তুর্কি অ্যাটাক হেলিকপ্টার পাচ্ছে পাকিস্তান


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৩ মার্চ ২০২১, ০৭:৪৮

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই তুরস্কের তৈরি আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টারের জন্য অপেক্ষা করছিল। ইসলামাবাদের সেই অপেক্ষার দিন শেষ হয়ে আসছে। পাকিস্তান বর্তমানে তুরস্কের সাথে টি-হান্ড্রেড টুয়েন্টি নাইন অ্যাটাক হেলিকপ্টার পেতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে দুদেশের মধ্যকার এ চুক্তি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা সম্প্রতি দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগের ভার্চুয়াল আন্তর্জাতিক মিলিটারি হেলিকপ্টার কনফারেন্সে বক্তব্য দিতে গিয়ে জানান, তুরস্কের সাথে প্রত্যাশিত চুক্তিটি বিলম্বিত হচ্ছে, কারণ তৃতীয় একটি মহলের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। তুরস্কের সাথে পাকিস্তান ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিল ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। যুক্তরাষ্ট্র এই হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনগুলোর রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার পর এই প্রক্রিয়াটি থেমে গিয়েছিল।

অ্যাটাক টি-হান্ড্রেড টুয়েন্টি নাইন নামের এ হেলিকপ্টারটি দুটি টি-এইট হান্ড্রেড ফোর এ ইঞ্জিন দিয়ে পরিচালিত হয়, যা এলএইচটেক নির্মাণ করেছিল। আমেরিকান প্রতিষ্ঠান হানিওয়েল এবং ব্রিটিশ কোম্পানী রোলস রয়েস মিলে যৌথভাবে এই ইঞ্জিনগুলো তৈরি করেছে।

তুরস্ক ও পাকিস্তানকে কোনঠাসা রাখতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ লম্বা সময় এলএইচটেক ইঞ্জিনের রফতানিতে ছাড়পত্র দিতে রাজি হয়নি। আংকারা রাশিয়ার এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল সিস্টেমকে ক্রয় করার পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এর প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে তখন থেকেই এফÑথার্টি ফাইভ, এফ-সিক্সটিন আপগ্রেড কিটস এবং টি-হান্ড্রেড টুয়েন্টি নাইন ইঞ্জিনগুলোর রফতানি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়।

তুরস্ক এ কারণে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় জটিলতায় পড়ে যায়। তুরস্কের এই সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে পাকিস্তান তুরস্কের এই ইঞ্জিন পাওয়ার মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে করে দেয়। পাশাপাশি পাকিস্তান বিকল্প চিন্তাও করছে। যদি কোনো কারণে তুরস্ক শেষ পর্যন্ত টি-হান্ড্রেড টুয়েন্টি নাইন অ্যাটাক হেলিকপ্টার দিতে না পারে তাহলে পাকিস্তান বিকল্প হিসেবে চীন নির্মিত জেড-টের এ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার পরিকল্পনা করছে।

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পখাতের আন্ডার সেক্রেটারী ইসমাইল দেমির জানিয়েছেন, পাকিস্তান তুরস্ককে এই এ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলো দেয়ার সময় এক বছর বৃদ্ধি করেছে। এই সময়ের মধ্যে অন্য পরাশক্তিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেরাই টি-হান্ড্রেড টুয়েন্টি নাইনের জন্য ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম হবে। তিনি জানান এক বছর পরে তুরস্ক ইঞ্জিন প্রকল্পকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাবে যা দেখে পাকিস্তান সন্তুষ্ট হবে। অথবা যদি এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র রফতানি লাইসেন্স ফিরিয়ে দেয় তাহলে তাহলে তাদের ইঞ্জিন দিয়েও কাজটি চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হবে।

গত বছরের আগস্ট মাসে আংকারা ওয়াশিংটন ভিত্তিক একটি ফার্মকে রফতানি লাইসেন্সটি পুনর্বহালের জন্য লবিং করতে নিয়োগ দেয়। পাকিস্তানের কাছে হেলিকপ্টার বিক্রির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় এই লবিস্ট ফার্মকে নিয়োগ করা হয়।

এর আগে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট পাকিস্তানের কাছে সম্ভাব্য সামরিক অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে অনুমোদন দেয়। এ অনুমোদনটি দেয়া হয়েছিল যাতে যুক্তরাষ্ট্র ১৫টি এ এইচ-ওয়ানজেড ভাইপার, হেলফায়ার মিসাইল, আনুষাঙ্গিক অন্যন্য সমরাস্ত্রসহ ৯৫২ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করতে পারে। এই প্রক্রিয়ার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান ৯টি এ এইচ-ওয়ানজেড ভাইপার সংগ্রহ করেছে।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে ইসলামাবাদের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হলে এই ক্রয় আদেশ স্থগিত করা হয়। ভারতের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠাও এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনকে প্রভাবিত করেছে। পাকিস্তানকে ১২টি এয়ারক্রাফট দেয়ার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এরই মধ্যে ৯টি এয়ারক্রাফট নির্মাণও সম্পন্ন হয়েছে। অথচ পাকিস্তানকে সরবরাহ করতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা অনীহা প্রকাশ করায় এখন এই ৯টি এয়ারক্রাফট এরিজোনার আমার্গ বেইজে মজুদ রাখা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাহিদামতো সমরাস্ত্র না পাওয়ায় পাকিস্তান তুরস্কের কাছ থেকে টি-হান্ড্রেড টুয়েন্টি নাইন অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার বিষয়ে আগ্রহী হয়। পাকিস্তানি নীতি নির্ধারকরা আশা করছেন, সকল বাঁধা বিপত্তির অবসান ঘটিয়ে তুরস্কের কাছ থেকেই তারা শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারটি ক্রয় করতে পারবেন।

তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত এই হেলিকপ্টার টি-হান্ড্রেড টুয়েন্টি নাইন অ্যাটাক হেলিকপ্টার দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট হেলিকপ্টার। এর আসনগুলো উন্নত এবং সকল আবহাওয়ায় এই হেলিকপ্টারগুলো বহুমাত্রিক ভূমিকা রাখতেও সক্ষম। টি-হান্ড্রেড টোয়েন্টি নাইন হেলিকপ্টারটি তারকিশ এরোস্পেস ইন্ড্রাস্ট্রিজ এবং অগাস্তা ওয়েস্টল্যান্ড মিলে যৌথভাবে নির্মাণ করেছে। এই হেলিকপ্টারগুলোকে এডভান্সড এ্যাটাক এবং শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানকে সংহত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই সাথে পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং দিনে ও রাতে এই হেলিকপ্টার সমানভাবে কাজ করতে পারে।

তুরস্ক সেনাবাহিনীর কাছে আক্রমণ ও ট্যাকটিকাল হেলিকপ্টার নির্মাণের প্রয়োজন হয়েছিল। টি-হান্ড্রেড টোয়েন্টি নাইন হলো সেই কাংখিত হেলিকপ্টার, যা তুরস্কের উন্নত এভিওনিকস, এয়ারফ্রেমের উন্নত সংস্করণ, এবং উইপন সিস্টেমকে অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের এ-হান্ড্রেড টোয়েন্টি এয়ার ফ্রেমের সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

হেলিকপ্টারটিতে উন্নত ইঞ্জিন, ট্রান্সমিশন এবং ধারালো ব্লেডও লাগানো হয়েছে। তুরস্ক সেনাবাহিনীই শুধু নয়, বরং অন্যান্য সেবামূলক সংস্থাও এই হেলিকপ্টারগুলো ব্যবহার করছে। পাকিস্তানের মতো ফিলিপাইনও তুরস্কের এই হেলিকপ্টারটিকে পাওয়ার বিষয়ে তুমুল আগ্রহের কথা জানিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইঞ্জিন রফতানি বিষয়ক জটিলতার সুরাহা না হওয়ায় ফিলিপাইন আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো অর্ডার দেয়নি।

তুরস্ক শুধু অ্যাটাক হেলিকপ্টার যুদ্ধ বিমান নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক এফ থার্টি ফাইভ স্টেলথ বিমানের মোহতে না ভুগে ওয়াইএস এফ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে। তুরস্কে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার ডমিনিক চিলকট জানিয়েছেন, বিএই সিস্টেমের সাথে মিলে তুরস্ক যেভাবে এ যুদ্ধবিমান নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে তাতে তিনি খুবই সন্তুষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সামরিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর অবরোধ আরোপ করায় তুরস্ক বিমানের ইঞ্জিন আমদানি নিয়ে শংকায় ছিলো। সে আশংকাকে গুড়িয়ে দিয়ে চিলকট জানিয়েছেন, রোলস রয়েস কোম্পানী তুরস্কের নির্মিতব্য পঞ্চম প্রজন্মের বিমানেও ইঞ্জিন সরবরাহ করবে।

রোলস রয়েস এরই মধ্যে পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের জন্য নতুন করে ইঞ্জিনের নকশা প্রনয়ণ শুরু করে দিয়েছে। খুব শীঘ্রই তারা এই ইঞ্জিনটি তৈরি করে তুরস্ককে দিতে পারবে বলেও চিলকট আশা ব্যক্ত করেন। বৃটেন ও তুরস্ক শুধু এই টিএফ-এক্স এফ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান নয়, বরং দ্বিতীয় পর্যায়ে আরেকটি যৌথ প্রকল্পও খুব শীঘ্রই শুরু করতে যাচ্ছে। যেখানে নতুন করে অনেকগুলো প্রোটোটাইপ বিমান নির্মাণ করা হবে। বৃটেন ও তুরস্ক এরই মধ্যে এ বিষয়ে চুক্তিও সাক্ষর করেছে।

অ্যাটাক হেলিকপ্টারটি রফতানি শুরু হওয়ার পর ভবিষ্যতে তুরস্ক যুদ্ধ বিমান নির্মাণের দিকে মনোযোগি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনিবার্যভাবে তুরস্কের মিত্র দেশগুলো এসব সমরাস্ত্রের প্রধান ক্রেতা হিসাবে সামনে চলে আসবে।