ দিন লাগত এখন সেখানে লাগে মাত্র ২ দিনে। ১৯৬২ সালে চীন- ভারত যুদ্ধের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে অনেক বার উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে লাদাখ নিয়ে। লাদাখের ১৪২ মাইল সীমান রয়েছে উভয় দেশের মধ্যে যা আন্তর্জাতিক। বাকী ১৮৯ মাইল লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল।

ভারতের সবচেয়ে উচু এলাকা লাদাখ। লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে লাইন অব কন্ট্রোলের নিকট ভারতের দৌলত বেগ সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মানের কারনে। এ সড়ক এলাকা উত্তরে ভারতীয় আর্মির সাব সেক্টরের অধীন। এ সড়ক কারাকোরাম পাসের বেস পর্যন্ত বিস্তৃত হলে লাদাঘের লেহ এর সাথে শ্রীনগরের বর্তমান দুই দিনের পথ মাত্র ৬ ঘন্টায় নেমে আসবে। এ সড়ক গালওয়ান ভ্যালির থেকে শিয়ক নদী এবং দক্ষিনের গুরুত্বপূর্ণ প্যাংগং পর্যন্ত যুক্ত করবে।

ভারতের নতুন এ সড়কের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নির্ভর করছে গালওয়ান ভ্যালির নিয়ন্ত্রনের ওপর। সে কারনে ভারত-চীন উভয়ের কাছে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ গালওয়ান ভ্যালির নিয়ন্ত্রন গ্রহণ। কারন ভারতের এ সড়ক এ অঞ্চলে চীনের জন্য হুমকি। কারন গালওয়ান ভ্যালি হয়ে ভারত পৌছে যেতে পারবে চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই মালভ‚মি পর্যন্ত । যেখান দিয়ে চলে গেছে জিনজিয়াং- তিব্বত হাইওয়ে। ফলে গালওয়ান মালভ‚মির নিয়ন্ত্রন হাতছাড়া চীনের জন্য ঝুকিপূর্ণ।
গালওয়ান ভ্যালির অবস্থান লাদাখের পশ্চিমে চিন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনের কাছে। ভারতের জন্য গালওয়ান ভ্যালিই হলো একমাত্র পথ যেখান দিয়ে সে চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনে পৌছতে পারে। ভারত আকসাই চিনকে নিজের বলে দাবি করে। সড়ক নির্মানের পাশপাশি ভারত গালওয়ান নাল্লার ওপর দিয়ে ব্রিজ নির্মান করছে বলে খবর এসেছে। এ ব্রিজ একটি ফিডার রোড নেটওয়ার্কের অংশ যা যুক্ত হবে দৌলত বেগ সড়কের সাখে। ভারতের গণমাধ্যমের খবর -চীনের আশঙ্কা ভারত এ সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করছে ভবিষ্যতে আকসাই চীন দখলের পরিকল্পনায়। ১৮৫০ সাল থেকে লাদাখের ওপর নজর পড়ে এবং আগমন বাড়তে থাকে ইউরোপীয়দের।

লাদাখের সাথে জম্মু কাশ্মিরের অনেক বৈপরিত্য রয়েছে। জম্মু কাশ্মিরের অধিবাসীরা মূলত মুসলমান হলেও লাদাখের অধিকাংশ মানুষ অমুসলিম। কিন্তু তারপরও এখানে শতকরা হিসেবে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। লাদাখের ৪৬ ভাগ মুসলমান, ৪০ ভাগ হিন্দু, ১২ ভাগ বৌদ্ধ এবং ২ ভাগ অন্যান্য। লাদাখ ভারতের সবচেয়ে কম জনবহুল এলাকা। লাদাখের মানুষের জীবনধারার সাথে বেশি মিল রয়েছে তিব্বতীদের সাথে। লাদাখ লিটল তিব্বত নামেও পরিচিত।

বর্তমানে ভারতের যতগুলো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বা ইউনিয়ন অব টেরিটরি রয়েছে তার মধ্যে লাদাখ সবচেয়ে বড়। লাদাখ বর্তমানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি নিয়ে এখন জটিল অবস্থায় পড়েছে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে