তুরস্ক বদলে দিচ্ছে সৌদি প্রতিরক্ষা খাত

- সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:৩৫

সৌদি আরব নিজেদের ডিজাইনে তৈরি করা একটি চালকবিহীন আকাশযান বা ড্রোন উৎপাদন করে আসছিল। সৌদি ফার্ম ইন্ট্রা ডিফেন্স টেকনোলজিস ‘আসিফ-১’ নামের এই ড্রোনটি ডিজাইন ও উৎপাদনের দায়িত্বে ছিল। কিন্তু এখন থেকে এই ড্রোনটি তুরস্কে উৎপাদন করা হবে। দুই কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী সৌদি কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত লাইসেন্সের অধীনে তুরস্কের প্রতিষ্ঠান এসেন এটি উৎপাদন ও বিক্রি করবে। সম্প্রতি তুরস্কে অনুষ্ঠিত সমরাস্ত্র প্রদর্শনী ‘আইডিইএফ টার্কিশ ডিফেন্স এক্সপো’ চলাকালে সৌদি কোম্পানিটি তাদের অফিসিয়াল টুইটার পেজে এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সৌদি আরবের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ তাদের ভূখণ্ডের বাইরে উৎপাদিত হবে।

তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ক ওঠানামা করেছে সবসময়। কখনো তাদের মধ্যে মৈত্রির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, আবার কখনো আস্থার সংকটে তা শত্রুতায় রূপ নিয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে অর্থনৈতিক অংশিদারিত্বের সম্পর্ক থাকলেও তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল খুবই জটিল ও উত্তপ্ত। অটোমান সাম্রাজ্য বা উসমানিয়া খেলাফতের সময় থেকেই তাদের সাথে সৌদির বৈরী সম্পর্ক শুরু হয়।

সর্বশেষ ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ‘আরব বসন্ত’ নামে শুরু হওয়া গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলনে আঙ্কারার সমর্থন এই অঞ্চলে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে থাকা দেশগুলোর সাথে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। এরপর ২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে দেশটির ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগির হতক্যাণ্ডের পর তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে নেমে আসে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ী করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তবে সেই সম্পর্কে এখন উষ্ণতা ফিরে এসেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে ২০২২ সালের এপ্রিলে সৌদি আরব সফরে যান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এরপর জুন মাসের শেষ দিকে তুরস্ক সফর করেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এই সফরকালে তিনি তুরস্কে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেন। দুই নেতার এই সফরের পর থেকেই তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করে।

গত কয়েক বছর ধরেই পশ্চিমা ও তুর্কি প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে আসছে সৌদি আরবের কাছে। এমনকি সৌদি আরবে কারখানাও স্থাপন করেছে এসব কোম্পানি। গত মাসে তুরস্কের কাছ থেকে ড্রোন কিনতে বড় ধরনের চুক্তি সই করেছে সৌদি আরব। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যখন তার দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন দেশটির ইতিহাসের বৃহত্তম এই সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। গত ১৯ জুলাই সৌদি আরবের বন্দরনগরী জেদ্দায় এই চুক্তি চূড়ান্ত হয়।

পারস্য উপসাগরীয় তিন দেশ সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের প্রথম পর্যায়ে ১৮ জুলাই এরদোয়ান প্রায় ২০০ ব্যবসায়ীর এক শক্তিশালী প্রতিনিধিদল নিয়ে সৌদি আরবের বন্দরনগরী জেদ্দায় পৌঁছেন। এরপর ১৯ জুলাই তুর্কি প্রতিরক্ষা কোম্পানি বাইকারের সাথে সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ড্রোন ক্রয়ের চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। এরদোয়ান এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান এ-সময় উপস্থিত ছিলেন।

পরে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান আল সৌদ এক টুইটার পোস্টে জানান, তার দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে তুরস্কের কাছ থেকে ড্রোন কেনার চুক্তি করা হয়েছে। অন্যদিকে, বাইকারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হালুক বাইরাকতার সৌদি আরবের সাথে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিকে তার দেশের ইতিহাসে ‘সর্ববৃহৎ’ প্রতিরক্ষা ও বিমান রফতানির চুক্তি বলে অভিহিত করেন।

এই চুক্তির আওতায় তুর্কি প্রতিরক্ষা কোম্পানি সৌদি আরবে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি করবে। পাশাপাশি প্রযুক্তি বিনিময় এবং সৌদি আরব মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ এবং সৌদি ন্যাশনাল কোম্পানি ফর মেকানিক্যাল সিস্টেমকে স্থানীয়ভাবে ড্রোন ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে সাহযোগিতা করবে।

বর্তমানে ড্রোন নির্মাণ শিল্পে তুরস্ক বিশ^জুড়ে আলোচিত এক নাম। দেশটির বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোনের চাহিদা এখন আকাশচুম্বি। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ, সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন রনাঙ্গনে ব্যাপক সফল বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন। ইউক্রেনে রাশিয়ান আর্টিলারি সিস্টেম ও সাঁজোয়া যানসহ আধুনিক সমরাস্ত্র ধ্বংস করার পর তুর্কি বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোনটির চাহিদা বেড়ে গেছে বিশ্বজুড়ে।

ড্রোনটির নির্মাতা ইস্তাম্বুলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বাইকার টেকনোলজিসের পরিচালক হালুক বায়রাক্তার বলেন, ড্রোন আধুনিক যুদ্ধে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। যা করবে বলে আশা করা হয়েছিল, বায়রাক্তার তার চেয়েও বেশি কিছু করেছে। ফলে সারা বিশে^র এর চাহিদা বেড়েছে অনেক। তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠান বছরে এ ধরনের ২০০ ড্রোন বানাতে পারে। তিনি বলেন, তাদের এই ড্রোনের চাহিদা এতোটাই বেড়েছে যে, আগামী তিন বছরের মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠান নতুন করে কোনো ড্রোন সরবরাহের অর্ডার নিতে পারবে না।

এখন সৌদি আরবের ডিজাইন করা ড্রোনও তুরস্কে উৎপাদন করা হবে। প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলো সাধারণত যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে তার সম্পূর্ণ বিপরীত সৌদি ড্রোন তুরস্কে উৎপাদনের এই চুক্তি। কেননা, সৌদি কোম্পানি ইন্ট্রা ডিফেন্স টেকনোলজিসকে তাদের ‘আসিফ-১’ ড্রোনের নির্মাণ প্রযুক্তি তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

ইন্ট্রা ডিফেন্স টেকনোলজিসের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট আসিম কুরেশি বলেছেন, সৌদি আরবে প্রথমবারের মতো তৈরি করা ড্রোনটি এখন থেকে লাইসেন্সের মাধ্যমে দেশের বাইরে উৎপাদন করা হবে। এ-ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে তুরস্কের সাথে। ভবিষ্যতে এ-ধরনের চুক্তি আরও হতে পারে বলে জানান আসিম কুরেশি।

তিনি বলেন, ইন্ট্রার অন্যান্য অঞ্চলের অংশীদাররাও এ-ধরনের চুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গত এপ্রিলে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতে ‘আসিফ-২’ ড্রোন দেখানো হয়। এর মাধ্যমে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে সৌদি ড্রোন বিক্রির সুযোগ তৈরি হবে বলে জানান আসিম কুরেশি।

দুবাইভিত্তিক পাবলিক পলিসি রিসার্চ সেন্টার বি-হুথ-এর জেনারেল ডিরেক্টর মোহাম্মদ বাহারুন বলেছেন, তুরস্কের সাথে এই চুক্তির মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সৌদি আরব তার সামরিক সক্ষমতা বাড়ানার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করছে। তিনি আরও বলেন, তুরস্ক-সৌদির এই চুক্তিতে দুই দেশই লাভবান হবে।

সৌদি আরবে প্রথমবারের মতো আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ডিফেন্স শো ২০২২-এ আসিফ-১ ড্রোন প্রথম প্রদর্শন করে এর নির্মাতা কোম্পানি ইন্ট্রা ডিফেন্স টেকনোলজিস। নজরদারি ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তৈরি ফিক্সড ডানার এই ড্রোনটি সোজাসুজিভাবে উড়তে ও অবতরণ করতে পারে। এটির ২৬ কেজি পর্যন্ত ওজন বহনের ক্ষমতা আছে। সহজে বহনযোগ্য এই ড্রোনটি যে কোনো সময় দ্রুততার সাথে একাধিক মিশন পরিচালনার জন্য মোতায়েন করা যায় বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। সাগরে ও নৌবাহিনীর কার্যক্রমে সহায়তার জন্য আসিফ-১ ড্রোনটি খুবই কার্যকর বলে জানান কুরেশি।

দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তিতে কতগুলো ড্রোন উৎপাদন ও বিক্রি করা হবে, সে ব্যাপারে সুনিদিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বরং এটি তুরস্কের কাছে ‘আসিফ-১ ড্রোন উৎপাদন ও বিক্রির জন্য তাদেরকে লাইসেন্স প্রদানের একটি চুক্তি মাত্র। এই চুক্তির অংশ হিসেবে ড্রোনটি উৎপাদনের জন্য ইন্ট্রা ডিফেন্স টেকনোলজিস তুরস্কে কোনো কারখানা করবে না বলেও জানানো হয়। ইন্ট্রার একটি কারখানা আছে রিয়াদে। দেশের বাইরে কারখানা স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে ইন্ট্রার নেই। বরং বিভিন্ন দেশের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ইন্ট্রার ড্রোন সারা বিশে^ই বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ইন্ট্রা ডিফেন্স টেকনোলজিস গত মাসের শেষ দিকে তুরস্কের সি২টেক নামের একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সাথেও পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তুর্কি প্রতিষ্ঠানটি ইন্ট্রা ডিফেন্স-এর উৎপাদিত ড্রোনের সাথে স্যাটেলাটের সমন্বিত সংযোগ স্থাপনের কাজে সহায়তা দেবে। তুরস্কের এসেন ও সি২টেক কোম্পানি দুটির সাথে ইন্ট্রার চুক্তি দুাট সম্পূর্ণ আলাদা। একটির সাথে আরেকটির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তুরস্কের হাত ধরে বিশ্বের ড্রোনের বাজারে আসতে চাইছে সৌদি আরব। আসলে সৌদি আরব যে উচ্চাভিলাষী প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা নিয়েছে, তাতে তুরস্কের অংশগ্রহণ আগামীতে আরও বাড়বে। সৌদি আরব ভবিষ্যতে শুধু অস্ত্র আমদানি নয়, তৈরি ও রফতানির দিকে মনোযোগী হতে চাইছে। এ-ক্ষেত্রে তুরস্কের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সৌদি প্রতিরক্ষা খাতকে বদলে দিতে পারে।