হিমালয়কন্যার নাম নেপাল

নেপালের লোকসাহিত্যে আছে ইয়েতি নিয়ে গল্প। শুধু গল্প নয়, বরফের মধ্যে প্রকান্ড লোমশ জন্তুর দেখা পেয়েছেন বলেও দাবি করেছেন অনেকে - টাইমস অব ইন্ডিয়া

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ০৯ জুন ২০২০, ১৯:২০

তুষারমানব, দেখতে বন মানুষের মতো। তবে প্রকান্ড শরীর। এরা সঙ্গে রাখে পাথরের তৈরি অস্ত্র। পাহাড়ে শিস দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এদের নাম ইয়েতি। থাকে হিমালয়ে।

হিমালয়ের পা ছুঁয়ে আছে হিমালয়কন্যা। এই কন্যার নাম নেপাল। স্থানীয় ভাষার ‘নে’ শব্দের অর্থ ‘পবিত্র’। আর ‘পাল’ শব্দের অর্থ ‘গুহা’। সুতরাং দেশটির নাম দাঁড়ায় পবিত্র গুহা।

একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে, হিমদানব ইয়েতিরা বড় বড় গুহায় থাকে। নেপালের লোকসাহিত্যে আছে ইয়েতি নিয়ে গল্প। শুধু গল্প নয়, বরফের মধ্যে প্রকান্ড লোমশ জন্তুর দেখা পেয়েছেন বলেও দাবি করেছেন অনেকে। কয়েক বছর আগে ইয়েতির লোমের অংশ এবং পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে বলেও কেউ কেউ জোর দিয়ে বলেছেন। তবে এখন পর্যন্ত এই প্রাণীটির বিশ্বাসযোগ্য কোনো ছবি পাওয়া যায়নি।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি এই পায়ের ছাপগুলো ইয়েতির
কেউ কেউ দাবি করছেন এই পায়ের ছাপগুলো ইয়েতির

 

ইয়েতিতে যাদের বিশ্বাস, তারা প্রমাণের অপেক্ষায় থাকেন না। এরা দিনের পর দিন ইয়েতির গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন। সেই গল্প রোমাঞ্চকর।

ইয়েতিদের বাড়ি হিমালয় পর্বতমালায়। তিব্বত মালভূমি এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে উঁচু দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে হিমালয়। এই দেয়াল দুর্গম। আর দুর্গমে আকর্ষণ দুঃসাহসিকদের। তাই পাহাড় যাদের টানে, তারা ছুটে যান হিমালয়ে। একটি উপত্যকা থেকে শুরু হয় দুঃসাহসিক অভিযান।

উপত্যকার নাম সোলুখুম্বু। এর-ই একটি গ্রাম পাংবোচি। এই গ্রামে থাকে শেরপারা। ‘শেরপা’ প্রাচীন এক জনগোষ্ঠীর নাম। হিমালয় আরোহণ করতে আসা বিদেশিদের পথ-প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন এরা। একসময় শেরপাদের বাস ছিলো তিব্বতের পূর্বদিকে। তখন এদের ডাকা হতো ‘শার-ওয়া’ বলে। পরে উন্নত ভাগ্যের আশায় এরা চলে আসেন নেপালে। আর হিমালয়ে বিদেশিদের আনাগোনা বাড়তে থাকলে এদের ভাগ্য বদলাতে থাকে।

শেরপারা অভিযাত্রীকে পথ দেখান, নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন। হাজার বছর ধরে বরফের তাপমাত্রায় থাকতে থাকতে হিমালয়ের আবহাওয়া এদের গা সওয়া। তার পরও শেরপাদের বিপদ হয়। অভিযাত্রীকে রক্ষা করতে নিজের কাঁধে বিপদ তুলে নেন। দুর্যোগের মুখোমুখি হন। অভিযাত্রীদের মৃত্যু হয়, শেরপারাও প্রাণ হারান। হিমালয়ের বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে অনেক লাশ। এগুলোর কোনোটি অভিযাত্রীর। কোনোটি শেরপার।

হিমালয়কন্যা নেপাল কি তাহলে এতোটাই প্রতিকূল!
যারা দুঃসাহসিক অভিযান করতে চান, সাহস দেখিয়ে পায়ে হেঁটে এভারেস্ট জয় করতে চান, তাদের জন্য তো পদে পদে বিপদ অপেক্ষা করবেই।

আর যারা ফুলবাবুর মতো ভ্রমণ করতে চান, তাদের জন্যও নেপাল স্বর্গভ’মি। মানচিত্রে দেখা যায়, এক চিলতে ভ’মি নেপাল। এর উত্তর দিকে চীনের মালভূমি। বাকি তিন দিকেই ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের সরাসরি সীমান্ত নেই। তবে তেতুলিয়া সীমান্ত থেকে নেপালের সীমান্ত পর্যন্ত দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। মুরগির গলার মতো সরু এই করিডোর দিয়ে সরাসরি নেপাল যাওয়ার নিয়ম নেই। কারণ এই পথে ইমিগ্রেশন বসানো হয়নি। স্থলপথে যেতে হলে লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়।

যদি ঘুরতে না চান, হাতে সময় কম থাকে, পকেটে পর্যাপ্ত টাকা থাকে তাহলে ঢাকা থেকে সোজা উড়াল দিয়ে কাঠমান্ডুতে চলে যাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

কাঠমান্ডু, নেপালের রাজধানী। ছবিটি দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
কাঠমান্ডু, নেপালের রাজধানী। ছবিটি দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া

 

কাঠমান্ডু একটি উপত্যকা। প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ১৮১ বর্গ কিলোমিটার ভূমির দেশ নেপালের রাজধানী এই উপত্যকাটিই। এখান থেকেই শুরু হয় পর্যটকদের ভ্রমণের উত্তেজনা। এখানে আছে নতুন, পুরনো এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিশেল। উপত্যকার বড় আকর্ষণ দরবার হল। সর্বশেষ ভ’মিকম্পে এটির ক্ষতি হয়। উপত্যকার দেয়াল, অর্থাৎ পাহাড়ে পাহাড়ে অতীতের চিহ্ন। আছে প্রাচীন বৌদ্ধ কমপ্লেক্স সয়ম্ভনাথ। পায়ে হেঁটে ঘুরতে পারেন পুরনো কাঠমান্ডু।
ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার জন্য যেতে হবে প্রাচীন রাজাদের রাজধানী ভক্তপুর। কাঠমান্ডু থেকে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। স্থানীয়রা ডাকেন ‘বুদগাঁও’ নামে। প্রাচীন এই শহরে আছে মধ্যযুগীয় শিল্প-সাহিত্য, কাঠের কারুকাজ, ধাতুর মূর্তি। এই শহরে যারা থাকেন, তাদের জীবনযাত্রাও অনেকটা প্রাচীন ধাঁচের। এখানে কৃষক আছে। কৃষকের সাদামাটা বাড়ি আছে। বাড়ির আঙিনায় বাতাস আসে। বাতাসে খড় উড়াউড়ি করে।

ভক্তপুর বিখ্যাত প্রাচীন মন্দিরের জন্য। হিন্দু মন্দির যেমন আছে, তেমন আছে বৌদ্ধ মন্দিরও। মন্দিরে প্রার্থনা, উলুধ্বনী। বাইরে পর্যটকদের কোলাহল। এতোসব কোলাহলের ভেতরও কিছু লোক একেবারে শান্ত। কোথায় কি ঘটছে খবর রাখেন না তারা। গেরুয়া বসনে বসে থাকেন মন্দিরের সামনে। কেউ ভেতরে।

এরা ধ্যানে ডুবে থাকেন। এরা সন্ন্যাসী। হিন্দু মন্দিরে হিন্দু সন্ন্যাসী। বৌদ্ধ মন্দিরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। এরা এখানেই থাকেন। এটাই এদের বাড়ি। বিপদ- আপদেও বাড়ি ছাড়েন না। এমনকি ভ’মিকম্পের সময়ও না। তবে প্রকৃত সন্নাসীদের ভীড়ে গেরুয়া পোশাক গায়ে অনেক প্রতারকও আছে এখানে।

আর রহস্যময় সন্ন্যাসীরা থাকেন হিমালয়ে, তিব্বতের দিকে। লোকালয়ে আসেন না, মানুষের সঙ্গে দেখাও দেন না। ইয়েতিদের মতো লুকিয়ে থাকেন।

স্থানীয়দের বিশ্বাস, এদের অনেকে শুন্যে ভেসেও থাকতে পারেন। যদি কারো সৌভাগ্য হয়, সন্ন্যাসীদের দেখা পান। কয়েক পরতের শীতপোশাক পড়েও যেখানে সাধারণ মানুষের কাঁপুনি উঠে, সেখানে এই সন্ন্যাসীরা খালি গায়ে থাকেন।
কিন্তু কেমন করে?

হিমালয়ের একটি গুহায় থাকেন এই সন্ন্যাসী
হিমালয়ের একটি গুহায় থাকেন এই সন্ন্যাসী

 

বিষয়টি জানতে ১৯৮০ সালে হার্ভার্ডের মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর হারবার্ট বেনসন যান হিমালয়ে। সঙ্গে গবেষকদের একটি দল ছিল। তিনি ফিরে এসে জানিয়েছেন, হিমালয়ের সন্যাসিরা শরীরের তাপমাত্রা কমাতে-বাড়াতে পারেন। গবেষক দলটির সামনেই এক সন্যাসি তার শরীরে বরফঠান্ডা পানিতে ভেজা কম্বল জড়িয়ে ধরেছিলেন। শরীরের উত্তাপে সেই কম্বলটি ৩০ মিনিটের মধ্যেই শুকিয়ে যায়। হারবার্ট বেনসন জানিয়েছেন, যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে সন্যাসিরা এটি আয়ত্ব করেছেন। এই কাজগুলো যে কারো দ্বারাই করা সম্ভব। তবে এর জন্য চাই অনুশীলন।

হিমালয়ের এই সন্ন্যাসীদের দেখার সৌভাগ্য কেবল দুঃসাহসিক অভিযাত্রিকদেরই হয়। যারা জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন। তবে যারা সন্ন্যাসীদের দেখা পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে একটু দূর থেকে হিমালয় দেখতে চান, তাদের যেতে হবে ধুলিখেল।

পাঁচশ বছরের পুরনো শহর ধুলিখেল। ছবিটি পিন্টারেস্ট থেকে নেওয়া
পাঁচশ বছরের পুরনো শহর ধুলিখেল। ছবিটি পিন্টারেস্ট থেকে নেওয়া

 

পাঁচশ বছরের পুরনো শহর ধুলিখেল, কাঠমান্ডু থেকে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। মেঘ-কুয়াশা না থাকলে এখান থেকে হিমালয়ের বেশ কয়েকটি শৃঙ্গ দেখা যায়। সকালের সূর্য দেখার জন্য পর্যটকরা ছুটে যান এই শহরে। আর যারা আরো একটু রোমাঞ্চ চান তাদের জন্য রয়েছে খরস্রোতা ত্রিশূল নদীতে ভেলায় ভাসার সুযোগ।

ধুলিখেল ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারেন তিব্বতের দিকে। পাহাড়ি পথ, এই পথটাই এনে দিতে পারে জীবনের সেরা রোমাঞ্চ। পথের নিচে খাড়া ঢাল। গিরিখাদ। ওগুলোর ওপর ঘাস এবং গাছ। টুকরো টুকরো উপত্যকার ঘাস গালিচার মতো। ঢালের গাছ দানবের মতো। প্রকান্ড শরীর। পাহাড়ের মতো উঁচু। গাছ আর ঘাসের ওপারে আবার পাহাড়। মনে হতে পারে সবুজ পিঠার টুকরো।

নেপাল পাহাড়ের দেশ, পর্বতের দেশ। তবে সবটাজুড়ে পাহাড় নয়। হিমালয় যেমন আছে, এর পাদদেশে আছে ‘তরাই’ ভূমিও। তরাই ভ’মিতে আছে জলা, তৃণপ্রান্তর এবং সমতল অরণ্য।

নেপালে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু লোকালয়। কাঠমান্ডু থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে এই লোকালয়ের নাম নাগরকোট। একটি সাধারণ গ্রামের বাসিন্দারা যেখানে মাঠ থেকে আকাশ দেখে সেখানে নাগরকোটের বাসিন্দারা নিচে তাকিয়ে আকাশ দেখে। নাগরকোটে দেখা যাবে পাহাড়ি ঝর্ণা নামছে। বাড়ির আঙিনায় মুরগি কক কক করছে। রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে আলু বোখারা।

পেশাদার আরোহীদের জন্য নেপালে আছে আরো একটি আকর্ষণ অন্নপূর্ণা পর্বতসারি। এই সারির সবচাইতে উঁচু চ’ড়ার উচ্চতা ৮০০০ মিটার। পর্বতারোহণে নিয়মিত যারা, অন্নপূর্ণার ডাক তারা এড়াতে পারেন না।

অন্নপূর্ণা দেখতে সাধারণ পর্যটককে যেতে হবে পোখরায়। এখান থেকে ‘অন্নপূর্ণা’ দেখা যায়। পোখরাকে বলা হয় নেপালের ভূস্বর্গ।

এছাড়া ঘুরে আসা যায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনি, চিন্তাফু ট্রেক, পুন হিল ট্রেক থেকে। যেতে পারেন চায়ের রাজ্য ইলমে। এলাকাটি ভারতের দার্জিলিং থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে