চীনের চেংদু জে-২০ নিয়ে কেন এত আলোচনা

-

  • মেহেদী হাসান
  • ০৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫৮

চীনের চেংদু জে-২০ ফাইটার জেটকে বলা হয় মাইটি ড্রাগন। আকাশে ওড়ার পর থেকে গত এক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সামরিক আর সমরাস্ত্র অঙ্গনে অব্যাহত রয়েছে এ বিমান নিয়ে আলোচনা আর নানা বিতর্ক। আলোচনা আর বিতর্ক চলছে এর শক্তি, ক্ষমতা, সামরিক ও কৌশলগত প্রভাব নিয়ে। এ বিমান নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের রহস্য।

চীন সরকারিভাবে তাদের অনেক সমরাস্ত্রের বিবরণ প্রকাশ করে না। অনেক সমরাস্ত্রের নামও তারা প্রকাশ করে না। এমনকি চেংদু জে-২০ প্রথম আকাশে ওড়ার ৫ বছর পর চীন সরকারিভাবে প্রকাশ করে, তারা এ ধরনের একটি যুদ্ধবিমান বানাতে যাচ্ছে। চেংদু জে-২০-এর পরিচিত মাইটি ড্রাগন হিসেবে।

চীনা মিডিয়ার দাবি চেংদু জে-২০ এর উইপন ক্যাপাসিটি যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ এবং এফ-৩৫ এর চেয়েও বেশি। চেংদু জে-২০ নিয়ে নানা সূত্রে এ ধরনের আরও অনেক চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এসব দাবি আসলে কতটা সত্য, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে চেংদু জে-২০ নিয়ে নানামুখি আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যমের খবর হলো আসলেই চেংদু জে-২০ একটি ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার। আর প্রকৃত অর্থেই এটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এফ-২২ ও এফ-৩৫ এর প্রতিদ্বন্দ্বী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চীনা জে-২০ বিমান নিয়ে এখন যেসব তুলনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় তাতে তারা জে-২০ এর সাথে তুলনা করে বিশ্বের মোস্ট এডভান্সড ফাইটার জেট যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‌্যাপটর, এফ -৩৫, রাশিয়ান এসইউ-৫৭ আর সাথে। এফ-২২ এবং এফ-৩৫ এর পর চেংদু জে-২০ বিশ্বের তৃতীয় অপারেশনাল ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর চীন নিজস্ব তৈরি এ ধরনের শক্তিশালী বিমানের অধিকারী।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ এর মতে চেংদু জে-২০ এর কারনে যুক্তরাষ্ট্র তার শীর্ষ স্থান হারাতে পারে অপারেশনাল স্টেলথ ফাইটার ক্ষেত্রে। সাউথ চায়না মনিটরিং পোস্টের খবর হলো ২০২০ সালের জুলাই মাসে চীন জে-২০ এর নতুন ভার্সন জে-২০বি এর ম্যাস প্রডাকশন শুরু করেছে।

চেংদু জে-২০ প্রথম আকাশে ওড়ে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি। চীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিমান তৈরির তথ্য প্রকাশ করে ২০১৬ সালে। সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০১৭ সালের মার্চে। ২০১৮ সালে তৈরি করা হয় জে-২০ কমব্যাট ইউনিট। চেংদুর ইঞ্জিন সংখ্যা দুটি। হার্ড পয়েন্ট আটটি।

চেংদু জে -২০ এর গতি শব্দের চেয়ে ২ গুন বেশি বা ম্যাক ২। ম্যাক্সিমাম টেক অফ ৩৭ টন। চেংদুর দৈর্ঘ্য ৬৬ ফিট ৮ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৪৪ ফিট ২ ইঞ্চি। শুধু বিমানটির ওজন ১৯ টন ৩৯১ কেজি।

চেংদুর ইন্টারনাল ফুয়েল ক্যাপাসিট ১১ টন ৩৪০ কেজি। ৬৫ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে পারে চেংদু জে-২০। চেংদু জে-২০ এর নির্মাতা চেংদু এরো স্পেস করপোরেশন। এটি নির্মান করা হয়েছে এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটার জেট হিসেবে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন ৫০টি চেংদু জে-২০ বিমান নির্মান করেছে। সব আবহাওয়ায় অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম এ বিমান। এর রয়েছে স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল বহন ক্ষমতা। রয়েছে প্রিসিশন স্ট্রাইক সক্ষমতা।

জে-২০ জঙ্গি বিমান চীনের তৈরি স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘ পাল্লার এয়ার টু এয়ার মিসাইল বহন করতে পারে। এসব মিসাইলের মধ্যে একটি হলো পিএল-২১। এটি একটি একটিভ রাডার গাইডেড মিসাইল। এটি ইউরোপের এমবিডিএ তৈরি মেটিওর, রাশিয়ার আর-৭৭, যুক্তরাষ্ট্রের এআইএম-১২০ আমরাম এবং ডারপা ট্রিপল থ্রেট থার্মিনেটর এয়ার টু এয়ার মিসাইলের সমান শক্তি সম্পন্ন।

চেংদুর আরেকটি এয়ার টু এয়ার মিসাইল হলো চীনের তৈরি পিএল-১৫। এ মিসাইলের গতি শব্দের চেয়ে ৪ গুন বেশি বা ম্যাক-৪। এর আওতা ৪০০ কিলোমিটার । তার মানে জে-২০ বিমান আকাশে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমন পরিচালনা এবং প্রতিহত করতে পারে। জে-২০ চারটি পিএল-১৫ বোমা বহন করতে পারে।

চেংদুতে বহনযোগ্য আরেকটি এয়ার টু এয়ার মিসাইলের নাম পিএল১২। এটিও রাশিয়ার আর-৭৭, যুক্তরাষ্ট্রের এআইএম-১২০ আমরাম এর সমান ক্ষমতাসম্পন্ন রাডার গাইডেড মিসাইল। এ ছাড়া চেংদু জে-২০ বহন করতে পারে চীনা তৈরি এলএস পিসিশন গাইডেড বোমা।

জে-২০ ছাড়া চীনের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের আরেকটি যুদ্ধবিমান হলো চেংদু জে-৩১ । এটিও একটি স্টেলথ ফাইটার।

এ ছাড়া চীনের কাছে রয়েছে তাদের নিজস্ব তৈরি ফোর্থ জেনারেশন বহুমুখী যুদ্ধবিমান চেংদু জে-১৭। চীন নির্মান করছে চেংদু জে সিরিজের আরো অনেক বিমান। এর মধ্যে দুটি হলো চেংদু জে ৭ এবং চেংদু জে-১০ মাল্টিরোল ফাইটার জেট।

২০২০ সালের ২৯ জুলাই ভারতের আম্বালা এয়ার স্টেশনে অবতরণ করে ফ্রান্সের তৈরি ৫টি রেফালে যুদ্ধবিমান। তখন ভারতীয় গণমাধ্যমে আরেকবার বিতর্কের শিকার হয় চেংদু জে-২০। ফ্রান্সের কাছ থেকে পাওয়া রেফালে যুদ্ধবিমান নিয়ে ব্যাপক মাত্রায় উচ্ছসিত ভারত। ফোর প্লাস জেনারেশনের এ যুদ্ধবিমান নিয়ে তখন উচ্ছ্বাস চলে ভারতীয় গণমাধ্যমে । ভারতের গণমাধ্যমের দাবি রেফালে যুদ্ধবিমান লাভের পর ভারতের বিমান বাহিনী এখন চীনা বিমান বাহিনীর চেয়েও অনেক শক্তিশালী । পাকিস্তান তো আর কোনো তুলনায়ই আসছে না।

দীর্ঘকাল ধরে ভারতের বিমান বাহিনীর দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনা চলছে । দীর্ঘ ২৩ বছর পর ভারতীয় বিমান বাহিনী এমন শক্তিশালী যুদ্ধবিমানের অধিকারী হয় চীর প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান আর চীনের মোকাবেলায়। এ অবস্থায় ফ্রান্সের শক্তিশালী ফোর প্লাস যুদ্ধবিমানের অধকারী হওয়াকে ভারতের জন্য গেম চেঞ্জার হিসেবে অভিহিত করা হয়। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে শুরু হয় রেফালে যুদ্ধবিমান বন্দনা। রেফালের শক্তি সামর্থ্য নিয়ে প্রকাশ করা হয় ব্যাপকভিত্তিক রিপোর্ট।

রেফালের সাথে তুলনা করা হয় চীনের চেংদু জে-২০, চীন ও পাকিস্তানের কাছে থাকা জে-১৭ এবং পাকিস্তানের এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের শক্তি ও সামর্থ্যর সাথে। চেংদু জে-২০ সম্পর্কে প্রকাশ করে অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য । যেমন কলকাতার আনন্দ বাজারের প্রতিবেদনে বলা হয় চেংদু জে-২০ এর ইঞ্জিন সংখ্যা ১টি।

বাস্তবতা হচ্ছে চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমান হলো তাদের নিজেদের তৈরি ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার চেংদু জে-২০। ভারতের গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলের দাবি রেফালে যুদ্ধবিমান চেংদু জে-২০ এর তুলনায় অনেক শক্তিশালী। আর জে -২০ যুদ্ধবিমানের শক্তি সামর্থ্য বিষয়ে চীনের দাবিও অসত্য প্রমাণের চেষ্টা করে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম। ভারতের গণমাধ্যমে বলা হয় চেংদু জে-২০ আসলে প্রকৃত স্টেলথ ফাইটার নয়। আনন্দবাজারের দাবি ভারতের এসইউ-৩০ এম বিমানের রাডারে কয়েক বার ধরা পড়েছে জে-২০ এবং সে কারনে এটি পুরোপুরি স্টেলথ ফাইটার নয়।

ভারতীয় গণমাধ্যম চেষ্টা করে ফিফথ জেনারেশন চীনা জে-২০ কে ফোর প্লাস জেনারেশন রেফালের চেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন প্রমাণের।