মিগ টুয়েন্টি নাইন নিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে জটিলতা

সামরিক বিশ্লেষকরা বহু আগে থেকেই এ বিমানের পারদর্শিতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ছবিটি তুলেছেন ভ্লাদিমির কারনোজোই - এআইএন

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:৩৮

ভারতীয় নৌ বাহিনী জানিয়েছে যে, সম্প্রতি একটি মিগ টোয়েন্টি নাইন প্রশিক্ষণ বিমান আরব সাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে। ভারতের বিমান বাহিনীতে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ভারতীয় বিমান বহরের অন্যন্য বিমানগুলোকে যেভাবে সাম্প্রতিক সময়ে আপগ্রেড করা হয়েছে, বিধ্বস্ত হওয়া মিগ টোয়েন্টি নাইনকে সেভাবে উন্নত করা সম্ভব হয়নি।

সামরিক বিশ্লেষকরা বহু আগে থেকেই এ বিমানের পারদর্শিতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন ভারতীয় নৌ বাহিনী প্রধান এডমিরাল সুনিল লানবা জানিয়েছিলেন, মিগ টোয়েন্টি নাইনের কার্যক্রম পরিচালনায় কিছু ত্রুটি দেখা দিয়েছিল তবে সেগুলোর সমাধান করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছিলেন, মিগ টোয়েন্টি নাইনগুলো এখন যেকোনো অপারেশন ও প্রশিক্ষন কার্যক্রমের জন্য সঠিক মানে আছে। অথচ মাত্র এক বছরের মধ্যে এ তিনটি মিগ টোয়েন্টি নাইন বিধ্বস্ত হয়েছে।

মিগ টোয়েন্টি নাইনকে হলো রাশিয়ার তৈরি একটি যুদ্ধ বিমান। গত বছরের নভেম্বরে একটি মিগ টোয়েন্টি নাইন প্রশিক্ষন বিমান দক্ষিন গোয়ার ভার্না গ্রামের কাছে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। এরপর গত ফেব্রয়ারীতে আরেকটি মিগ টোয়েন্টি নাইনকে বিমানও গোয়াতেই বিধ্বস্ত হয়। যদিও এ বিমান বিধ্বংসের পেছনে বিমানের ডানায় ও হুইলে পাখি আটকে যাওয়াকেই দায়ী করা হয়। এ দুটি বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় অবশ্য পাইলট নিজেকে বিমানের বাইরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ২০২০ সালের মে মাসে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি মিগ টোয়েন্টি নাইন বিমান প্রশিক্ষণ মহড়া চালানোর সময় পাঞ্জাবের হশিয়ারপুর জেলায় বিধ্বস্ত হয়।

২০১৬ সালে ভারতের কম্পট্রোরার এন্ড অডিটর জেনারেল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সে প্রতিবেদন অনুযায়ী মিগ টোয়েন্টি নাইন বিমানের সার্ভিস মান খুবই অসন্তোষজনক। ২০১৫ সাল অবধি এ বিমানের পারফরমেন্স হার ছিল মাত্র ৩৭দশমিক ৬৩ শতাংশ। পরবর্তীতে নির্মাতা দেশ রাশিয়া ও ভারত মিলে যৌথভাবে বিমান উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরপর বিমানটির পারদর্শিতা ও সেবার মান ৭০ শতাংশে উন্নীত হয় বলেও নীতি নির্ধারক মহল থেকে দাবি করা হয়।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, কার্যকারিতা ও পারফরমেন্স নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়ায় এক সময় ৪৫টি মিগ টোয়েন্টি নাইন বিমানের মধ্যে মাত্র এক তৃতীয়াংশ বিমানকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছিল। ভারতে যে দুটো রণতরী আছে সেগুলো হলো আইএনএস বিক্রমাদিত্য এবং আরেকটি যুদ্ধজাহাজ এখনো নির্মানাধীন। কিন্তু এ যুদ্ধ জাহাজ দুটো মিগ টোয়েন্টি নাইন বিমান পরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই ভারতীয় সামরিক মহল চাইলেই হুট করে এ বিমানের ব্যবহারকে কমিয়ে আনতে পারছে না।

মিগ টোয়েন্টি নাইন যুদ্ধবিমানগুলোকে দেশটির দুটো নৌ ঘাটি তথা দেশের পূর্ব উপকূলীয় এলাকার বিশাখাপত্তমের আইএনএস দেগা এবং পশ্চিম উপকূলে গোয়ার আইএনএস হানসায়ও মোতায়েন করা হয়েছে। মূলত এ দুটো নৌ ঘাটি হলো ভারতীয় নৌ বাহিনীর প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের মূল সূতিকাগার।
চীনের সাথে সীমান্ত নিয়ে টানাপোড়েনের মাঝেই ভারতের ডিফেন্স এক্যুইজিশন কাউন্সিল গত জুলাইতে আরো ২১টি মিগ টোয়েন্টি নাইন বিমান কেনার এবং ৫৯টি মিগ টোয়েন্টি নাইন যুদ্ধবিমানকে উন্নত করার অনুমোদন দেয়। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং নিজেই এই ডিফেন্স একুইজিশন কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন ২১টি বিমান ক্রয় নিয়ে রাশিয়ার সাথে ভারতের আলাপ আলোচনাও এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে।

একের পর এক বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর আবারও নতুন করে ৯৯১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সেই অকার্যকর মিগ টোয়েন্টি নাইন বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে বির্তক দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের বিমান বাহিনীর আর কোনো মিগ টোয়েন্টি নাইন বা মিগ থার্টি ফাইভ ক্রয় করা উচিত নয়। বরং বিকল্প হিসেবে ভারতের এখন রাফালে যুদ্ধ বিমান বা এফ-এইটিন বিমান ক্রয়ের দিকে ঝোঁকা উচিত।

৫০ বছরের পুরনো হওয়ায় এ বিমানটি এখনকার সময়ে ফরাসী রাফালে বা অন্যন্য পশ্চিমা দেশের যুদ্ধবিমানের সাথে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপ‚র্ণ নয়। ৮০’র দশকে ভারত এ বিমানের ব্যবহার শুরু করে। সে সময়ে এ বিমানটিকে একটি লো-এন্ড এবং এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটার হিসেবে গন্য করা হতো। রাফালে বিমানের তুলনায় মিগ টোয়েন্টি নাইনের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হলো এর রাডারটি খুবই দুর্বল। অন্যদিকে রাফালেতে একাধিক ডিরেকশনে কাজ করে এমন রাডার থাকায় তা দিয়ে ১শ কিলোমিটার দূরত্বে থাকা অবস্থাতেই হুমকিকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি, রাফালে দিয়ে একই সময়ে ৪০টি লক্ষ্যবস্তুকেও নির্নয় করা যায়।

বেশ কিছু দেশের ক্ষেত্রেও মিগ টোয়েন্টি নাইন ব্যবহারে সুবিধা পাওয়া যাবে বলে মনে করা হয়। এ কারণে ভারত রাশিয়ার তৈরি এ বিমানকে হুট করে ত্যাগ করতে পারছে না। আবার মিগ টোয়েন্টি নাইন দিয়ে বারবার দুর্ঘটনার পরও পশ্চিমা নতুন কোনো বিমানের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না।

ভারতীয় বিমান বাহিনীতে আজ থেকে ৪ দশক আগে যখন এ বিমানের প্রয়োগ ও ব্যবহার শুরু হয়, তখন থেকেই এ বিমান থেকে দুর্ঘটনা ঘটার প্রবণতা ছিল। এমনকী সামরিক বিশ্লেষকরা সে সময়ে এ বিমানটিকে উড়ন্ত কফিন বা বিধবা বানানোর বিমান হিসেবে অভিহিত করতো। তার পরও মিগ টোয়েন্টি নাইন বিমানটিই ভারতের বিমান বাহিনীর মেরুদন্ডে পরিণত হয়।

ভারতে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রেও মিগ টোয়েন্টি নাইনের সমালোচনা হয়ে আসছে বহুদিন থেকেই। ২০০৬ সালে রং দে বাসন্তী নামে একটি সিনেমাও নির্মাণ করা হয় যার প্রেক্ষাপট ছিল মিগ টোয়েন্টি নাইনের ক্রয়ে দুর্নীতি এবং ক্রয় পরবর্তী দুর্ঘটনা। কিন্তু এত সব সমালোচনার পরও ভারতীয় বিমান বাহিনী কখনোই এ বিমানটিকে পুরোপুরি খারিজ করে দিতে চায়নি কখনোই।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর মতে মিগ টোয়েন্টি নাইন দিয়ে দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে কারণ এ বিমানটিই পাইলটরা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে উড্ডয়ন করে। ভারতীয় বাহিনী যত ঘন্টা মিগ টোয়েন্টি নাইন উড়িয়েছে অন্য কোনো বিমান এত লম্বা সময় ওড়াতে পারেনি। আর সে কারণেই ঐ বিমানগুলোর দুর্ঘটনার হার মিগ টোয়েন্টি নাইনের তুলনায় কম বলে মনে হয়।

ভারতের এ মিগ টোয়েন্টি নাইন বিতর্কের সুযোগ নিতে চায় মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং। এরই মধ্যে তারা এফ ফিফটিন এক্স ধরনের ভারী যুদ্ধবিমানগুলোকে ইসরাইল, ভারত ও কাতারে রফতানি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বোয়িং মার্কিন বিমান বাহিনীর সাথে একটি চুক্তিতেও উপনীত হয়েছে যার আওতায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ২শটি বোয়িং এফ-ফিফটিন এ´ জাতীয় যুদ্ধবিমান নির্মান করতে যাচ্ছে। এত বিপুল সংখ্যায় যুদ্ধবিমান তৈরিতে তাদের ২৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

এফ ফিফটিন এক্সকে ম্যাকডলেন ডগলাস এফ ফিফটিনের সবচেয়ে সর্বাধুনিক সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাতে দুটি ইঞ্জিন, সব ধরনের আবহাওয়ায় চলাচল সক্ষমতা, এবং ট্যাকটিকাল যুদ্ধ বিমানে পারদর্শিতা থাকবে। এ বিমানগুলো আকাশে নানা ভ‚মিকা পালন করতে সক্ষম হবে। বিশেষ করে এয়ার সুপেরিয়রিটি, ইন্টারসেপ্টর, বোমা বর্ষন, গ্রাউন্ড এ্যাটাক এবং শত্রæর কাঠামো ধ্বংস করে শত্রু সীমায় প্রবেশের ক্ষেত্রে এ বিমানগুলো খুবই কার্যকর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত হওয়ায় আকাশপথে এফ-ফিফটিন এ´ বিমানগুলোর পারদর্শিতা বর্তমানে ব্যবহৃত অনেক বিমানকেই ছাড়িয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। বোয়িংয়ের চতুর্থ প্রজন্মের নতুন এ বিমানটিকে ক্লাসিক ঘরানার এফ ফিফটিনের আদলেই নির্মান করা। তবে, আকৃতির দিক থেকে এ বিমানটির সাথে এসইউ এমকেআই’র কিছুটা সাদৃশ্য আছে। বোয়িং দাবি করছে, পরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এ বিমান দিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতেও ভালো মানের সেবা পাওয়া সম্ভব হবে।

বোয়িং এডভান্সড প্রযুক্তির এই এফ ফিফটিন স্ট্রাইক ইগলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর কাছে বিশেষ করে ইসরাইল ও ভারতের কাছে বিক্রি করতে চায়। এরই মধ্যে ইসরাইল ২৫টি সর্বাধুনিক এফ-ফিফটিন এস কেনার এবং ইসরাইলের হাতে থাকা ২৫টি এফ ওয়ান ফাইভ আই বিমানের সংস্কারের বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে।

প্রথম দেশ হিসেবে ইসরাইলই বিশ্বে সবার আগে এফ ফিফটিন ইগল যুদ্ধবিমানকে সিরিয়ার আকাশে উড্ডয়ন করেছে। এ বিমানগুলো দিয়েই ইসরাইল সিরিয়ার ব্যবহৃত ১৯৮০ সালের বিমানগুলোকে সফলতার সাথেই ধরাশায়ী করেছে। আর এফ ফিফটিন ইগল হাতে থাকার কারণে ইসরাইল মধ্যপ্রচ্যে একটি শক্তিশালী অবস্থানেও চলে গেছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে