যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একাট্টা চীন ও রাশিয়া


  • মোতালেব জামালী
  • ২৯ মার্চ ২০২১, ০৯:০৫

স্নায়ুযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল চীন ও রাশিয়া। এ সময় তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানের কারণে বর্তমানে দেশ দুটি কাছাকাছি এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন ও রাশিয়ার চীনের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে নানা ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বর্তমানে সামরিক, প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও দুই দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

সম্প্রতি চীন এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে রাশিয়া ও চীন। পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করবে বলে দেশ দুটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার কঠোর সমালেচনা করছে। এ ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর মস্কো ও বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে ঐক্যের এ ঘোষণা দেওয়া হলো।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ চীন সফরকালে দেশটির দক্ষিনাঞ্চলীয় নগরী নানিয়াং এ চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই এর সাথে সাথে বৈঠক করেন। পরদিন সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা দেন। উভয় নেতা বলেন, পশ্চিমাদের একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরুদ্ধে সব দেশেরই রুখে দাঁড়ানো উচিত।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের বিষয়ে অহেতুক নাক গলিয়ে থাকে। দুই পররাষ্ট্র মন্ত্রী তাদের দেশের কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা বলেন, চীন ও রাশিয়া জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবেলা সহ নানা বৈশ্বিক ইস্যুতে বিশ্বকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে একসাথে কাজ করে যাচ্ছে। ল্যাভরভ ও ওয়াং ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরে আসারও আহবান জানান। ইরানের সাথে চীন ও রাশিয়ার রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

ক্রেমলিন বলছে রাশিয়া বলছে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রত্যাশী। তবে ওয়াশিংটনের সাথে সবচেয়ে খারাপ সম্পর্কের জন্যও মস্কোর পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তার মার্কিন প্রতিপক্ষ জো বাইডেনের সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছেন। বাইডেন যখনই উপযুক্ত মনে করবেন তখনই এ আলোচনা হতে পারে।

পুতিন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রকাশ্য আলোচনার যে প্রস্তাব দিয়েছেন ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে তার জবাব না দেয়াকে ক্রেমলিন প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বলে মনে করছে। এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন রুশ প্রেসিডেন্টর সমালোচনা করতে গিয়ে তাকে ‘খুনি’ বলায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে। বাইডেন হুমকি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্টের ২০২০ সালের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার জন্য ভøাদিমির পুতিনকে ‘মূল্য দিতে হবে’।

রাশিয়ার সাথে এমন তিক্ত সর্ম্পকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার অ্যাংকোরেজ শহরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দুদেশের মধ্যে এই বৈঠক হয়। এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। চীনের পক্ষে আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সিনিয়র কর্মকর্তা ইয়াং জিয়েচি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।

সেখানে দু’পক্ষই পরস্পরকে তীব্র ভাষায় আক্রমন করে কথা বলেছে। বৈঠকে চীনা কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তারা চীনের ওপর আক্রমণ চালাতে অন্য দেশগুলোকে উস্কানি দিচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা অভিযোগ করেছে যে, চীন যা কিছুই করছে তা লোক-দেখানো। জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের সাথে চীন যে ব্যবহার করছে, সে বিষয় গুলে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় তোলার চেষ্টা করে।

আলোচনার শুরুতেই উদ্বোধনী বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন বলেন, ‘চীনের বিভিন্ন পদক্ষেপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র তার গভীর উদ্বেগ এই আলোচনায় আনবে। বিশেষ করে জিনজিয়াং, হংকং, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্রে সাইবার হামলা ও মার্কিন মিত্রদের ওপর চীনের অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের বিষয়গুলো উত্থাপন করবে।

এর জবাবে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই অভিযোগ করেন যে, অন্য দেশকে দমিয়ে রাখতে ওয়াশিংটন তার সামরিক পরাক্রম এবং অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। তিনি বলেন, নিরাপত্তার তথাকথিত ধারণার অপব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক বাণিজ্যিক লেন-দেন করছে এবং কিছু দেশকে উস্কানি দিচ্ছে চীনের ওপর হামলা করার জন্য। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকারের অবস্থা এখন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করা হচ্ছে।

গোটা বিশ্বের গণমাধ্যমের সামনে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের কর্মকর্তাদের এই উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলেছে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। বিবিসির সংবাদদাতা বারবারা প্লেট-আশারের ভাষায় এটি ‘অস্বাভাবিক রকমের এক অ-কূটনৈতিক বিবাদ।’ আর এটি ঘটেছে এমন এক বৈঠকে যেখানে কি-না এক নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের আমলে দুই পক্ষের সম্পর্ক নতুন করে ঝালাই করার কথা। এই বৈঠকের পর সর্ম্পকের উন্নতির চেয়ে অবনতির দিকে যাচ্ছে।

চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এরমধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও সুইডেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। এই নিষেধাজ্ঞাকে একটি সমন্বিত উদ্যেগ হিসাবে দেখা হচ্ছে।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, জিনজিয়াং প্রদেশের বন্দীশিবিরগুলোয় লাখ লাখ উইঘুরকে আটকে রেখেছে চীন। এসব শিবিরে বন্দীদের ওপর নির্যাতন, জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে কাজ করানো ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে। চীন এগুলোকে ‘সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে পরিচালিত পুনঃশিক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।

ইইউ’র পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা চীনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন- তাতে চারজন ব্যক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ করা ও তাদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে জিনজিয়াং-এর পুলিশ প্রধানও রয়েছেন। এর পরপরই চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দশজন ব্যক্তি ও চারটি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

নিষেধাজ্ঞার জের ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে এই জোটের অনেক সদস্য দেশ। ইইউ ভূক্ত দেশগুলোর ওপর বেইজিং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর ইইউ এ পদক্ষেপ গ্রহন করে। এ পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানাতে চীনও ইইউ ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে।

মানবাধিকার ইস্যুতে চীন এবং ইইউ পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তাইওয়ান ও হংকং নিয়েও দু পক্ষের মধ্যে ব্যাপক টানাপড়েন রয়েছে। ফ্রান্সের কয়েকজন সংসদ সদস্য শিগগিরি তাইওয়ান সফরে গিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভাব্য এই বৈঠকের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে সতর্ক করে দিয়েছে চীন। কিন্তু এমন নিষেধাজ্ঞার কী ধরনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব পড়বে আসুন জেনে নেই।

জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লংঘনের কারণে চীনের উপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিত আরো বেড়ে যাবে। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করবে। বিশেষ করে রাশিয়া, ইরান ও ভেনিজুয়েলাসহ যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী দেশগুলো এ জোট হয়ে যাবে। এছাড়া ইউরোপের দেশগুলোতে ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা করবে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে রয়েছে চীনের বিপুল বিনিয়োগ। এমনকি তুরস্কের সাথেও চীন অর্থনৈতিক সর্ম্পক জোরদার করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরমধ্যে তুরস্ক সফর করেছেন। আবার তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন চলছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীন যেহেতু একটি শক্তিশালী দেশ, সে কারণে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশটির সরকারের যেমন কোন পরিবর্তন হবেনা তেমনি ভাবে এর প্রভাবে বিরাজমান নীতিরও কোন পরিবর্তন আসবেনা। নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে কোন দেশের সরকারের পতন ঘটেছে বা পরিবর্তন হয়েছে এমন নজির খুবই কম।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও দেশটির অর্থ দফতরের সাবেক কর্মকর্তা গ্যারি হাফবাউয়ার মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীনের তেমন কোন ক্ষতি করতে পারবেনা যুক্তরাষ্ট্র। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং খুবই শক্তিশালী একজন নেতা এবং তা কোন প্রতিদ্বন্দ্বিও নেই দেশটিতে। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কতটুকু ফলপ্রসু হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন গ্যারি হাফবাউয়ার। তিনি বলেন চীনের মতো রাশিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন এবং তার অবস্থানও খবই শক্তিশালী। ফলে চীন ও রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপীয় মিত্রদের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার খুব একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।