তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়াবে যুক্তরাষ্ট্র?


  • মোতালেব জামালী
  • ৩১ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৩৯

আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে উত্তেজনা বাড়ছে। এই উত্তেজনায় রয়েছে দুটি পক্ষ। একদিকে আছে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে আছে চীন ও রাশিয়া। তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যু নিয়ে চীনের সাথে এবং ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈরিতার সম্পর্ক যে কোনো সময় সামরিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কাও করছেন বিশ্লেষকরা। এবং সেই সামরিক সংঘাত শুরু হলে তা বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। আর বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে গেলে তা এক পর্যায়ে পারমাণবিক যুদ্ধেও গড়াতে পারে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন। কারণ, তিন বৃহৎ শক্তিই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী।

সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, পাল্টাপাল্টি পরমাণু বোমা হামলার ফলে এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে পুরো বিশ্বই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। বেশ কিছু ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিরোধ চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট আকাশছোঁয়া। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দেশটির সামরিক ঘাঁটিও অন্য পরাশক্তিগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। বিদেশের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের মোতায়েন করা সেনার সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। দেশটির মিত্রের সংখ্যাও বেশি। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র স্বস্তিতে নেই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈশ্বিক উপস্থিতি ও প্রভাবকে শক্তভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। কেবল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও চীন তার সামরিক উপস্থিতি জোরদার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে বড় একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ করেছে চীন। এটি দেশের বাইরে চীনের একমাত্র নৌঘাঁটি । এই মুহূর্তে রাশিয়া নয়, বরং চীনই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সে কারণেই বাইডেন প্রশাসন চীনের আধিপত্য বিস্তারের পথকে রুদ্ধ করতে চাইছেন। তিনি চীনকে শক্তভাবে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এজন্য তিনি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সেনা ও যুদ্ধাস্ত্র কমিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সব সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত করার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন।

রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বাড়ছে মার্কিন মিত্র ইউক্রেনের হাতছাড়া হওয়া ভূখণ্ড ডোনবাস ও ক্রিমিয়া নিয়ে। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার সাপে-নেউলে সম্পর্ক চলছে অনেক দিন থেকেই। রাশিয়া সমর্থিত বিচিছন্নতাবাদীদের সশস্ত্র তৎপরতার কারণে ডোনবাস ও ক্রিমিয়া অঞ্চল দুটি ইউক্রেন থেকে আলাদা হয়ে গেছে।

রুশ সমর্থিত বিচিছন্নতাবাদীরা ডোনবাস অঞ্চলকে আলাদা প্রজাতন্ত্র হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেছে। ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও একই পথ অনুসরণ করে রুশ সীমান্ত সংলগ্ন এই ভূখণ্ডটিকে ইউক্রেন থেকে অলাদা করে ফেলে। এরপর ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। এমনকি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন প্রয়োজনে ইউক্রেনও দখল করে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

গত এপ্রিলে রাশিয়া সামরিক মহড়ার নামে ইউক্রেন সীমান্তের চারপাশে ব্যাপক সেনা সমাবেশ ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন করে। পুতিন ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করার পর এবারই প্রথম ইউক্রেন সীমান্তে সবচেয়ে বেশি সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেছেন। ক্রিমিয়া ও বিরোধপূর্ণ ডোনবাস অঞ্চলে মোতায়েন করা হয় ট্যাঙ্ক, ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ট্রাক ও ছোট আকারের কামান।

স্যাটেলাইট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবিতে দেখা যায়, ডোনবাসের পূর্বদিকে ভোরোনেজ এবং ক্রাসনোদার প্রদেশে রাশিয়া ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনেছে। রাশিয়ার এমন আগ্রাসী আচরণের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সমর্থনে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে দুটি যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। ফলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সেখানে মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে। দুই পক্ষের মধ্যকার এই উত্তেজনা সামরিক সংঘাতের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধও দিনদিন তীব্র হয়ে উঠছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে শুরু হওয়া চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ এখন আস্তে আস্তে সামরিক সংঘাতের দিকে বাক নিচ্ছে। তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ানকে সমর্থন দিচ্ছে। যুদ্ধ বিমানসহ অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র দিয়ে তাইওয়ানকে শক্তিশালী করে তুলছে। এর ফলে তাইওয়ান চীনের জন্য বড় মথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৯ সালে গৃহযুদ্ধের সময় আলাদা হয়ে যাওয়া তাইওয়ানকে চীন তার একটি বিদ্রোহী প্রদেশ হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। সেজন্য প্রদেশটিকে চীনের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে কমিউনিস্ট দেশটি।

প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারিও। একই সঙ্গে তিনি দেশটির সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনেরও চেয়ারম্যান। ১৯১১ সালে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের ১১০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে গত ৯ অক্টোবর বেইজিংয়ে গ্রেট হলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন তিনি।

ভাষণে শি জিন পিং বলেন, চীনা জাতির দুর্বলতা ও বিশৃঙ্খলা থেকেই তাইওয়ান সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। এখন জাতীয় উদ্যোগেই এই সমস্যার সমধান করা হবে। এবং সেটা অচিরেই বাস্তবে রূপ নেবে। চীনের সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষা হচ্ছে, তাইওয়ান চীনের মূল ভূখণ্ডের সাথে একীভূত হবে।

শি জিন পিং স্বাধীনতা লাভের চেষ্টায় তাইওয়ানের বিচ্ছিন্ন হওয়াকে চীনের পুনরেকত্রীকরণ ও নবজীবন লাভের পথে বড় অন্তরায় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যারা তাদের ঐতিহ্যকে ভুলে যায়, মাতৃভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং দেশকে বিভক্ত করতে চায়, তাদের শেষ পরিণতি কখনও ভালো হয় না। তিনি বলেন, তাইওয়ান প্রসঙ্গ একেবারেই চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে বাইরের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশ অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে পুনরেকত্রিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে।

চীনের নেতারা আশা করছেন, তাইওয়ানের জনগণ পুনরেকত্রীকরণের শান্তিপূর্ণ পথকেই অগ্রাধিকার দেবেন। যদি সেটা না হয়, তাহলে বল প্রয়োগের পথকেও খোলা রাখছেন তারা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানে চীনের যে কোন ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। ফলে তাইওয়ান নিয়ে একটি যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিশ্বের কোনো একটি অঞ্চল সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে তার পরিণতি কী হবে, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবেই অবগত রয়েছে। এ ধরনের সংঘাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। এমনকি তা পারমাণবিক যুদ্ধেও গড়াতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে তা যে সারা বিশ্বের জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে, সে কথা ওয়াশিংটনের অজানা নয়।

বর্তমান সময়ে নানা ধরনের বিধ্বংসী অস্ত্রের সমাহার বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র বিভিন্ন দেশের সমরাস্ত্রের ভান্ডারে মজুদ রয়েছে। এসব পরমাণু অস্ত্র পুরো বিশ্বকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। যদি সামরিক সংঘাত শুরু হয়, তাহলে সেটা বিশ্বের কোনো একটি অঞ্চলে সীমিত থাকবে না। এমনকি কোনো মহাদেশের গণ্ডির মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকবে না। দ্রতই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং বিশ্বের অন্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে। ভয়াবহ যুদ্ধের এই দাবানল পুরো বিশ্বকেই গ্রাস করবে। বর্তমান সময়ের খুবই বৈরী ও সংঘাতময় ভূরাজনীতি দিন দিন আরও বেশি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে এবং একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

১৯৭২ সালের একটি চুক্তির কারণে তাইওয়ান নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সাংহাই কমিউনিক’ নামের ওই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র একথা স্বীকার করে নিয়েছে যে, তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চুক্তিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, তাইওয়ান প্রণালীর দুই পাশে বসবাসরত সব নাগরিকই এক চীন নীতি মেনে চলবেন। ফলে তাইওয়ান প্রশ্নে ১৯৭২ সালের ওই চুক্তি থেকে সরে আসার বা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই।

যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে তার সামরিক শক্তি বাড়ালেও চীনের সাথে যুদ্ধে বা কোনো ধরনের সংঘাতে জড়াবে না বলে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ছাড় দেবে বা ছেড়ে কথা বলবে। বরং স্নায়ু যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে শুরু করা তার স্নায়ু যুদ্ধের কৌশলের অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলের পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। একদিকে তারা ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়াকে সাথে নিয়ে অকাস নামের ত্রিদেশীয় সামরিক জোট গঠন করেছে, তাইওয়ানকে উস্কে দিচ্ছে এবং ভারতকে সমর্থন করছে। চীনের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করছে যে দেশটির সামনে যুদ্ধে জড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকছে না। এই পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক।

তবে নিরাপত্তা ও সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাত এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই ওয়াশিংটন চীনের ওপর নানামুখী চাপ বাড়াচ্ছে। তাইওয়ানকে উস্কে দিয়ে চীনের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করছে। সেটা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা পারমাণবিক যুদ্ধের অভিশাপ থেকে বেঁচে যাবে বিশ্ব। বাইডেন প্রশাসন কোন পথ বেছে নেবে, সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ।