নৌবাহিনী নিয়ে চীনের মহাপরিকল্পনা


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:১৫

নৌবাহিনীর পরিসর বৃদ্ধিতে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে চীন। আগামী এক দশকে দেশটির নৌবহরে যুক্ত হবে আরও অনেক যুদ্ধজাহাজ। বিমানবাহী রণতরী থেকে শুরু করে ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেটসহ সব ধরনের সামরিক নৌযানই থাকবে এর মধ্যে। এখন চীনের যুদ্ধজাহাজ অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। তারপরও কেন দেশটি এত যুদ্ধজাহাজ বানাতে চাচ্ছে?

চীনের উচ্চাভিলাষী সামরিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নতুন যুদ্ধজাহাজগুলো যোগ হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আগামী দশকে চীনের সামরিক নৌবহরের আকার এত বড় হবে, যা সাধারণত অনেক নৌবাহিনী কল্পনাও করে না। অনেকদিন ধরেই এই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে চীন। যার অংশ হিসেবে শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই তারা সমুদ্রে নামিয়েছে নতুন দুই ডজন সামরিক নৌযান। করভেট, ডেস্ট্রয়ার থেকে ভাসমান ডক- কী নেই সেই তালিকায়। এবং এমন আরও অনেক নৌযান বানানোর প্রক্রিয়া চলছে দেশটিতে।

অনেকদিন ধরেই চীন তার সামরিক জাহাজের বহর বড় করার কাজ শুরু করেছে। এর বড় একটি কারণ দ্রুতই চীনের বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার একেকটি নৌবহরের নেতৃত্ব দেয়। এই বিমানবাহী রণতরীগুলোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা খুব একটা শক্তিশালী নয়। যে কারণে জাহাজটির চারপাশে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে গাইডেড মিসাইল ক্রুজার, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, ও গাইডেড মিসাইল ফিগ্রেট। পানির নিচের আক্রমণ রোধে থাকে একটি বা দুটি অ্যাটাক সাবমেরিন। আর থাকে একটি সাপ্লাই শিপ। মোট কথা পূর্ণাঙ্গ একটি নৌবহরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এই রণতরীগুলো। অফিশিয়ালি যেটিকে বলা হয় ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ। এর প্রতিটি বহরে থাকে অন্তত ৬টি জাহাজ।

কাজেই চীনের বিমানবাহী রণতরীর সংখা যেহেতু বাড়ছে, তাই তাদের প্রতিটি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের জন্য দরকার আরো জাহাজ। এছাড়া বিশ^ব্যাপী চীনা স্বার্থের সুরক্ষার জন্যও নৌ বাহিনীকে আরো প্রসারিত করার চিন্তা করছে বেইজিং। মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের পাইপলাইন কিংবা বিরোধপূর্ণ- দক্ষিণ চীন সাগর, সবখানেই চীনের প্রয়োজন সামরিক উপস্থিতি। আর এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই চীন তার যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। যদিও সামরিক পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, চীনের এই যুদ্ধজাহাজ বৃদ্ধি প্রবণতা বিশে^র সামরিক ভারসাম্যের জন্য ইতিবাচক নয়।

এই মুহূর্তে চীন ঠিক কতটি যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করছে সেটি সম্পর্কে দেশটির সরকার কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিস তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, আগামী এক দশকের মধ্যে চীন আরো অন্তত ৬৫টি যুদ্ধজাহাজ সমুদ্রে নামাবে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘চায়না নেভাল মডর্নাইজেশন : ইমপ্লিকেশন ফর ইউএস নেভি ক্যাপাবিলিটিস’ শীর্ষক ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী দশকে চীন সম্ভবত তার সামরিক নৌ যানের সংখ্যা ৪২৫ এ নিয়ে যাবে। নতুন নির্মাণের মধ্যে বিমানবাহী রণতরী, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ারসহ সবাই থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনা নৌ বাহিনীর জাহাজ সংখ্যা এখন অনেক বেশি। দেশটির রয়েছে ৩০০টির বেশি সামরিক নৌ যান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, চীনা নৌ বাহিনীর আকার বিশে^ সবচেয়ে বড়। তাদের যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন মিলে রয়েছে প্রায় ৩৫০টি। এর মধ্যে অন্তত ১৩০টি হচ্ছে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ। যা যেকোন দেশের নৌ বাহিনীর শক্তিমত্ত্বার প্রতীক।কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের তথ্য মধ্যে, ২০২০ সালের শুরুতে চীনের নৌ বাহিনীর বহরে যুদ্ধজাহাজ ছিলো ২৯৩টি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বহরও কিন্তু ছোট নয় এবং একটি জায়গায় তারা চীনের চেয়ে অনেকগুণ এগিয়ে। সেটি হলো বিমানবাহী রণতরী বা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ১১টি পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী। চীনের যা এখনপর্যন্ত মাত্র দুটি। তৃতীয় আরেকটি নির্মাণ কাজ চলছে। সার্ভিসে যুক্ত থাকা চীনা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুটো হলো লিয়াওনিং ও শানডং।

তৃতীয় যে জাহাজটির নির্মাণ কাজ চলছে, সেটি চলতি বছর সমুদ্রে নামতে পারে বলে আশা করছেন বেইজিংয়ের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা। এছাড়া চলতি বছরই আরেকটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নির্মাণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে চীন।ইতোমধ্যেই চতুর্থ ক্যারিয়ারটির নির্মাণকাজের জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ ধরণের স্টিল আনা শুরু করেছে বলেও জানা গেছে। অর্থাৎ এই সেক্টরে চীন দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবধান কমাতে চাইছে সেটি বোঝাই যাচ্ছে।

আর এসব এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সুরক্ষার জন্যই চীন নির্মাণ করছে আরো অন্তত অর্ধ ডজন টাইপ জিরো ফিফটি ফাইভ মডেলের স্টেলথ ডেস্ট্রয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর জুম ওয়াল্ট ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের পরই চীনের এই ডেস্ট্রয়ারগুলো বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাটলশিপ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে চীনের পিএলএ নেভির কাছে এই মডেলের একটি ডেস্ট্রয়ার রয়েছে।

এছাড়া চীনা সামরিক ম্যাগাজিন অর্ডন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি সায়েন্স টেকনোলজির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিপবিল্ডিং প্রতিষ্ঠান প্রায় ২০টি উন্নত মানের ফ্রিগেট নির্মাণের অর্ডার পেয়েছে। এগুলো হবে টাইপ জিরো ফিফটি ফোর-বি মডেলের ফ্রিগেট।

ম্যাগাজিনটি আরো বলেছে, এসব ফ্রিগেট অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি নিয়ে সমুদ্রে ভাসবে। এছাড়া থাকবে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য ল্যান্ডিং ডক, খুবই কম শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করে চলবে এগুলো। আর এসব ফিগ্রেট বহরের জন্য রাশিয়ার কেএ-টুয়েন্টি এইট হেলিকপ্টারের বদলেনিজস্ব উৎপাদিত জেড-টুয়েন্টি এফ হেলিকপ্টারও বানাবে চীন। এই হেলিকপ্টারগুলা সাবমেরিন ধ্বংস করতে সক্ষম।

এর আগে চীন টাইপ জিরো ফিফটি ফোর-বি মডেলের ফ্রিগেটের ৩০টি তৈরি করেছিল মাত্র এক দশকে। শুধুমাত্র ২০১৯ ক্যালেন্ডার ইয়ারেই এর ছয়টি নেমেছে পানিতে। সাধারণত একটি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপে প্রতিরক্ষার প্রধান দায়িত্ব থাকে ডেস্ট্রয়ারের ওপর। এয়ার ডিফেন্স ও এন্টি সাবমেরিন অপারেশন পরিচালনা করে এই যুদ্ধজাহাজ। অত্যাধুনিক ও স্টিলথ প্রযুক্তির অস্ত্রসম্ভারের কারণে ডেস্ট্রয়ার অনেক দূর এলাকা পর্যন্ত নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পারে।

তাইওয়ানের কাওশিয়াং নেভাল অ্যাকাডেমির সাবেক ইন্সট্রাক্টর লু লি-শিহ মনে করেন, চীনের নতুন করে টাইপ জিরো ফিফটি ফাইভ ডেস্ট্রয়ার ও টাইপ জিরো ফিফটি ফোর-বি ফ্রিগেট তৈরির মূল উদ্দেশ্য দেশটির চতুর্থ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। তিনি বলেন, বিশাল এই রণতরীর নিরাপত্তার জন্যই চীন নতুন করে এসব সামরিক নৌযান তৈরি করছে।

এই বিশেষজ্ঞ জানান, চীনের জাহাজ নির্মাতা ও ইঞ্জিনিয়াররা অস্ত্র ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কখনো কখনো এতটাই অগ্রসর যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও সেই মানের সামগ্রী নেই। চীন তার যুদ্ধজাহাজে এমন অনেক অস্ত্র যুক্ত করেছে যেগুলো আমেরিকা এখনো পারেনি। উদহরণস্বরূপ নতুন তৈরি জিরো সেভেনটি ফাইভ উভচর ল্যান্ডিং ডকের কথা বলেন এই বিশেষজ্ঞ। এটি থেকে ড্রোন উড্ডয়ন ও অবতরণের ব্যবস্থাও রয়েছে।

বেইজিংয়ের সামরিক বিশ্লেষক ঝোউ চেনিং মনে করেন, চীনের এসব বিশাল নৌ প্রকল্পের আরেকটি সুবিধাজনক দিক হচ্ছে- এতে ব্যবহৃত হবে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত সামগ্রী ও অস্ত্রশস্ত্র। স্থানীয়ভাবে তৈরি অস্ত্রকে গুরুত্ব দিতেই পিপলস লিবারেশন আর্মি এই নীতি গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, রাশিয়ার কেএ-টুয়েন্টি এইট আর চীনের জেড-টুয়েন্টি অ্যাটাক হেলিকপ্টারের মূল্য একই; কিন্ত গতি ও দক্ষতার দিক থেকে চীনের নিজস্ব উৎপাদিত হেলিকপ্টারটি অনেক বেশি এগিয়ে আছে।

আরেকটি কারণে চীনের নৌ শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন, সেটি হলো তেলপাইপ লাইনসহ তার বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থাপনার সুরক্ষা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে যে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে- সেগুলোর ওপরও নজর রাখবে চীনের এসব যুদ্ধজাহাজ।

এছাড়া বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভও দেশের বাইরে চীনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। পূর্ব এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় বিশাল এই সড়ক পথের সুরক্ষার জন্য চীনা যুদ্ধাজাহাজ গুলো থেকে চলবে নজরদারি। এডেন উপসাগরে চোরাচালান রোধে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথটহল দিতেও যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। এসব কারণে তাই চীন দ্রুত তার নৌ বাহিনীর শক্তি, জনবল ও উপকরণ বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে।

তবে এসব ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে চীনের সামনে। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে যুদ্ধজাহাজ বানানো গেলেও এর লড়াই করার সামর্থ, ক্রুদের প্রশিক্ষণ ও জাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি সহজ হবে না। কানাডা ভিত্তিক কানওয়া ডিফেন্স রিভিউয়ের এডিটর ইন চিফ আন্দ্রেই চাং মনে করেন, এক দশকে ১০০টি আধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা সম্ভব হলেও এর জন্য দক্ষ ক্যাপ্টেন বা নাবিক তৈরি করা সম্ভব নয়।

একটি যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেনকে শুধু চার বছরের অ্যাকাডেমিক পড়াশুনাই নয়, এর পাশাপাশি কঠিন সব কারিগরি, মানসিক ও শারিরীক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যেটি দু’এক বছরের মধ্যে কারো জন্য আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। এসব অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে অর্জন করতে হয়।

এছাড়া এই বিশাল উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে এবং পরবর্তীতে বিশাল জাহাজের বহর রক্ষণাবেক্ষণ করতেও চীনকে দীর্ঘমেয়াদে বাড়াতে হবে প্রতিরক্ষা বাজেট। যা দেশটির অর্থনীতির ওপরও চাপ তৈরি করবে বলে মনে করেন এই ডিফেন্স এক্সপার্ট।