দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে ভারত কতটা প্রস্তুত

চীন-ভারত উত্তেজনা, পাকিস্তানের জন্য সুবর্ণ সুযোগ - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ২০ জুন ২০২০, ০০:০৭

ভারতের অনেক বিশ্লেষকের আশঙ্কা চীন ও পাকিস্তান মিলে দুই দিক থেকে একসাথে ভারতের ওপর হামলা পরিচালনা করতে পারে। আর দুই ফ্রন্ট থেকে চীন ও পাকিস্তানের এ যৌথ হামলা মোকাবেলার সামর্থ্য নেই ভারতের। এ ধরনের হামলা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতও নয় ভারতীয় আর্মি। সে কারনে ভারতের নীতি নির্ধারকদের উচিত এক সাথে দুই ফ্রন্টে দুই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

ভারতের অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন দুই ফ্রন্টে মোকাবিলার জন্য সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নাটকীয় কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমে পারমানবিক হামলা নয় এ নীতি থেকেও ভারতকে সরে আসার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের আশঙ্কা সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ভারত বর্তমানে চীন থেকে অনেক পেছনে। সেখানে হামলা পরিকল্পনায় চীনের সাথে পাকিস্তান যুক্ত হলে তা একটি বড় ধরনের অসম অবস্থার সৃষ্টি করবে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে ভারতের জন্য বর্তমানে বড় একটি বিপদের কারনে হলো তার গ্লো পাওয়ার বা বিশ্ব শক্তি হিসেবে আবির্ভাব বিষয়ে জোর গলায় প্রচারণা। প্রতিবেশী দুই পারমানবিক শক্তিধর আর শত্রু রাষ্ট্রের মোকাবেলায় ভারতীয় আর্মির বর্তমান যে দুর্বল চিত্র তার সাথে ভারতের গ্লোবাল পাওয়ার এর প্রচারণা একেবারেই বেমানান। অনেকের কাছেই এটা ফাকা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। বহির্বিশ্বে বর্তমানে ভারতের যে ইমেজ তৈরি হয়েছে তার সাথে বাস্তবতার তেমন মিল নেই বলে মনে করেন অনেকে।

অবজারভার রিসার্স ফাউন্ডেশন বা ওআরএফ নামক ভারতের একটি থিংট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে ভারতের বিরুদ্ধে চীন ও পাকিস্তানের যৌথ হামলার আশঙ্কার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। আর এ ধরনের হামলা মোকাবেলায় ভারতকে প্রস্তুতি গ্রহণের জোরালো পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সাথে এ প্রতিবেদনে চীন ও পাকিস্তানের সাথে ভারতের সামরিক শক্তির বিভিন্ন বিষয়ে তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিমান ও স্থল উভয় দিকে ভারত পাকিস্তান ও চীন থেকে অনেক পেছনে রয়েছে। ভারতীয় নেভি কিছুটা শক্তিশালী হলেও তা পাকিস্তান ও চীনের যৌথ শক্তির বিপরীতে অনেক দুর্বল। এ অবস্থায় ভারতের বিরুদ্ধে চীন ও পাকিস্তানের যৌথ হামলায় ভারতের খুবই নাজুক চিত্র ফুটে উঠেছে প্রতিবেদনে।

চীন ও পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক দিন দিন শুধু অবনতির দিকেই যাচ্ছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে চীন ও পাকিস্তান মিলে ভারতের ওপর পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আকস্মিকভাবে হামলে পড়ার আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে ভারতের অনেকের কাছে।

অবজারভার রিসার্স ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিন দেশের সামরিক তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও চীনের দুই ফ্রন্টের বিরুদ্ধে ভারতের শক্তির অনুপাত বিশ্লেষন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-এটি খুবই পরিষ্কার যে, শক্তির ভারসাম্য ভারতের অনুকুলে নয়। ভারতীয় আর্মি এবং বিমান বাহিনী এ দিক থেকে নাজুক অবস্থায় রয়েছে শত্রুর বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবস্থা খুবই বেহাল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

অবজারভার রিসার্স ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের পিপলস আর্মির ছোট অংশও যদিও যুদ্ধে লিপ্ত হয় তবু চীন-পাকিস্তানের দুই দিকের আক্রমন মোকাবেলার সাধ্য নেই ভারতীয় আর্মি ও বিমান বাহিনীর। তবে ভারতীয় নেভি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। চীন ও পাকিস্তানের তুলনায় ভারতীয় নেভিকে সামান্য এগিয়ে রেখেছে ভারতের এই গবেষনা প্রতিষ্টানটি। তবে এ কথাও বলা হয়েছে, চীন-পাকিস্তান যৌথ আক্রমন ভারতীয় নেভির জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ও আর এফের প্রতিবেদনে ভারতীয় নেভিকে চীন ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রাখলেও বাস্তবে চীনা নেভি বর্তমানে ভারতীয় নেভির বিপরীতে অনেক অনেক শক্তিশালী। চীন ও ভারতের নৌ শক্তির সর্বশেষ সর্বশেষ পর্যালোচনায় দেখা যায়, চীনে মোট রণতরীর সংখ্যা ৭৭৭টি। বিমানবাহী রণতরী ২টি। ডেস্ট্রয়ার ৩৬টি। সাবমেরিন ৭৪টি। ফ্রিগেটস ৫২টি। করভেটস ৫০টি। টহল যান ২২০টি এবং মাইন ওয়ারফেয়ার ২৯টি। অপর দিকে ভারতে মোট রণতরীর সংখ্যা ২৮৫টি। বিমানবাহী রণতরী ১টি। ডেস্ট্রয়ার ১০টি। সাবমেরিন ১৬টি। ফ্রিগেট ১৩টি। করভেট ১৯টি। টহল জাহাজ ১৩৯টি। মাইন ওয়ারফেয়ার ৩টি।

সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে চীন বর্তমানে প্রায় স্বয়ংসম্পূণ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বড় সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারক দেশ। অপর দিকে ভারত বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বড় সরমাস্ত্র আমদানিকারক দেশে। উভয় দেশের সামরিক শক্তির পার্থক্য এখানেই পরিষ্কার। চলতি বছরের ২২ মে চীন ১৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক বাজেট ঘোষণা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর সামরিক বাজেট।

অপরদিকে ১ ফেব্রুয়ারি ভারত ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের জন্য ৬৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক বাজেট ঘোষণা করে। তবে ও আর এফের প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে ভারতের পারমানবিক শক্তি বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে তিনটি দেশই এ শক্তির দিক দিয়ে সমান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তিনটি পৃথক উপায়ে ভারতের বিরুদ্ধে দুই দিক থেকে ও চীন পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হতে পারে। প্রথমত চীন-ভারত সংঘাতের সুযোগ নেবে পাকিস্তান। একইভাবে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের কৌশলগত সুবিধা পাচ্ছে চীন। তৃতীয়ত চীন পাকিস্তান মিলে ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব দিক থেকে আকস্মিক হামলা পরিচালনা করতে পারে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে ভারতের আশঙ্কা অনুযায়ী যদি সত্যি সত্যি চীন ও পাকিস্তান মিলে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমন পরিচালনা করে এবং ভারতের এ ধরনের আক্রমন মোকাবলোর পূর্ব প্রস্তুতিও থাকে তবু তা ভারতের জন্য নাজুক পরিণতি বয়ে আনবে।

ভারতের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে পাকিস্তান ও চীনের বিভিন্ন সমরাস্ত্রের বিপরীতে ভারতের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই গবেষণায় মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক বা এমবিটি বিষয়ে বলা হয়েছে এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিপরীতে ভারত ক্রমাগতভাবে পিছিয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের বিপরীতে ভারতের ট্যাঙ্ক শক্তি ক্রমে হ্রাস পায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ২০০৭ সালে দুই দেশের আনুপাতিক ব্যবধান দশমিক ৬১ থেকে ২০১৬ সালে বেড়ে দশমিক ৮৫ দাড়িয়েছে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১০ বছরে পাকিস্তানের এমবিটির সংখ্যা ১০০ টি বেড়েছে। আর ভারতের এমবিটিরি সংখ্যা ১ হাজারের বেশি কমেছে।

একইভাবে চীনের সাথেও ভারতের শক্তির ব্যবধান ক্রমে বাড়ছে এমবিটির দিক দিয়ে। ২০০৭ সালে এ ব্যবধান যেখানে ছিল ১ দমমিক ৮৯ ছিল সেখানে তা ২০১৬ সালে বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ২৩।

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ বিমান সংখ্যার ব্যবধান কিছুটা কমেছে। ২০০৭ সালে যেখানে ব্যবধান ছিল দশমিক ৬৪ সেখানে ২০১৬ সালে তা কমে দাড়িয়েছে দশমিক ৫৬। একইভাবে চীনের সাথে ভারতের বিমান সংখ্যার ব্যবধান ৩ দশমিক ১২ থেকে ২ দশমিক ৮৭ এ দাড়িয়েছে । তবে দুই ক্ষেত্রেই চীনের শ্রেষ্ঠত রয়েছে ভারতের বিপরীতে।

পাকিস্তান ও ভারতের ফ্রিগেট শক্তির অনুপাতও বেড়েছে এ সময়ের মধ্যে। পাকিস্তানের ফ্রিগেট সংখ্যা ঠিক থাকলেও কমেছে ভারতের ফ্রিগেট সংখ্যা। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালে ভারতের ফ্রিগেট সংখ্যা ৫টি কমেছে কিন্তু পাকিস্তানের বেড়েছে চারটি। একই সময়ে চীনের ফ্রিগেট সংখ্যা বাড়ে ১১টি। ২০১৫ সালে ভারতের চেয়ে চীনের শক্তি চারগুন ফ্রিগেট সংখ্যার দিক দিয়ে।

২০১২ থেকে ২০১৬ সালে ভারতের যুদ্ধ বিমানের সংখ্যা ৮৭০ থেকে কমে ৮০৩ এ নামে। অপর দিকে একই সময়ে চীনা এয়ার ফোর্সে যুদ্ধ বিমানের সংখ্যা শতকরা ২১ ভাগ বৃদ্ধি পায়।

ভারতের বিমান বাহিনীর দুর্বলতা নিয়ে অনেক দিন ধরে সমালোচনা চলছে। পাকিস্তানের মোকাবেলাতেই ভারতের বিমান বাহিনী হিমশিম খায়। সেখানে চীনের নিজেদের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ বিমান আর হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেমের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে অনেকে তুলনায় আনতে রাজি নয়।

চীনের তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমানের নাম চেংদু জে-২০। এটি একটি স্টেলথ ফাইটার । পঞ্চম প্রজন্মের এ স্টেলথ ফাইটারের মাধ্যমে চীন বিশ্বের তৃতীয় দেশ যারা এ ধরনের শক্তিশালী বিমান তৈরি করতে সক্ষম।

ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান হলো এসইউ-৩০ এমকে। রাশিয়ার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে ভারতের হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড তৈরি করছে এ বিমান। এটি চতুর্থ প্রজন্মের বিমান।

সর্বশেষ ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্ত হওয়া এবং পাইলট ধরা পড়ার ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ভারত। এয়ার মার্শাল বিএস ধানোয়া ২০১৭ সালে বলেন, দুই ফ্রন্টে বিমান হামলা মোকাবেলার মত পর্যাপ্ত বিমান নেই ভারতের কাছে।

তবে ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিন দেশেরই সাবরেমিন সংখ্যা কমেছে বলে এই গবেষান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে দুই দিক থেকে আক্রমন মোকাবেলায় ভারতীয় আর্মি প্রস্তুত এই দাবি কোনো ভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। পারমানবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী শত্রু মোকাবেলায় ভারতের জিডিপির ১ দশমিক ৬২ ভাগের বেশি সামারিক খাতে ব্যয় করা উচিত বলে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সামরিক খাতে যে হারে ব্যয় করা হচ্ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে দুই ফ্রন্টের হামলা মোকাবেলা করে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নাটকীয় পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে। এ ধরনের একটি পদক্ষেপ হতে পারে কৌশলগত পারমানবিক বোমার সস্তা কোনো বিকল্প ব্যবস্থার সূচনা। প্রতিবেদনে পরামর্শ দেয়া হয়েছে প্রথমে পারমানবিক বোমা ব্যবহার নয় এ দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে হবে। প্রচলিত এবং পারমানবিক যুদ্ধের দক্ষতার সমন্বয় ঘটাতে হবে ভারতীয় আর্মির।

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো ভারত খুব জোরে শোরে ঘোষণা দিয়েছে তারা গ্লোবাল পাওয়ার বা বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অথচ বিশ্লেষনে এটি পরিষ্কার যে, ভারতের সামরিক শক্তির যে চিত্র তার সাথে এ ঘোষণা একেবারোই বেমানান।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে