মার্কিন এফ-৩৫ নাকি রুশ সু-৩৫, কোনটি এগিয়ে

রুশ সু-৩৫ - ডিফেন্সনিউজ

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০২ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৩৭

সামরিক শক্তির লড়াইয়ে বিশ্বের প্রতিনিয়ত চলছে প্রতিযোগিতা। কে কার চেয়ে এগিয়ে যাবে, কার অস্ত্র কতটা শক্তিশালী হবে এ লড়াই বহু বছরের পুরনো। আর আধুনিক বিশ্বে এ লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় দুই প্রতিযোগী যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।

শত্রুর হামলা ঠেকানো, আর পাল্টা হামলা করার নতুন নতুন অস্ত্র ও উপকরণ আবিষ্কার যেন নেশায় পরিণত হয়েছে দুই পক্ষের। যুক্তরাষ্ট্রের আছে এফ-থার্টিফাইভ আর রাশিয়ার আছে সু-থার্টিফাইভ। চলুন জেনে আসি এ দুটি বিমানের শক্তি, দুর্বলতাসহ নানা দিক।

আকাশপথে লড়াই ও আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সোভিয়েত যুগের যুদ্ধ উপকরণগুলো বদলে রাশিয়া এনেছে নতুন নতুন উপকরণ। সু-থার্টি ফাইভ যুদ্ধ বিমান তার উৎকৃষ্ট উদারহরণ। পুরো নাম সুখোই সু- থার্টিফাইভ। ন্যাটো যার কোড নেম দিয়েছে ফ্ল্যাঙ্কার এফ। যুদ্ধবিমানটির নির্মাতা রাশিয়ার কমসোমোলস্ক এয়ারক্রাফট প্রোডাকশন অ্যসোসিয়েশন।

১৯৮৮ সালে তৈরি সু-টুয়েন্টি সেভেন এম যুদ্ধবিমানকে আরো আধুনিক ও উন্নত করে তৈরি করা হয়েছে সু-থার্টিফাইভ। যেটি রুশ বিমানবাহিনীর বহরে যুক্ত হয়েছে ২০১৪ সালে। যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় আনুমানিক ৪০ থেকে ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এক সিট ও দুই ইঞ্জিনের বিমানটির সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। একবার জ্বালানি নিয়ে উড়তে পারে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। আর হামলার সীমা ১৬ কিলোমিটার।

বিমানটি আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে মাটিতে এবং জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল বহন করতে পারে। আছে এন্টি রেডিয়েশন মিসাইলও বহনের ক্ষমতা। চারশো কিলোমিটার দূর থেকেও এটি টার্গেট চিহ্নিত করতে পারে। এর রাডারের রয়েছে এক সাথে ৩০টি টার্গেট চিহ্নিতকরার ক্ষমতা। প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক বিমান এফ-থার্টিফাইভের সামনে কতটা কার্যকর হবে এটি?

যুক্তরাষ্ট্রের আছে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এফ-থার্টিফাইভ। লকহিড মার্টিসন অ্যারোনটিকসের নির্মিত বিমানটি একসিট ও এক ইঞ্জিনের। তবে এটির নজরদারি ক্ষমতা, টার্গেটে হামলা করার ক্ষমতা অপ্রতিদ্ব›দ্বী। এর সর্বোচচ্ গতিসীমা প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটার । তবে সেন্সর, রাডার, অ্যাটাকিং পাওয়ার ইত্যাদি প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটি যে কোন বিমানের চেয়ে এগিয়ে। ২০১৫ সাল থেকে বিমানটির তিনটি মডেল পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয়েছে মার্কিন বিমান বাহিনীতে। প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় ৮০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার। পঞ্চম প্রজন্মের এফ-থার্টিফাইভ আকাশ থেকে আকাশে হামলা ও প্রতিরক্ষায় সক্ষম, যদিও পেন্টাগন বলছে, এটি সব কাজই করার ক্ষমতা রাখে।

সর্বাধুনিক ও বহুমুখী এই যুদ্ধবিমানের বিশাল বহর রয়েছে মার্কিন বিমান বাহিনীতে। এমনকি রাশিয়া, চীনের মতো পরাশক্তিগুলোও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের বহর তৈরির পদক্ষেপ নিতে পারেনি। রাশিয়া তাদের সামরিক বাহিনীর জন্য অবশ্য সু-টুয়েন্টি সেভেনের বহর তৈরি করেছে; কিন্তু সেটি যুক্তরাষ্ট্রে এফ-থার্টিফাইভের মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। আর যে কারণে তারা এই বিমানটির উন্নত সংস্করণ হিসেবে এনেছে সু-থার্টিফাইভ। সু-থার্টিফাইওভর ইঞ্জিন, গতি, যুদ্ধও করার ক্ষমতা সব কিছুতেই এসেছে উন্নতি। আকাশে এই দুটি যুদ্ধবিমানের মধ্যে সরাসরি লড়াই হলে কে জিতবে? ধরুণ যদি চারটি মার্কিন এফ-থার্টিফাইভ ও চারটি রুশ সু-থার্টিফাইভ যুদ্ধবিমানের মধ্যে লড়াই শুরু হয় তাহলে জয়ের পাল্লা কোন দিকে ভারি হবে?

এক্ষেত্রে সামরিক বিশ্লেষকদের মাঝেও মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলছেন, এমন লড়াই শুরু হলে মার্কিন এফ-থার্টিফাইভ কোর্স চেঞ্জ করে ডেকে আনবে তাদের সহযোগিত এফ-টুয়েন্টি টু র‌্যাপটর্স এবং এফ-ফিফটিন সিএস ফাইটারকে। যে দুটি বিমানের আকাশ পথে লড়াইয়ের ক্ষমতা বেশি, অন্য দিকে এফ-থার্টিফাইভ হয়তো তার টার্গেটে হামলা করতেই বেশি পছন্দ করবে।

আবার কেউ বলছেন, মার্কিন এফ-থার্টিফাইভ যুদ্ধবিমান যদি তার সবগুলো ডিভাইস ব্যবহার করতে পারে তাহলে সেটি রাশিয়ার সু-থার্টি ফাইভের চেয়ে এগিয়েই থাকবে।

আমস্টারডামভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ট্রান্সন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের প্রতিরক্ষা এডিটর দেব মজুমদার বলেছেন, এ জন্য এফ-থার্টিফাইভের পাইলটকে তার স্টেলথ এবং অনবোর্ড, অফবোর্ড সেন্সর ব্যবহার করতে পারতে হবে। এফ-থার্টিফাইভ যদি তার দুর্বলতাগুলো এড়িয়ে, শক্তিকে ব্যবহার করতে পারে তবে সেটিই সেরা বলে মত এই বিশেষজ্ঞের। যেমন, শত্রæ বিমানের দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে লড়াই করতে না পারলে এফ-থার্টিফাইভ ধরাশায়ী হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র তার এফ-টুয়েন্টি টু র‌্যাপটরকে যেভাবে আকাশ থেকে আকাশে লড়াইয়ের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তৈরি করেছে, এফ-থার্টিফাইভ সেই জায়গায় কিছুটা পিছিয়ে। র‌্যাপটর যতটা উচুতে উঠতে এবং সুপারসনিক গতিতে চলতে পারে, এফ-থার্টিফাইভের গতি সে তুলনায় কিছুটা কম। এছাড়া ডগফাইট অর্থাৎ আকাশে দুই যুদ্ধবিমানের সরাসরি সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও র‌্যাপটর খুব দ্রুত শত্রুর বিমানকে ধ্বংস করতে পারবে। দ্রুত বাক নেয়া, হামলার অ্যাঙ্গেল নির্দিষ্ট করা, যে কোন উচ্চতায় সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতাও র‌্যাপটরের বেশি। এফ-থার্টি ফাইভ অপেক্ষাকৃত কম গতি ও কম উচ্চতায় সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করতে পারে, তাই এটি তার সেরা পারফরম্যান্স দেখাতে তখনই পারবে, যখন শত্রুর বিমান মনোযোগ হারাবে।

এফ-থার্টিফাইভ সর্বোচ্চ গতি ও উচ্চতায় থেকেও মিসাইল ছোড়ার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ শক্তিমত্তা প্রয়োগ করতে পারে না। মিসাইল বহনের ক্ষমতাও কম, এছাড়া ডিজিটাল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার এই যুদ্ধবিমানের রাডারকেও দুর্বল করতে পারে। তাই তো অনেকে বলছেন, ডগফাইটের ক্ষেত্রে এই বিমানটির পাইলটের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাই তাকে কেবলমাত্র ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে।

নিঃশব্দে চলার ক্ষমতাসম্পন্ন এফ-থার্টিফাইভ শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ অস্ত্রগুলোই ব্যবহার করতে পারে। এতে এআইএম-৯এক্সের মতো আধুনিক এয়ার টু এয়ার মিসাইল বহনের ক্ষমতা নেই। কাজেই সমর বিশেষজ্ঞরা বলেন, এফ-থার্টিফাইভর পাইলটকে অবশ্যই যেকোন মূল্যে কাছ থেকে লড়াইয়ের পন্থা পরিহার করতে হবে। কাজেই ইউএস জয়েন্ট এয়ার কমপোনেন্ট কমান্ডার, বিকল্প কোন পদ্ধতি হাতে থাকতে যে এফ-থার্টিফাইফকে আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামাবে না সেটি বোঝাই যাচ্ছে।

এই যুদ্ধবিমানটি আসলে গোপনে প্রতিপক্ষের টার্গেটে হামলার করার ক্ষেত্রেই বেশি দক্ষতা সম্পন্ন। মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্য নয়। বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর জন্য বিভিন্ন দেশের বিমান বহরের চেয়েও বড় হুমকি হচ্ছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই প্রতিরক্ষ ব্যবস্থা ভাঙতে এফ-থার্টিফাইভ কতটা কার্যকর হবে সেটি অবশ্য বড় প্রশ্ন।

মার্কিন বিমান বহরে বোয়িংয়ের তৈরি এফ-ফিফটিন সি ইগল সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৪০ বছর ধরে, আরো কয়েক দশক হয়তো বিমানটি মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলোর সেরা একটি হয়ে থাকবে। পুরনো মডেলের হলেও এখনো বিমানটি আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে অনেক দিক থেকেই এগিয়ে। লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ-টুয়েন্টি টু শুধুমাত্র এটির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আর বিদেশী যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে এফ-ফিফটিনের জন্য একমাত্র হুমকি হতে পারে রাশিয়ার সু-থার্টিফাইভ।

আবার রাশিয়া যদি বিমানটি বিদেশে রফতানি শুরু করে তবে আরো বড় সমস্যায় পড়বে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ইতোমধ্যেই ইন্দোনেশিয়া এই যুদ্ধবিমানটি কিনতে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। চীনও হতে পারে পরবর্তী ক্রেতা। চীনা বহরে এই বিমানটি যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও এসেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে।

সু-থার্টি ফাইভ সত্যিকার অর্থেই এক বিপজ্জনক ওয়ার মেশিন। অনেক দিক থেকেই এটি ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-ফিফটিন ইগলের ক্ষমতাকে। সর্বোচ্চ গতির প্রশ্নে রাশিয়ান সু কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এর রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী দুটি ইঞ্জিন। অপেক্ষাকৃত কম কার্গো লোড করা হলে সু পেতে পারে সুপারসনিক গতি। যার ফলে সেটি ছাড়িয়ে যাবে এফ-ফিফটিনকে।

মার্কিন এফ-থার্টিফাইভ। ছবি : ডিফেন্সনিউজ
মার্কিন এফ-থার্টিফাইভ। ছবি : ডিফেন্সনিউজ

 

সর্বোচ্চ উচ্চতায়ও সুপারসনিক গতিতে ছুটতে পারাই সু-থার্টিফাইভের সবচেয়ে বড় সুবিধা। আর এটি অপেক্ষাকৃত কম গতিতে ছুটলেও অন্যদের ধরার ছোয়ার বাইরে থাকার ক্ষমতা রাখে। এর রয়েছে থ্রি ডাইমেনশনাল থ্রাস্ট ভেক্টরিং পাওয়ার, তাই কম গতিতে ছোটার সময়ও অবিশ্বাস্য রণকৌশল দেখাতে পারে। এর রয়েছে হেলমেট মাউন্টেট সিস্টেম অর্থাৎ পাইলটের হেলমেট তার চোখের সামনে সব তথ্য হাজির করে।

এছাড়া আছে এআইএম-নাইনএক্স ও রাশিয়া আর-সেভেনটি থ্রি বোরসাইট মিসাইল বহন ও ছোড়ার ক্ষমতা। যেটি পারে না যুক্তরাষ্ট্রের এফ-থার্টিফাইভ। আবার দৃষ্টি সীমার মধ্য থেকেই লড়াইয়েও এই ফাইটার শত্রæবিমানকে ধ্বংস করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পুরোপুরি নিখুঁত হতে পারেনি এখনো এটি। নির্ভর করতে হয় পাইলটের দক্ষতা এবং ভাগ্যের ওপর। তবুও মার্কিন এফ-থার্টিফাইভের চেয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে এই রাশিয়ান বিমানটি।

তবে রাডারের দক্ষতায় সু-থার্টিফাইভ কিছুটা পিছিয়ে থাকবে। মার্কিন এফ-থার্টিফাইভ শুধু নয়, এফ-ফিফটিন ইগলের চেলেও এর রাডারের ক্ষমতা কিছুটা কম। তবে সেন্সরের সার্চ এন্ড ট্র্যাক সিস্টেমে আবার এগিয়ে থাকবে সু-থার্টিফাইভ। এর আছে ইনফ্রারেড সার্চ সিস্টেম। যেটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বহরে যুক্তহবার অপেক্ষায়। আর আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল বহনের ক্ষমতাও সু-থার্টিফাইভের বেশি। তাই মুখোমুখি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়ার যুদ্ধবিমানটিকেই এগিয়ে রাখতে হবে। অন্য দিকে মার্কিন যুদ্ধ বিমানটি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, ইন্টেলিজেন্স ও সার্ভেল্যান্স দক্ষতায় এগিয়ে রাখতে হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে