কাতার এখন আঞ্চলিক পরাশক্তি

-

  • মোতালেব জামালী
  • ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:১০

উপসাগরীয় অঞ্চলের ছোট্ট দেশ কাতার নিজের সমরাস্ত্রের ভান্ডার বাড়াতে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ নিয়েছে। তেল ও গ্যাসসম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি তার সামরিক শক্তি বাড়াতে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করছে। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বিমান এবং নৌবাহিনীকেও অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত করছে।

২০১৭ সালে বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরবের সাথে বিরোধ শুরু হওয়ার পর কাতারের শাসকরা প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে শুরু করেন। কারণ, সৌদি আরব এরইমধ্যে সামরিক দিক থেকে আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে রিয়াদ হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কিনছে। তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কাতার। সে কারণে পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে দেশটি। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের কুয়েত দখলের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কাতার আগে থেকেই সতর্ক হয়ে গেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হওয়ার পর এবং লিবিয়া ও সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের ঘটনায় উপসাগরীয় দেশগুলো এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের নানা গ্রুপকে সমর্থন ও সহায়তা দিতে শুরু করে। এতে দেশগুলোর পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ^াস দানা বাঁধতে শুরু করে। এর ফলে পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ২০১৪ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন কাতার থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে দেশে ডেকে পাঠায়। যদিও কয়েক মাস পরে তারা আবার কাতারে ফিরে যান। তখন থেকেই জিসিসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বৈরিতা শুরু হয়। এরপর এসব দেশ কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগে ২০১৭ সালে জুন মাসের প্রথম দিকে দেশটির সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন এবং অবরোধ আরোপ করে। এরপর কাতার দ্রুতই তার সামরিক শক্তি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়।

উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি’র মধ্যে কাতার একঘরে হয়ে পড়ায় দেশটি তখন এই অঞ্চলে মিত্র খোঁজা শুরু করে। আগে থেকেই কাতারের বৃহত্তম আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) অগ্রবর্তী সদর দফতর স্থাপন করা হয়। এই ঘাঁটিতে ১০ হাজারে বেশি মার্কিন সেনা, সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে। এই ঘাটি স্থাপন করতে দিয়ে কাতার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। তুরস্কও কাতারকে যথেষ্ট সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে।

সংহতির নিদর্শন হিসেবে ২০১৬ সালে তুরস্ককে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয় কাতার। তুরস্ক সেখানে সেনা সদস্য পাঠায়। তারা কাতারের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়। এর মাধ্যমে তুরস্ক এই বার্তা প্রদান করে করে, কাতার একা নয়, তার সাথে তুরস্কও রয়েছে। কাতারের সাথে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করার তুরস্কের এই সিদ্ধান্তকে ভালো চোখে দেখেনি সৌদি আরবসহ কাতারের প্রতিবেশী দেশগুলো।

কাতারের সাথে এই অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্কের ক্রমশ অবনতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০১৭ সালের জুুন মাসে। ঐ সময় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিসর সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে একসাথে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। আরোপ করে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ। তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করাসহ ১৩টি শর্ত দেয় কাতারকে। এরপর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কাতারে সামরিক অভিযান চালানোর হুমকি দিলে নিজের নিরাপত্তার জন্য দেশটি তার অস্ত্র সংগ্রহ কার্যক্রম জোরদার করে।

বর্তমানে কাতারের সামরিক ও বিমান বাহিনীর সব শাখার সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরেশোরে চলছে। ২০১৭ সালে বিমান বাহিনীর জন্য ফ্রান্সের কাছ থেকে বেশ কিছু মিরেজ-২০০০ যুদ্ধ ও আলফা প্রশিক্ষণ বিমান কিনে কাতার। কিন্তু সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিাতের অত্যাধুনিক বিমান বাহিনীর কাছে কাতারের এই স্বল্পসংখ্যক জঙ্গি বিমান কোনো পাত্তাই পাবে না তা কাতারও বেশ ভালো করেই জানে। সে জন্য দেশটি অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান ও সমরাস্ত্র সংগ্রহের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।

সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের বিমান বাহিনীর সাথে শক্তির পার্থক্য ঘোচাতে ও ভারসাম্য আনতে তারাও অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান কেনার প্রতি মনোযোগী হয়। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে ২৪টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ৬০০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে। এছাড়া ২০১৮ সালে আরো ১২ যুদ্ধবিমান কেনার অর্ডার দেওয়া হয়। এ নিয়ে রাফায়েল যুদ্ধ বিমানের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে মোট ৩৬টি। আরো ৩৬টি কেনার কথা জানিয়েছে কাতার। রাফায়েল হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্রুত গতির বহুমুখী ভূমিকার যুদ্ধ বিমান। এটা অনেক বেশি যুদ্ধাস্ত্র বহন এবং একাধারে অনেকগুলো অভিযান চালাতে সক্ষম। এ ধরনের যুদ্ধ বিমান যে কোন বিমান বাহিনীর কাছে প্রথম পছন্দের যুদ্ধাস্ত্র।

কাতার কেবল রাফায়েল যুদ্ধ বিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েই থেমে থাকেনি। ২০১৭ সালে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানীর কাছে থেকে ৩৬ টি অত্যাধুনিক এফ- ১৫ কিউ যুদ্ধ বিমান কেনার জন্য ১২ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই বিমানটি যে কোন ধরণের জঙ্গি বিমানের সঙ্গে যুদ্ধে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানে সক্ষম। দূরপাল্লার স্থল অভিযান চালাতেও এই যুদ্ধ বিমানের কোন জুড়ি নেই। কাতারের জন্য এই কোম্পানী যে যুদ্ধ বিমানগুলো বানাচ্ছে তাতে যুদ্ধাস্ত্র বহন করার ক্ষমতা বাড়ানো এবং এর সেন্সর আরো উন্নত করা হয়েছে।

কাতার তার বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও একে বহুমুখী করার জন্য ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ২৪টি টাইফুন যুদ্ধ বিমান কেনার চুক্তি করে। এটিও বর্তমান সময়ে উচ্চ প্রযুক্তির একটি যুদ্ধ বিমান এবং আকাশে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম। বিমানটির বিভিন্ন ধরণের অভিযান চালানোর সক্ষমতা রয়েছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে যুক্তরাজ্য ও কাতারের বিমান বাহিনী টাইফুন জঙ্গি বিমান দিয়ে একটি যুদ্ধ মহড়া পরিচালনা করে।

শুধু বিমান বিক্রি করাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এই তিনটি দেশই কাতারের পাইলটদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদানেও সম্মত হয়েছে। এছাড়া গ্রাউন্ড ক্রুদের প্রশিক্ষণ ও লজিষ্টিক সহায়তা দিতেও দেশ তিনটি রাজী হয়েছে। এর মাধ্যমে কাতারের প্রতি এই তিন দেশের সমর্থনের দিকটি স্পষ্ট হয়ে যায়। যেখানে কাতারের বিমান বাহিনীতে আগে মাত্র ১২ টি যুদ্ধ বিমান ছিল, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তা ৯৬ টিতে গিয়ে দাড়াবে। এগুলোর বেশির ভাগই হবে বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ বিমান। ফলে কাতারের বিমান বাহিনী হবে এই অঞ্চলের বিমান বাহিনী গুলোর মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী।

কাতারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র তুরস্কের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্কও দিন দিন জোরদার হচ্ছে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প কমপ্লেক্স দিন দিনই পূর্ণতা পাচ্ছে। এখান থেকে তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র যুদ্ধে ব্যাপক কার্যকারিতার জন্য সুনাম কুড়াচ্ছে। কাতার সম্প্রতি তুরস্কের কাছ থেকে ৬টি বেরেকতার টিবি ২ ড্রোন কিনেছে। এছাড়া প্রশিক্ষণের জন্য তুরস্কে নির্মিত দুটি বড় আকারের ক্যাডেট প্রশিক্ষণ জাহাজও কিনেছে। একইসঙ্গে কোষ্টগার্ডের জন্য অনেকগুলো দ্রুতগামী টহল বোটও কেনা হয়েছে।

কাতার স্থল বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্কের সংখ্যাও বাড়িয়েছে। জার্মানী থেকে কেনা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ৬২টি লেপার্ড ২এ৭ ট্যাঙ্ক। বর্তমান সময়ে যেসব ট্যাঙ্ক রয়েছে এটি তার মধ্যে এটি সব চেয়ে কার্যকর একটি যুদ্ধাস্ত্র। মরুভূমির প্রচন্ড গরম ও বালুর মধ্যে চলার উপযোগি করে এই অত্যাধুনিক ট্যাঙ্কটি বানানো হয়েছে। এর পাশাপাশি তুরস্ক থেকে কেনা হচ্ছে ১০০টি যুদ্ধ ট্যাঙ্ক। এছাড়া জার্মানী থেকে সেল্ফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ও চীন থেকে স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলও কিনছে কাতার। রাশিয়ার কাছ থেকে বর্তমানে বহুল আলোচিত এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার আগ্রহও প্রকাশ করেছে।

কাতারের নৌবাহিনীকেও পিছিয়ে বা অনগ্রসর রাখা হচ্ছে না। ইতালীর একটি কোম্পানির কাছে থেকে সাবমেরিন ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম কেনার পাশাপাশি ল্যান্ডিং ডক ও অফশোর নৌঘাটি নির্মানের নির্মানের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী এই প্রতিষ্ঠানটিকে।

সশস্ত্র বাহিনীর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটানোর ক্ষেত্রে কাতারের অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়ের অর্থই হচ্ছে সেক্ষেত্রে সরবরাহ ও লজিস্টিকস একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠবে। ক্রমবর্ধমান জটিল সিষ্টেমের মধ্যে একটি সমন্বিত কাঠামোর কাতারের সমাধ্যমে সব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কাতারের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জনশক্তি। মাত্র ২৮ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট এই দেশটিতে একবিংশ শতাব্দির যুদ্ধের জন্য অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহারের উপযোগি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল তৈরি করাটাও কাতারের জন্য হবে অভাবনীয় এক চ্যালেঞ্জ।

সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাতার দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। মাত্র কয়েক বছর আগেও যে দেশটি ছিল সামরিক দিকে থেকে ছিল একেবারেই হিসাবের বাইরে, এখন তা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। নিজের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি ও মিত্রদের সহায়তায় কাতার এখন সমীহ করার মতো একটি আঞ্চলিক শক্তি।