ভবিষ্যত যুদ্ধের ধরণ পাল্টে দেবে সশস্ত্র ড্রোন

ড্রোনগুলো আকাশসীমায় প্রবেশ করা থেকে শুরু করে আক্রমন পর্যন্ত সময়ে একবারের জন্যেও এগুলোকে সনাক্ত ও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি - ইন্টারনেট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:৫৭

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে নাগারনো কারাবাখ নিয়ে সম্প্রতি শেষ হওয়া যুদ্ধ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু । এই যুদ্ধে মনুষ্যবিহীন আকাশযান বা ইউএভি কিংবা বিভিন্ন ধরনের ড্রোনই আর্মেনিয়া এবং আর্মেনিয়ার প্রকৃতির বাহিনীগুলোকে ধরাশায়ী করেছে। সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা যায়, আজারবাইজান এ যুদ্ধে আর্মেনিয়ার ২৪১টি যুদ্ধ ট্যাংক তথা টি-সেভেন্টি টু এস এবং টি-নাইনটি, ৫০টি বিএমডি পদাতিক যুদ্ধ যান, ১৭টি মোটরচালিত আর্টিলারি সমরাস্ত্র, ৯টি রাডার, ২টি স্মারস এমএলআর সিস্টেম, ৭০টি গ্রাড এমএলআর সিস্টেম এবং ট্রাকসহ অসংখ্য সমরযানকে বাজেয়াপ্ত করতেও সক্ষম হয়েছে।

এ যুদ্ধে আর্মেনিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রীতিমতো ধ্বসে পড়েছে। আর্মেনিয়ার ৪টি এস-থ্রি হান্ড্রেড ডিফেন্স সিস্টেমকে পুরোপুরি অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, তিনটি টিওআর ট্র্যাক এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম, ৪০টি ওএসএ নাইন কে থ্রি থ্রি ট্যাকটিকাল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং ৫টি কেইউবি টুকে ওয়ান টু মধ্যম পাল্লার ডিফেন্স সিস্টেমও এবার আজারবাইজানের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, কার্যত আর্মেনিয়ার সবগুলো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর্মেনিয়ার হাতে বিমান প্রতিরক্ষার জন্য ম্যান প্যাড ছাড়া আর এখন কিছুই নেই।

আজারবাইজান সেনাবাহিনী বিভিন্ন নজরদারিমূলক ড্রোন এবং আক্রমনকারী ড্রোন থেকে তোলা যেসব ভিডিও পোস্ট করেছে তাতে দেখা যায়, আজারি এসব ড্রোন আক্রমন করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আর্মেনিয়ার রাডার বা ডিফেন্স সিস্টেম একটি ড্রোনকেও সনাক্তই করতে পারেনি। প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা। বরং এসব ভিডিও দেখে মনে হয়েছে, ইউএভির কাছে রাডারগুলো যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিল। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে প্রতিপক্ষের আকাশে ড্রোনের এভাবে ঢুকে পড়া নতুন কিছু নয়।

শুধু নাগারনো কারবাখের যুদ্ধ নয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের আবকাইক এবং খুরাইসে দুটো বিশালাকৃতির ড্রোন ও ক্রুস মিসাইল দিয়ে হামলা চালানো হয়। সেবারও সৌদি আরবের কোনো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমই এগুলোকে সনাক্ত করতে পারেনি।

সৌদি আরবে মূলত তিনটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে যাবতীয় তেলকূপ, তেল উৎপাদন ও পরিশোধন স্থাপনাগুলোকে সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এগুলো হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত প্যাট্রিয়ট, ফ্রান্সের শাশিন ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণ যোগ্য মিসাইল সিস্টেম এবং সুইজারল্যান্ডের ওয়ারলিকনের জিডিএফ রাডার নিয়ন্ত্রিত ৩৫ মিলিমিটার টুইন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। কিন্তু এগুলো কোনোটি দিয়েই লাভ হয়নি।

ড্রোনগুলো আকাশসীমায় প্রবেশ করা থেকে শুরু করে আক্রমন পর্যন্ত সময়ে একবারের জন্যেও এগুলোকে সনাক্ত ও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। আবকাইকের উত্তর, পূর্ব, দক্ষিন পূর্ব এবং দক্ষিনাঞ্চলে এ এয়ারসিস্টেমগুলো চালু আছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টিমের তথ্যনুযায়ী এসব সিস্টেমকে ভেদ করে আবাইকের ২৭ ডিগ্রি উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের কোনো স্থান থেকে হামলা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ড্রোন ও মিসাইলগুলো আবকাইকের ২শ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম এলাকা থেকে ছোড়া হয়।

হামলাকারী ড্রোনগুলোর মধ্যে উদ্ধার করা একটি ড্রোনের কম্পিউটার অনুসন্ধান করে দেখা যায়, এ ড্রোনটি টার্গেটে আক্রমন করা ঠিক পূর্ব মুহুর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। এমন তথ্য সৌদি আরবের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। কারণ দুটো স্থাপনার ওপর তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও এক্ষেত্রে তা সম্পুর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে নাগারনো কারাবাখে যে ড্রোনগুলো ছোড়া হয়েছে, সেগুলো বিচ্ছিন্নভাবে একটি একটি করে ছাড়া হয়েছে।

২০১৯ সালে সৌদি আরবে যে ড্রোনগুলো ছোড়া হয়, তা ছিল সংঘবদ্ধ আকারে। একসাথে অনেকগুলো ড্রোন চলে আসায় আক্রমনে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেশি ছিল। যেমন আবকাইকেই নয়টি পৃথক ট্যাংকে একসাথে আঘাত করা হয়। এর মধ্যে তিনটি ট্যাংকের ওপর পরপর দুবার হামলা চালানো হয়। মাত্র ২০ সেকেন্ড সময়ের মাঝে তেমন কিছু একটা বোঝার আগেই এতগুলো হামলার ঘটনা ঘটে যায়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, যত দূর থেকেই ছোড়া হোক না কেন, অধিকাংশ ড্রোন ঠিকমতোই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত হেনেছে। প্রতিটি সেপারেটর ট্যাংক ডায়ামিটারে ২৮ মিটার এবং উচ্চতায় ৯ মিটার উঁচু। সৌদি আরবের তেল স্থাপনা এবং নাগারনো কারাবাখে আর্মেনিয়ার সামরিক কাঠামোতে একের পর এক ড্রোন হামলার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে কেন বিদ্যমান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা রাডার এই ড্রোনগুলোকে সনাক্ত করতে পারছে না? সৌদি হামলার ক্ষেত্রে তো নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি ক্রুজ মিসাইলকেও সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।

রাশিয়াও সিরিয়া অভিযান পরিচালনা করার সময় খেমেইমিম বিমান ঘাটিতে একই ধরনের হামলার মুখোমুখি হয়। একাধিকবার এমন হয়েছে যে, মনুষ্যবিহিন ড্রোনগুলো নির্বিঘ্নে এসে এ ঘাটিতে হামলা চালিয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে। সেদিন ১০টি ড্রোন একসাথে বিপুল পরিমান বিস্ফোরক নিয়ে রাশিয়ার খেমেইমিম বিমান ঘাটিতে হামলা চালায়। একই সময়ে আরো তিনটি ড্রোন তারতুসে থাকা রাশিয়ার নৌ বাহিনীর ঘাটিতেও আক্রমন করে।

রাশিয়া সে সময় দাবি করেছিল যে, প্যান্টসির এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে প্রয়োগ করে ৭টি ড্রোনকে ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছিল এবং ৬টি ড্রোন নিয়ন্ত্রন নিতে পেরেছিল। বিমান ঘাটিতে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবরও অস্বীকার করেছিল। কিন্তু রাশিয়ার এসব দাবি আদৌ সঠিক কিনা তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। অনেকেই রাশিয়ার দাবি বিশ্বাস করেনি।

রাশিয়ার এসব দাবি সত্য না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ তুরস্কের বেরাকতার ড্রোনগুলো সিরিয়া ও লেবাননে রাশিয়ার তৈরি প্যান্টসির এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এমনকী একদিনের ভেতর ৯টি প্যান্টসির ধ্বংসেরও ঘটনা ঘটেছে। বেরাকতার একটু বড়ো আকৃতির ড্রোন। এর ডানা প্রায় ১২ মিটার লম্বা। সাধারণ এফ সিক্সটিন যুদ্ধবিমানে ৯ দশমিক ৯৬ মিটার লম্বা ডানা থাকে। বেরাকতার ড্রোনের ডানাগুলো তার চেয়েও লম্বা।

২০১৮ সালের হামলার পর অবশ্য প্যান্টসির সিস্টেমকে উন্নত করা হয়েছে। অন্তত রাশিয়া এমনটাই দাবি করছে। কিন্তু দাবির সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কারণ খেমেইমিম বিমান ঘাটিতে হামলা চালানো হয়, তখন প্যান্টসির সে অর্থে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। ২০১৮ সালের খেমেইমিম বিমান ঘাটিতে সোয়ার্ম ড্রোন ব্যবহার করা হয়। সোয়ার্ম ড্রোনগুলো দেখতে অনেকটা এসইউ টোয়েন্টি ফোরের মতো। প্রশ্ন হলো, প্রথাগত রাডার বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিয়ে ড্রোন সনাক্তই করা সম্ভব নয়?

ইসরাইল দাবি করছে, তারা মিসাইল বা রকেট সনাক্ত ও প্রতিরোধে কিছুটা সফল হয়েছে। ইসরাইল দাবি করছে গাজা থেকে সা¤প্রতিক সময়ে কাসসাম নামে যেসব ছোট রকেটগুলো ছোড়া হয়েছে সেগুলোর কোনোটাই ইসরাইলের আয়রন ড্রোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তবে, আয়রন ডোম ছাড়া অন্য যেসব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে তা দিয়ে অবশ্য রকেটকে ধ্বংস বা অকার্যকর করা যায়নি।

এ ধরনের ইউএভিগুলোতে জ্বলন্ত রকেট ইঞ্জিন থাকে না। এগুলোর ভেতর মূলত ছোট আকৃতির কমবাস্টন ইঞ্জিন গুলো ব্যবহার করা হয়- যা ব্যাটারি দিয়ে পরিচালনা করা হয়। অনেকগুলো ইউএভিকে প্লস্টিক বা এ জাতীয় কম্পোসিট দিয়ে তৈরি করা হয়। কখনো কখনো এগুলো ঘরে নির্মিত কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। শুধুমাত্র ইঞ্জিনেই মেটাল আইটেমগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে, ইঞ্জিনটি আকারে এতটাই ছোট যে বাইরে থেকে তাকে দেখা যায় না ফলে এগুলোতে হামলা চালানোও যায় না।

এক্ষেত্রে বেরাকতার টিবিটু সম্পুর্ন ভিন্ন। তুরস্কের তৈরি এ ড্রোনগুলো কম্পোসিট এবং কেভলার দিয়ে নির্মিত। এখানে মেটাল কিছু নেই। এ ড্রোনগুলোতে অস্ট্রিয়ার তৈরি ছোটাকৃতির ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় যা একেবারে ফিউসলেগের ভেতরে অবস্থিত। এ ড্রোনগুলো যদিও আকৃতিতে বড়ো, কিন্তু এর রাডার সিগনেচার খুবই ছোট হওয়ায় এ ড্রোনগুলোকে সনাক্ত করা যায় না।
ছোট ড্রোনগুলোকে সনাক্ত করার মতোও রাডার আছে। কিন্তু পুরনো এয়ারডিফেন্স সিস্টেমে সেই রাডারগুলো থাকে না। আধুনিক সময়ের রাডারগুলো অতীতের রাডারের তুলনায় একটু ভিন্নভাবে কাজ করে। নতুন এ রাডারে হাই রিসোলিউশনে স্ক্যান করার ক্ষমতা আছে। তাছাড়া এ রাডারগুলোতে কম্পিউটারের অ্যালগোরিদম থাকায় তারা ভিন্ন ভিন্ন ড্রোনের বেলায় ভিন্ন সিগনেচার ডাটা গ্রহণ করতে পারে।

রাডার ছাড়াও ড্রোন সনাক্ত করার আরো উপায় আছে। ড্রোন থেকে পাঠানো তথ্যর মাধ্যমে ড্রোনকে সনাক্ত করা যায়। কখনো কখনো অপটিকাল সেন্সর দিয়ে ড্রোনকে খুঁজে বের করা যায়। আর ড্রোন চলতে গিয়ে যদি আওয়াজ বেশি হয় তাহলেও ড্রোনকে ধরে ফেলা সহজ। সা¤প্রতিক সময়ে যেসব ড্রোন সনাক্তকরণ পদ্ধতি আছে তাতে এসব কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। সেইসাথে উন্নতমানের সফটওয়্যারও দেয়া হয়েছে। এসবগুলো পদ্ধতি মিলে ড্রোনকে ট্র্যাক করা এবং ক্ষতিকর ড্রোনগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব হবে।

নাগারনো কারাবাখে এরকম একটি ভালো ড্রোন ধ্বংসাত্মক প্রযুক্তি রাশিয়া নিয়ে এসেছিল। তবে, তা একেবারে শেষদিকে হওয়ায় তা ব্যবহার করার তেমন একটা সুযোগ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে সৌদি আরব এখনও পর্যন্ত কার্যকর ড্রোন প্রতিরোধক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারেনি। অন্যন্য দেশের অবস্থাও অনেকটা একই রকম। তাই কোনো বাহিনীর কাছে ভালোমানের ড্রোন থাকলে আগামী দিনগুলোর যুদ্ধে বা সংঘাতে তারা যে বাড়তি সুবিধা পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে