কৃষ্ণ সাগর নিয়ন্ত্রণে রাশিয়ার যত প্রয়াস

কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে রাশিয়ার হঠাৎ তৎপরতা বৃদ্ধিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ পশ্চিমা দেশই নিজেদের জন্য হুমকি বলে মনে করছে - ইন্টারনেট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০১ জানুয়ারি ২০২১, ১২:৫৭

বিশ্ব রাজনীতি আর ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কৃষ্ণসাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে। এবার তারা সামরিক কৌশল হিসেবে খুবই বহুল প্রচলিত একটি কৌশল অবলম্বন করেছে দেশটি। আর তা হলো ডিভাইড এন্ড কুনকয়ের। অর্থাৎ প্রতিপক্ষের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে রাশিয়া এ অঞ্চলকে জয় করে নিতে চায়।

র‌্যান্ডের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, এ অঞ্চলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যারাই কোনো ধরনের জোট গঠনের চেষ্টা করেছে, রাশিয়া তাদের মাঝেই সন্দেহ ও সংশয়ের বীজ বুনে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ জোটগুলোকে ভাঙ্গনের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেপর পক্ষে কয়েকটি দেশকে একসাথে মিলিয়ে জোট গঠন যতটাই সহজ, রাশিয়ার পক্ষে ঐ দেশগুলোর মধ্যে দুরত্ব তৈরি করা তার তুলনায় অনেকটাই সহজ।

কৃষ্ণসাগর বিশ্ব রাজনীতি ও ভূনিরাপত্তার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, রাশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক, রোমানিয়া এবং অন্যান্য আরো কয়েকটি দেশের ভূকৌশলগত প্রভাব বিস্তার অনেকাংশেই নির্ভর করে কৃষ্ণসাগর নিয়ন্ত্রণের ওপর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অঞ্চলে রাশিয়া প্রভাব যথেষ্ট দৃশ্যমান।

ইউক্রেনের ক্রিমিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। গোটা এলাকা জুড়ে অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ ও মিসাইল মোতায়েন করেছে এবং ন্যাটোর কয়েকটি জাহাজের চলাচলে বাঁধা প্রদান করেছে। অন্যদিকে, কৃষ্ণসাগরের ওপর দিয়ে একটি মার্কিন টহল বিমান উড়ে যাওয়ার সময় রাশিয়ার যুদ্ধবিমান অনুসরন করেছে।

রাশিয়ার এমন আচরনের কারন মস্কো কৃষ্ণসাগর নিয়ে অস্থিরতায় আছে। সাবেক সেভিয়েতের স্যাটেলাইট রাষ্ট্র রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াও এখন ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। ইউক্রেন এখনও স্বতন্ত্র কিন্তু ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক খুবই শত্রুতাভাবাপন্ন।

অন্যদিকে, পশ্চিমা অন্যান্য দেশগুলো ন্যাটোর প্রতি আহবান জানিয়েছে যাতে কৃষ্ণসাগরের দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রন নেয়ার জন্য ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সেনাদের সমন্বয়ে একটি পৃথক কোয়ালিশন ফোর্স গঠন করা হয়।

র‌্যান্ড এরই মধ্যে আগামী দশ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে পরাশক্তিগুলো কী ধরনের কৌশলী খেলায় লিপ্ত হতে পারে তার একটি চিত্রও উপস্থাপন করেছে। র‌্যান্ডের হিসেবে, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ন্যাটো গোটা কৃষ্ণসাগর এলাকাজুড়ে নিজেদের নৌ সেনাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করবে। অন্যদিকে, রোমানিয়া এরই মাঝে সাবেক সেভিয়েতভুক্ত রাষ্ট্র মলদোভার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে।

রাশিয়া একসাথে কয়েক ধরনের খেলা খেলছে। একদিকে তারা গোটা কৃষ্ণসাগর জুড়ে একটি এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠার জন্য জোর কদমে চেষ্টা চালাচ্ছে, অন্যদিকে তারা রোমানিয়ার তথ্য সংগ্রহ করার জন্য নিয়মিতভাবে রোমানিয়ার বিরুদ্ধে সাইবার অপারেশনও পরিচালনা করছে। কৃষ্ণসাগর এলাকায় উত্তেজনা আরো বেড়ে যায় যখন রাশিয়ার একটি এসইউ টোয়েন্টি ফোর জেট বিমান মার্কিন একটি রণতরীতে হামলা চালায়। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন মার্কিন সেনাও নিহত হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, আগামীতে এ অঞ্চলে মেরুকরণের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যাবে। এরইমাঝে সামর্থবান দেশগুলো দুর্বল প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে দমিয়ে রাখার জন্য বড়ো আকারের আর্থিক প্রনোদনা ও সহযোগিতা দেয়ার কৌশল বাস্তবায়ন করছে। আবার যে দেশগুলোকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না, সে সব দেশের বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ চালানো হচ্ছে। রাশিয়ার আধিপত্য ও প্রভাবকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বেশ কিছু সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল গ্রহন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে দিয়ে বিশেষ একটি ব্ল্যাক সি ফোর্স গঠনের চেষ্টা করছে। এটি গঠন করা গেলে, এই বাহিনীর সাইনবোর্ড ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এ এলাকায় প্রয়োজনমতো নৌ অভিযান পরিচালনার সুযোগ পাবে। অন্যদিকে, মনট্রিয়ক্স কনভেনশনকে ব্যবহার করে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে মিলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক মহড়াও শুরু করতে পারবে। মনট্রিয়ক্স কনভেনশন প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর দেশগুলো বনফরাস প্রনালী দিয়ে যুদ্ধ জাহাজ চলাচলের অনুমতি পাবে। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন থাকা রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজগুলোও তখন আর কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করতে পারবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাড়তি সুবিধা হলো রাশিয়ার নীতিনির্ধারকদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান। রাশিয়া ভূমধ্যসাগর বা কৃষ্ণসাগরে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে চাইলেও এখনি কোনো যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তারপরও ঝুঁকি কিছু থেকেই যাবে। রাশিয়া ব্লকের অধিকাংশ দেশের সাথেই এরই মধ্যে ন্যাটোর দুরত্ব ও সংঘাত তৈরি হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও বেশ কয়েকটি রাশিয়া সমর্থক দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। তাই রাশিয়া এখুনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে জড়াতে না চাইলেও বিষয়টি খুব সহজও হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড়ো জটিলতা হলো রাশিয়ার কৌশলী ভূমিকা। রাশিয়া বুঝে গিয়েছে, যুদ্ধের চেয়ে বরং যুদ্ধে না গিয়ে তাদের লাভ বেশি। তাই আমেরিকার উস্কানির ফাঁদে পা দিচ্ছে না। রাশিয়া এখন শুধু চেষ্টা করছে যাতে মস্কোর বিরুদ্ধে কোনো জোট এ অঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। পাশাপাশি, রাশিয়া নীরবে কিছু সামরিক চাপও সৃষ্টি করছে।

বিভিন্ন সময় ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজগুলোকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেছে। ক্রিমিয়ার দিকে লক্ষ্য করে বাড়তি অনেকগুলো মিসাইল মোতায়েন করেছে। সাইবার যুদ্ধের মাধ্যমেও প্রতিপক্ষের গোপন তথ্য জেনে নেয়ার কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাদের মানহানি করার চেষ্টা করতে পারে।

এ কৌশলী ভুমিকা রাশিয়াকে বেশ সুবিধা দিচ্ছে। যে দেশগুলো ফায়দা হাসিলে আগ্রহী তাদেরকে সুবিধা দিচ্ছে আর যারা একটু দুর্বল অবস্থায় আছে, তাদের ওপর চড়াও হচ্ছে। তুরস্ক ও বুলগেরিয়া রাশিয়ার প্রতি নমনীয় হওয়ায় রাশিয়া তাদের সাথে নিয়মিতভাবেই বৈঠক, যৌথ সামরিক মহড়া এবং সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্ককে গোয়েন্দা সহযোগিতা ও অন্যন্য সামরিক সহযোগিতাও প্রদান করেছে। বুলগেরিয়াকেও হাতে রাখার জন্য রাশিয়া অল্প দামে গ্যাস সরবরাহ করছে। আর যে দেশগুলো রাশিয়ার সাথে নেই, তাদের সাথে রাশিয়ার আচরন একেবারেই ভিন্ন। রোমানিয়ার কথা বলা যায়। রোমানিয়ার সাথে রাশিয়ার সংঘাত এখন দৃশ্যমান। রোমানিয়ার বেশ কয়েকটি বানিজ্যিক জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রেও রাশিয়া বাঁধা দিয়েছে। আবার ইউক্রেনের জেলেদের মাছ ধরাকে বন্ধ করার জন্য রাশিয়া অ্যাজভ সমুদ্রকে ইউক্রেনিয়ানদের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আবার জর্জিয়ার অধিকৃত এলাকাতেও রাশিয়া সামরিক মহড়া চালিয়েছে।
রাশিয়ার এ দ্বিমুখী কৌশলে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। রোমানিয়া, ইউক্রেন ও জর্জিয়া রাশিয়ার চাপের কাছে টিকতে পারেনি। অন্যদিকে, তুরস্ক ও বুলগেরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়ে এরই মধ্যে কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন থাকা ন্যাটোর বহর থেকে পিছিয়ে এসেছে।

রাশিয়া সাময়িকভাবে হলেও একটা বিজয় পেয়েছে। এক্ষেত্রে তুরস্ক ক্রীড়নকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেছে। র‌্যান্ড কর্পোরেশনও স্বীকার করেছে যে, এ পর্যন্ত রাশিয়া যে সফলতা পেয়েছে তার মুল কারণ হলো রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ইতিবাচক সম্পর্ক।

সিরিয়ায় যেভাবে রাশিয়া তুরস্কের পাশে দাঁড়িয়েছে আর যেভাবে অবরোধসহ নানাভাবে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে কোনঠাসা করার চেষ্টা করেছে, তাতে তুরস্ক বরং আরো বেশি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সে কারণেই তুরস্ক রাশিয়ার সমর্থন হারানোর বিনিময়ে ন্যাটোর টাস্কফোর্সকে সমর্থন করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেনা।
অন্যদিকে, বুলগেরিয়াকে রাশিয়া যেভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়েছে, তা বুলগেরিয়া প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চায় না। তারপরও এ দুদেশের ঘনিষ্ঠতা এখন স্পষ্ঠ। আর রাশিয়া ও বুলগেরিয়ার মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গোটা অঞ্চলের সব দেশকে নিয়ে ন্যাটোর আঞ্চলিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে অনেকটাই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

নেপোলিয়ন বহুআগেই বলেছিলেন, সমরনেতা হিসেবে তিনি কোনো একটি কোয়ালিশনের অংশ হয়ে লড়াই করার চেয়ে বরং কোয়ালিশনের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাশিয়াও ঠিক একইপথে অগ্রসর হচ্ছে। রাশিয়া উপলব্ধি করেছে যে, ন্যাটোর সাথে সামরিক কোনো সংঘাতে না জড়িয়ে বরং বেসামরিক কোনো কৌশল দিয়ে ন্যাটোর ওপর প্রভাব বিস্তার করাই অধিক কার্যকর হবে। র‌্যান্ডের পর্যালোচনা অনুযায়ী, রাশিয়া বুঝে গেছে বর্তমান মেরুকরণ নির্ভর পরিস্থিতিতে একটি জোট গঠন করা এবং তা অটুট রাখার চেয়ে বরং আঞ্চলিক সংহতিকে দুর্বল রাখা বেশি সহজ।

কৃষ্ণসাগর যেহেতু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তাই এ অঞ্চলকে নিয়ে পরাশক্তিগুলোর তৎপরতা খুবই তাৎপর্যপূর্ন। ২০০৮ সালে রাশিয়া যখন জর্জিয়ায় সামরিক অভিযান চালায় তাতে মার্কিন সেনা নীতি নির্ধারকেরা খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। আবার ইউক্রেনে ২০১৪ সালে রাশিয়ার আক্রমনকেও অনেকে মানতে পারেনি। নিজ দেশের বিরোধী দলীয় নেতা এবং ইউরোপেও বিভিন্ন সময়ে রাশিয়া বিরোধী নেতৃবৃন্দকে গুপ্তহত্যা ও বিষক্রিয়ায় হত্যা করা হয়েছে, তাও বিশ্বজুড়ে রাশিয়ার একটি ভিন্ন ধরনের ভাবমূর্তি তৈরিতে সহায়তা করেছে।

কৃষ্ণসাগরের মূল অংশ থেকে অ্যাজভ সাগরটি বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে কের্চ প্রনালীর কারণে। রাশিয়া স¤প্রতি এ প্রণালীতে একটি ব্রিজ চালু করেছে। ব্রীজের ওপর দিয়ে রেল চলাচলও উদ্বোধন করেছেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøদিমির পুতিন। এর ফলে রাশিয়ার ম‚ল ভ‚খন্ডের সাথে শুধুমাত্র ক্রিমিয়ার সংযোগই স্থাপিত হয়নি, বরং আজব সাগর ও কৃষ্ণসাগরের বাকি অংশ থেকে ইউক্রেইনকে আলাদাও করে দিয়েছে।

কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে রাশিয়ার হঠাৎ তৎপরতা বৃদ্ধিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ পশ্চিমা দেশই নিজেদের জন্য হুমকি বলে মনে করছে। তাই আগামী দিনগুলোতে কৃষ্ণসাগরকে কেন্দ্র করে নতুন করে অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে