যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স থেকে বিপুল সমরাস্ত্র কিনছে ইন্দোনেশিয়া


  • মেহেদী হাসান
  • ০১ মার্চ ২০২১, ০৯:০০

যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয় থেকে পিছিয়ে এসেছে ইন্দোনেশিয়া। রাশিয়ার পরিবর্তে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্ধশতাধিক যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া।

৫ বছর গবেষণার পর এয়ারবর্ন লেজার অস্ত্র উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধবিমানে বসানো হবে এ লেজার অস্ত্র, যা ইনকামিং মিসাইল প্রতিহত করবে। এয়ারবর্ন লেজার সিস্টেম যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। অপরদিকে ড্রোন হামলা থেকে রক্ষা পেতে নতুন মাইক্রোওয়েভ অস্ত্রও উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক ঘাঁটিসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় ড্রোন হামলা প্রতিরোধ করবে নতুন উদ্ভাবিত অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম।

যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপের কারণে রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয় থেকে পিছিয়ে এসেছে ইন্দোনেশিয়া। রাশিয়ার কাছ থেকে এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান ক্রয় করতে চেয়েছিল দেশটি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা ত্যাগ করেছে। এর পরিবর্তে ইন্দোনেশিয়া ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৫০টিরও অধিক যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে এটা হবে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রয় চুক্তি।

ইন্দোনেশিয়া ফ্রান্স থেকে ৩৬টি রেফালে যুদ্ধবিমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং থেকে ৮টি এফ-১৫ ইএক্স ফাইটার জেট ক্রয় করবে। আগামী তিন বছরে ইন্দোনেশিয়া এসব বিমান সংগ্রহ করবে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন থেকে তিনটি সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস পরিবহন বিমান. তিনটি এয়ারবাস এ৩৩০ এরিয়েল রিফুয়েলিং, ৬টি এমকিউ-১ প্রিডেটর ড্রোন এবং ইতালির লিওনার্দো থেকে আর্লি ওয়ানির্ং রাডার সিস্টেম সংগ্রহ করবে। ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যত ক্রয় তালিকায় এসব বিমানের নাম রয়েছে।

শুধু যুদ্ধবিমান ক্রয়ের জন্য ব্যয় হবে ১১ বিলিয়ন ডলার। ঋনগ্রস্ত ইন্দোনেশিয়ার এ বিপুল পরিমান অস্ত্র ক্রয় নিয়ে গুরুতর সমালোচনা চলছে দেশে ও দেশের বাইরে। ইন্দোনেশিয়া অনেক আগে থেকে সমরাস্ত্র শিল্পে স্বয়ংস্পূর্ণ হওয়ার দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্লান গ্রহন করেছে। বর্তমান এ অস্ত্র ক্রয় পরিকল্পনা এ নীতির বিরোধী হিসেবে আবির্ভূূত হয়েছে। তা ছাড়া স্বাধীনভাবে অস্ত্র ক্রয় করতে না পারা নিয়েও সমালোচনা চলছে।

অনেক দিন থেকে রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় না করার বিষয়ে ইন্দোনেশিয়াকে হুমকি দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার করল ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১১টি এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঝুকি এড়াতে সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত পরিত্যাগের ঘোষণা দেয়।

ইন্দোনেশিয়ার কাছে বর্তমানে ১৬টি রাশিয়ার এসইউ-২৭ এবং এসইউ-৩০ বিমান রয়েছে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ জঙ্গি বিমানও রয়েছে। দক্ষিন চীন সাগরের কাছে ইন্দোনেশিয়া মোতায়েন করে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান। নতুনা আইল্যান্ডের উত্তরে ইন্দোনেশিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে চীনা দাবি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

২০১৯ সাল নাগাদ ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাজেট ২০ ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য মাত্রা ধারা হয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে শসস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নে।

রাশিয়ার ক্রিমিয়া অভিযানের জবাবে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় বিষয়ে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আইন পাস করে।

ফ্রান্সের রেফালে যুদ্ধবিমান বর্তমানে মিশর, কাতার এবং ভারতের কাছে রয়েছে। এটি পঞ্চম প্রজন্মের কাছাকাছি বহুমুখী যুদ্ধবিমান। এতে রয়েছে এয়ার টু এয়ার এবং এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল সিস্টেম। এর সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ২ হাজার ২শ কিলোমিটার। এয়ার সুপেরিয়রিটি, ইন্টারডিকশন, গ্রাউন্ড এটাক এবং এন্টি শিপ ভূমিকায় ব্যবহার করা যায় রেফালে যুদ্ধবিমান।

ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তার অর্ডার দিলে ডেলিভারি পেতে ১০ বছর পার হয়ে যেতে পারে। কারণ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন ক্রেতার দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। এ কারণে ইন্দোনেশিয়া এফ-৩৫ সংগ্রহস পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।

পাঁচ বছর গবেষণার পর এয়ারবর্ন লেজার অস্ত্র উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধবিমানে বসানো হবে এ লেজার অস্ত্র যা ইনকামিং মিসাইল প্রতিহত করতে পারবে। এয়ারবর্ন লেজার সিস্টেম যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকডিহ মার্টিন, নরথ্রপ গ্রুম্যান এবং বোয়িং যৌথভাবে গত ৫ বছর ধরে নিয়োজিত রয়েছে এ অস্ত্র উদ্ভাবনের কাজে । ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই এ কাজে সমাপ্তি টানার কথা রয়েছে। এর পর শুরু হবে এর উৎপাদন পর্যায়। ডিজাইন এবং লেজার নির্মানের জন্য লকহিড মার্টিনের সাথে ২৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র আর্মি।

এয়ারফোর্স রিসার্স ল্যাবরেটরি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই লেজার অস্ত্রের একটি সাব সিস্টেম পাওয়ার কথা। ২০২৪ সালের মধ্যে এর পরীক্ষা চালানোর কথা রয়েছে। ২০২১ সালের জুন মাসে লেজার অস্ত্রের ফুল সিস্টেম পরীক্ষা চালানোর কথা থাকলেও ফ্লাইট টেস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
এয়ারফোর্স রিসার্স ল্যাবরেটরির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ইতোমধ্যে একটি এফ-১৫ যুদ্ধবিমানে লেজার টেস্ট পড বসানো হয়েছে সফলভাবে। অপর দিকে গ্রাউন্ড বেজড লেজার অস্ত্রের মাধ্যমে বিমান থেকে নিক্ষেপ করা মিসাইল ভূপাতিত করা হয়েছে।

এয়ারফোর্স রিসার্স ল্যাবরেটরি ডাইরেক্টেড এনার্জি অধিদপ্তরের পরিচালক কেলি হ্যামেট বলেন, এসব পরীক্ষায় এটা প্রমানিত যে, আমাদের ডাইরেক্টেড এনার্জি সিস্টেম সঠিক পথে এগুচ্ছে এবং এটা যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করবে।

ড্রোন হামলা প্রতিরোধে নতুন মাইক্রোওয়েভ অস্ত্র উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর নাম থর। শীঘ্রই এর পরীক্ষা চালানো হবে। নিউ ম্যাক্সিকো কার্টল্যান্ড বিমান ঘাটিতে প্রদর্শন করার পর এর ফিল্ড টেস্ট করা হবে। মাইক্রোওয়েভ থর ফ্লাশ লাইটের মত কাজ করে। ওয়েভের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া লাইট ইলেকট্রোম্যাগনেটিক কোনের আওতায় থাকা যে কোনো কিছুকে অকার্যকর করে দেয়। এ পদ্ধতি উড়ে আসা ড্রোনের মধ্যকার ইলেকট্রনিক সিস্টেম অচল হয়ে যাবে। ২০ ফিট দীর্ঘ একটি শিপিং কনটেইনারে রাখা এবং সামরিক পরিবহন বিমানে পরিবহন করা যায়। দুই জন লোক এটি এসেম্বল করতে পারে।

ড্রোন হামলা থেকে সামরিক ঘাটি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র মোতায়েন করবে নতুন উদ্ভাবিত এন্টি ড্রোন মাইক্রোওয়েভ অস্ত্র। এর নাম থর বা টেকনিক্যাল হাই পাওয়ার অপারেশনাল রেসপন্ডার। এক সাথে ঝাকে ঝাকে উড়ে আসা ড্রোন হামলা প্রতিরোধে সক্ষম এন্টি ড্রোন মাইক্রোওয়েভ থর। ২০২৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ঘাটিতে এন্টি ড্রোন অস্ত্র মোতয়েনের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রে।

সম্প্রতি ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ঘাটিতে রকেট হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয় যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরবেও তেল ক্ষেত্রে হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয় যুক্তরাষ্ট্রের মোতায়েন করা প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান ঘাটিতে ড্রোন হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়ার উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চিন্তিত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সামরিক ড্রোনসহ ক্ষুদ্র বানিজ্যিক ড্রোন নিয়ে। কার্যকর এন্টি ড্রোন সিস্টেম উদ্ভাবনের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

আর্মি লে. জেনারেল নেল থারগুড জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য এবং সামরিক অবকাঠামো রক্ষায় মাইক্রোওয়েভ এবং লেজার অস্ত্রে বিনিয়োগ একটি ভাল পদক্ষেপ। দিন দিন এ সমস্যা বাড়ছিল এবং এ খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এ সমস্যাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হাই-এনার্জি লেজার একটি লক্ষ্য বস্তুকে ধ্বংস করতে পারে। অপর দিকে হাই-পাওয়ার্ড মাইক্রোওয়েভ একসাথে অনেকগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। বর্তমানে এ দুটি প্রযুক্তির সমন্বয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এন্টি ড্রোন থর উদ্ভাবন করেছে এয়ার ফোর্স রিসার্স ল্যাবরেটরিস ডাইরেক্টেড এনার্জি ডাইরেক্টোরেট। এতে খরচ হয়েছে ১৫ মিলিয়ন ডলার।