মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্রবাজারের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে আমেরিকা

মধ্যপ্রাচ্যে সমরাস্ত্রের বড় ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলো আমেরিকা - রয়টার্স

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৪ আগস্ট ২০২০, ০১:১৫

মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্রের লোভনীয় বাজারে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রি করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। বিশাল এই বাজারে চীন ও রাশিয়াকে ঠেকাতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র। তবে ভূরাজনৈতিক নানা কারণে এ অঞ্চলে সমরাস্ত্র বিক্রি বাড়ছে এই দুই দেশের। মধ্যপ্রাচ্যের সমরাস্ত্রের বাজারের ভবিষ্যত রূপরেখা তুলে ধরব আজ।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল কেনেথ এফ ম্যাককেনজি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তার দেশ মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্রের বাজার দখলে রাখতে চায়। তারা চান না রাশিয়া ও চীন এখানে ভাগ বসাক। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক দেশ। দেশটির মোট অস্ত্র রফতানির ৫২ ভাগই কিনে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। গত ৫ বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র ক্রেতা হচ্ছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের অস্ত্রের বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই অস্ত্রের বাজারে সম্প্রতি ভাগ বসাতে শুরু করেছে চীন ও রাশিয়া। তবে এখনো তাদের অস্ত্র রফতানি খুব বেশি নয়।

রাশিয়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র বিক্রিতে সাফল্য পেতে শুরু করেছে। মিশর ও তুরস্কে অস্ত্র রফতানি করেছে দেশটি। এ দুটি দেশই দীর্ঘদিন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং অস্ত্রের ক্রেতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া মিশরে রফতানি করেছে মিগ যুদ্ধবিমান, কেএ-ফিফটি টু নামের অ্যাটাক হেলিকপ্টার এবং এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র। তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে কিনেছে অত্যাধুনিক এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে কাটসা নামের একটি আইনে সাক্ষর করেন যেখানে রাশিয়ার অস্ত্র কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ফলে ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক ২৫০ কোটি ডলারে রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার পর আংকারার ওপর কাটসা প্রযোজ্য হয়। এ নিয়ে বিরোধে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ-থার্টি ফাইভ স্ট্রাইক বিমান তৈরির যৌথ কর্মসূচি থেকে বাদ দেয়। দৃশ্যত উত্তেজনা প্রশমনে তুরস্ক এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কার্যকর করা পিছিয়ে দিয়েছে যাতে কাটসা তাদের ওপর প্রয়োগ করা না হয়।

তবে তুরস্ক সরকার বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে তারা এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কার্যকর করা পিছিয়ে দেয়নি। গত এপ্রিল মাসে এটি কার্যকর করার কথা ছিল। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে তারা এটি কার্যকর করা পিছিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি থাকলেও তারা এটি কার্যকর করবেই।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তুরস্ক বরং অদূর ভবিষ্যতে আরো এক ব্যাচ এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনতে চায়। আংকারার এই ঘোষণায় দেখা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিকে পাত্তা দিচ্ছে না ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তুরস্ক। রাশিয়া থেকে তুরস্ক সমরাস্ত্র কিনবেই।

আবার তুরস্কের অপছন্দের মিশরের সেনা শাসক আব্দুল ফাত্তাহ সিসির সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলারে অত্যাধুনিক এসইউ -৩৫ জঙিবিমান কেনার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র মিশরকেও হুমকি দিচ্ছে যে রুশ সমরাস্ত্র কিনলে তাদের ওপরও কাটসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

রাশিয়ার পাশাপাশি চীনও এখন মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্রের বাজারে প্রবেশ করছে। এক্ষেত্রে চীন একটি বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে একটি চুক্তি রয়েছে যে তারা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন তৈরিতে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে না। চীন এই চুক্তিতে সাক্ষর করেনি। ফলে তাদের ওপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। ইসরাইলও এই চুক্তিতে সই করেনি। ফলে তারাও অন্য দেশগুলোতে ড্রোন বিক্রি করছে।

তুরস্ক নিজেই ক্ষেপণাস্ত্র ড্রোন তৈরি করছে এবং ইরাক ও জর্ডানে বিক্রি করছে। আবার চীনের তৈরি ড্রোন এখন ইয়েমেন ও লিবিয়ার যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখন চুক্তির নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাইছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করতে চায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন বিক্রি শুরু করলে এসব দেশ চীনের পরিবর্তে তাদের ড্রোনকেই বেছে নেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সৌদি আরবের হাতে থাকা একমাত্র ক্ষেপণাস্ত্র চীন থেকে কেনা। ডিএফ-থ্রিএ নামের ওই ক্ষেপণাস্ত্র সৌদি সরকার আশির দশকে অতি গোপনে চীন থেকে কিনেছিল। এরপর ২০০৭ সালে আবার চীন থেকে ডিএফ -২১এস ক্ষেপণাস্ত্র কেনে সৌদি আরব। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মত সেগুলো প্রদর্শন করা হয়। প্রতিবেশী কাতারও চীনের তৈরি স্বল্প পাল্লার এসওয়াই -৪০০ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে। ২০১৭ সালে কাতারের সামরিক বাহিনী তা প্রদর্শন করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া একটি বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে তার প্রয়োগের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে। কিন্তু চীন ও রাশিয়া কোনো শর্ত দেয় না। তাদের ভাষ্য হলো-অস্ত্র কেনার পর ক্রেতা সেটি কীভাবে ব্যবহার করবে তা একান্তই তার মর্জি। এক্ষেত্রে বিক্রেতা কোনো শর্ত দিতে পারে না।

ইরাকও রাশিয়ার অস্ত্রের দিকে ঝুঁকছে। তারা দেখতে পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ সিক্সটিন জঙিবিমান কিংবা এমওয়ান এওয়ান আব্রাম ট্যাংকস থাকার চেয়ে চীন ও রাশিয়ার সমরাস্ত্র থাকলে বেশি সুবিধা। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের পর থেকেই এফ সিক্সটিন জঙিবিমান ব্যবহার করছে বাগদাদ। ইসলামিক স্টেটের জঙিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ৩৬টি এফ সিক্সিটিন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে তা পেতে তাদের অনেক দেরি হয়। তার আগেই ইরাক সরকার রাশিয়ার এএন ৩২এস পরিবহন বিমান এবং রাশিয়া ও ইরানের সরবরাহ করা এসইউ-২৫ অ্যাটাক জঙিবিমান ব্যবহার করতে শুরু করে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জঙিবিমানের খুচরা যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় না।

চলতি বছরের শুরুর দিকে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। তখন ইরাকে বাগদাদের বিমানঘাটি থেকে মার্কিন সেনাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। তারপর থেকেই এফ সিক্সটিন জঙিবিমানগুলো ঘাটিতে পড়ে আছে। সপ্তাহে দুবার তাদের ইরাকের আনবার প্রদেশে আইএস জঙ্গিদের গতিবিধির ওপর নজরদারি করার কথা থাকলেও সেগুলো আর উড়ছে না।

ইরাকের একজন কর্মকর্তা তো বলেই ফেলেছেন যে এফ সিক্সটিনের দফা রফা গেছে। অথচ মাত্র পাচ বছর আগ থেকে এই বিমান নিতে শুরু করেছিল ইরাক। এমআই ট্যাংক নিয়েও বিপাকে পড়েছে ইরাক সরকর। শর্ত ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এইসব ট্যাংক শিয়া মিলিশিয়ারা ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ কারণে এর রক্ষণাবেক্ষণ বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইরাক আর এগুলো ব্যবহার করতে পারছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে রাশিয়ার তৈরি টি-৯০ ট্যাংক কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে ইরাক। অদূও ভবিষ্যতে ইরাক যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে রাশিয়ার সমরাস্ত্রই বেশি ব্যবহার করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এসব ঘটনার আগ থেকেই ইরাক সরকার আমেরিকার অ্যাপাচে বিমানের চেয়ে রাশিয়ার অ্যাটাক হেলিকপ্টার বেশি করে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। রাশিয়ার অস্ত্রের কম মূল্য এবং দেশটির অস্ত্র ব্যবহারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে ইরাকের।

যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রুশ অস্ত্রেও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ এবং খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহও নিশ্চিত করে রাশিয়া। আবার এসব হেলিকপ্টার সরবরাহের পর রাশিয়া এগুলো ব্যবহারের ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে ইরাক।

ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যেও দেশগুলো ইরানের প্রভাব যত বাড়বে রাশিয়া ও চীনের অস্ত্র ব্যবসা ততটাই জমজমাট হবে সেখানে। কারণ ইরান চাইবে আমেরিকার অস্ত্র কেনা যে কোনো ঠেকিয়ে দিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের জেনারেল ম্যাককেনজি যে দাবি করেছেন, চীন ও রাশিয়ার অস্ত্র রফতানি ঠেকাতে তারা সফল হয়েছেন, তা সর্বাংশে সত্য নয়। যেমন ইয়েমেনে যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের ওপর অস্ত্র রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে রিয়াদও রাশিয়ার দিকে ঝুকে পড়বে।

এসব ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে যে মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্রের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ক্রমশই শিথিল হয়ে পড়ছে। তবে সহসাই চীন ও রাশিয়া তাদের জায়গা দখল করতে পারবে না।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে