তুরস্কের বিমান বাহিনীর সঙ্কটে পাশে পাকিস্তান

তুরস্কের বিমান বাহিনীতে পাইলটের সংখ্যার ঘাটতি অজানা কোনো বিষয় নয় - ইন্টারনেট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:২৩

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ২০১৬ সালের সেনা অভ্যুন্থান কেন্দ্র করে তুরস্কের বিমান বাহিনী বড়ো আকারের সংকটে পড়ে। এ অভ্যুন্থানের পেছনে বিমান বাহিনীর কিছু স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তাদের ভূমিকাকেই দায়ী করা হয়। পরবর্তীতে, এর সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে কয়েক হাজার সেনা কর্মকর্তাকে চাকুরি থেকে বহিস্কার করা হয়। এর মধ্যে বড়ো একটি অংশ অবসরে যান, আবার অনেকে বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয়ও নেন।

অভ্যুন্থানের পর তুরস্কের বিমান বাহিনীর বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা চাকুরি ছেড়ে চলে যাওয়ায় বাহিনীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশটির সামরিক সক্ষমতাও বড়ো আকারে হোচট খায়। বিমান বাহিনীতে পাইলটের সংকট সৃষ্টি হওয়ার প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নতুন পাইলট প্রশিক্ষন দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করেন। আবার সরকারী চাকুরি ছেড়ে ইতোপূর্বে অবসরে গিয়ে যেসব পাইলট বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তাদের অনেককে আবারও চুক্তিভিত্তিক বিমান বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়।

২০১৬ সালের অভ্যুত্থানে তুর্কি বিমান বাহিনীতে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এমনকী পাইলট না থাকায় অনেক যুদ্ধবিমান ফেলেও রাখা হয়। শুধুমাত্র অভ্যুত্থানের কারণেই বিমান বাহিনীতে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাও নয়। এ সমস্যা আগেও ছিল। ২০১২ সালে এরদোয়ান সরকার একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন যাতে পাইলটদের স্বেচ্ছা অবসর বন্ধ করে দেয়া যায়। কারণ পাইলটদের অনেকেই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চড়া বেতন পাওয়ার লোভে সরকারী চাকুরি থেকে দ্রুত অবসর নেয়ায় সরকারী বিমান পরিবহন খাত বেশ চাপের মুখে পড়ে গিয়েছিল।

মূলত সেনাবাহিনীর অনুরোধেই এরদোয়ান এ বিলটি প্রত্যাহার করেন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বিলটি সংশোধন করে আবার অনুমোদন করা হয়। নতুন এ বিলের মাধ্যমে স্বেচ্ছা অবসর প্রক্রিয়াকে একেবারে বাতিল করে দেয়া হয়নি। তবে কিছুটা কঠিন করা হয়েছে। ফলে চাইলেই কোনো পাইলট এখন হুট করে অবসর নিয়ে নিতে পারবে না।

২০১২ সালের আগেই বিমান বাহিনীতে বড়ো আকারের শূণ্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালের আইনটিতে পাইলটদের চাকুরির সময়সীমা ১৩ বছর বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়। তবে, আইনটি পাশ করার আগ দিয়ে দেশটিতে মোট ২৫১ জন পাইলট অবসর নেয়ার আবেদন করেছিল।

তুরস্কের বিমান বাহিনীর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসে তাদের আরো ৫৫৪ জন পাইলটের প্রয়োজন ছিল যার মধ্যে ১৯০ জন হলেন কমব্যাট পাইলট। ২০১৭ সালের জানুয়ারীর হিসেব অনুযায়ী দেশটিতে ১ হাজার ১৫৪ জন সামরিক পাইলটের ঘাটতি ছিল। এত বিশাল ঘাটতি পূরণ করা যে কোনো সামরিক বাহিনীর জন্যই বেশ কঠিন।

পাইলট সংকটে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ দিকে যাওয়ায় দেশটি মারাত্মক নিরাপত্তাজনিত সংকটে পড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তুরস্ক তার দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু পাকিস্তানের কাছে সহযোগিতা চায়। দ্রুত কিছু ফার্স্ট ট্র্যাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন পাইলটদের প্রশিক্ষন এবং এফ-সিক্সটিন বিমান পরিচালনার জন্য তুরস্ক পাকিস্তানের কাছে সাহায্য চায়।

এফ-সিক্সটিন বিমানটি তুরস্কের বাইরে অন্য কোনো দেশের পাইলটদের দিয়ে চালানোর জন্য তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও অনুমতি চায়। যদিও ওয়াশিংটন তাৎক্ষণিকভাবে তা খারিজ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি পাইলট দিয়ে নয় বরং সৌদি ও কাতারের পাইলটদেরকে দিয়ে এফ-সিক্সটিন পরিচালনার জন্য তুরস্ককে অনুমতি প্রদান করে।

তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যেভাবে নিজের অবস্থান শক্ত করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের নানা ইস্যুতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে তাতে নিরাপত্তার স্বার্থে তুরস্কের জন্য পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তুরস্ক এ মুহুর্তে সিরিয়া, লিবিয়াসহ বেশ কিছু দেশ এবং চলমান আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান যুদ্ধে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে পড়েছে।

তবে তুরস্কের চির প্রতিদ্বন্দী গ্রীস তাদের একটি মিডিয়া প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিতে গ্রাহ্য না করেই পাকিস্তানের কয়েকজন পাইলটকে এফ-সিক্সটিন বিমান উড্ডয়ন করার জন্য নিয়োগ দিয়েছে। এর আগে পাকিস্তান ও তুরস্ক মিলে ভূমধ্যসাগরে টানা বেশ কয়েকদিন যাবৎ যৌথ মহড়াও সম্পন্ন করে। গ্রীসের মিডিয়া জানিয়েছে, তুরস্কে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ২১০৬ সালে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল তার পর দেশটির বিমান বাহিনীতে যে শূণ্যতা তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানের সহায়তা নিয়ে তুরস্ক তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

তুর্কী বিমান বাহিনীর পাইলট সংকট পূরণে এরদোয়ান প্রশাসন পাকিস্তানের সহযোগিতা চায়। বিশেষ করে এফ-সিক্সটিন যুদ্ধবিমান পরিচালনার মতো পাইলটের যে অভাব দেখা দিয়েছে পাকিস্তান থেকে পাইলট এনেই তা পূরণের চেষ্টা করছে তুর্কী প্রশাসন। গ্রিসের একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক জানিয়েছেন, পাকিস্তান এর আগেও বেশ কয়েকবার তুরস্ককে সামরিক সহযোগিতা প্রদান করেছে। যদিও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন গ্রিস ইচ্ছাকৃতভাবে তুরস্কের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের সামরিক সর্ম্পক অনেক পুরনো এবং তা আরো ঘনিস্ট হয়েছে।

তুরস্কের বিমান বাহিনীতে পাইলটের সংখ্যার ঘাটতি অজানা কোনো বিষয় নয়। এ ঘাটতি পূরণে যে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কিংবা বন্ধু প্রতীম কোনো দেশের কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার অধিকার তুরস্কের রয়েছে। তবে, ২০১৯ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানের সাথে যৌথভাবে তুরস্ক একটি সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়ায় পাকিস্তানের দিকে অনেকে সন্দেহের তীর ছুড়েছেন। তাছাড়া এরদোয়ানের সাথে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের হৃদ্যতাও এখন সর্বজনবিদিত। এ কারণেও অনেকে দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে গ্রীসের রাডারকে ফাঁকি দিয়ে তুরস্কের বিমান বেশ কয়েকবার গ্রীস সীমার ভেতরেও ঢুকে গিয়েছিল। গ্রীস দাবি করছে, পাকিস্তানি পাইলটদের পারদর্শিতার কারণেই তুরস্ক এ কাজটি করার দু:সাহস করেছে। আর এ অজুহাতে গ্রীস আবার পাকিস্তানের চির প্রতিদ্বন্দী ভারতের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা করছে। যদিও গ্রীস একটু হতাশ হয়ে পড়েছে কারণ ভারত এখনো পর্যন্ত তুরস্কের সাথে সর্ম্পকের অবনতি হয় কিংবা গ্রীসের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়ার মতো পদক্ষেপ নেয়নি। এরপরও গ্রীস ভারতের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করছে অনেকটা তুরস্ক-পাকিস্তার সামরিক সর্ম্পকের কারনে।

গত বছরের নভেম্বরে গ্রীস হঠাৎ করেই পাকিস্তানের সমালোচনা করে। এথেন্সের অভিযোগ ছিলো পাকিস্তান পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সাথে মিলে একটি যৌথ নৌ মহড়ার সময় গ্রীসের সীমানা অতিক্রম করেছে। আংকারা অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের মতে গ্রীস ঈর্ষা করেই এসব বলছে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ অভিযোগ সর্ম্পকে বলেন, এ যৌথ মহড়া ছিল সা¤প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড়ো মহড়া যেখানে ১৫টি দেশের ৪৮টি জাহাজের ৪ হাজার ৭শ মানুষ অংশগ্রহন করেছে।

গ্রীস পাকিস্তনের বিরুদ্ধে পি-থ্রি অরিয়ন বিমান চালিয়ে গ্রীসের আকাশসীমা অতিক্রম করারও অভিযোগ তুলেছে। গ্রীস বলছে, এর আগে এভাবে কেউ তাদের আকাশসীমা অতিক্রম করার সাহস দেখায়নি। গ্রীস কর্তৃপক্ষর আশংকা আছে যৌথ মহড়ার এ ঘটনার মাধ্যমে পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যকার সম্পর্ক আসলেই ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।

যৌথ মহড়া শেষ হওয়ার পর তুর্কী মিডিয়া ইয়েনি সাফাক জানায়, তুরস্ক দক্ষিন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যে নিরাপত্তা ব্যুহ্য তৈরি করেছে পাকিস্তান তার একটি অংশ হয়ে আছে। পত্রিকাটি আরো জানায়, পাকিস্তানি নৌ যুদ্ধযান আলমগীর ফ্রিগেট এবং পি-থ্রি এয়ারক্রাফট ভবিষ্যতেও তুর্কী নৌ বাহিনীর সাথে যৌথভাবে দক্ষিন পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় টহল দেয়া অব্যহত রাখবে।

২০১৯ সালের নভেম্বরে তুরস্ক ও পাকিস্তানের এ যৌথ মহড়ার পর থেকে শুধু গ্রীস নয় বরং তুরস্কের অন্যন্য প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যেও নানামুখী আশংকার জন্ম হয়েছে।২০১৬ সালের অভ্যুত্থানের পর বিমান বাহিনীতে যে সংকট দেখা দেয় তা কাটিয়ে উঠতে বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের উদ্যেগ নিয়েছে। তারা তাদের আকাশ ও স্থল প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা বৃদ্ধি করছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন বিমান বাহিনীতে এ ঘাটতি থাকার কারণেই তুরস্ক ড্রোন, এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল সিস্টেমসহ অন্যন্য নিরাপত্তা কৌশলের দিকে ঝুঁকছে।

যুদ্ধবিমানের পাইলটদের ব্যয় নির্বাহ কখনোই খুব সস্তা নয়। মার্কিন বিমান বাহিনীর হিসেবে এফ থার্টি ফাইভের মতো বিমানের নুতন একজন পাইলটের প্রশিক্ষনের জন্য প্রায় ১১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। আর যারা অভিজ্ঞ তাদের খরচ মেটাতে যে টাকা খরচ হয় তার হিসেব করাও কঠিন। সাধারণভাবে কেউ এ অংক ধারণাও করতে পারবে না।

অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এরদোয়ান যখন বিপুল সংখ্যক পাইলটকে চাকুরিচ্যুত করেন তখন পশ্চিমা অনেক দেশই এরদোয়ানের সমালোচনা করেছিল। তাদের মতে, এসব পাইলটের পেছনে বিগত অনেক বছর সময় দেয়া হয়েছে, অনেক অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এভাবে চাকুরিচ্যুত করায় পুরো বিনিয়োগটাই বিফলে গেলো। কিন্তু এরদোয়ানের পক্ষে এমনটি করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ চাকুরিচ্যুত এসব পাইলটের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই সেনা শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণ হয়েছিল।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে