চীনের নৌশক্তি মোকাবিলায় আমেরিকা যা করছে

যুক্তরাষ্ট্র নেভির সাবেক অনেক কর্মকর্তা মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র নেভি বর্তমানে অনেক দুর্বল অবস্থায় রয়েছে - এশিয়া টাইমস

  • মেহেদী হাসান
  • ১৮ আগস্ট ২০২০, ২১:৩৫

চীনকে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ দিন ধরে ইন্দো-প্যাসেফিক কমান্ডের শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। একই সাথে এ অঞ্চলে তার মিত্র ও বন্ধু ভাবাপন্ন দেশগুলোর সাথে সামরিক চুক্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা সম্পর্ক গড়ে তুলছে। কিন্তু এর কোন কিছুকেই চীনকে মোকাবেলায় যথেষ্ট মনে করছেন না অনেক বিশ্লেষক। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি সাবরিনা কাজী। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কৌশল নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

যুক্তরাষ্ট্র নেভির সাবেক অনেক কর্মকর্তা মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র নেভি বর্তমানে অনেক দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। গত প্রায় দুই দশক ধরে বড় কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো প্রস্তুতি নেয়নি ইউএস নেভি। ফলে তাদের কার্যক্রম অনেক সঙ্কুচিত হয়েছে। বড় ধরনের যুদ্ধে প্রতিপক্ষের হামলায় দিনে কয়েকটি করে শক্তিশালী রণতরী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এসব বিবেচনায় তেমন বাড়ানো হয়নি রণতরীর সংখ্যা।

বিশেষ করে এমফিবিয়াস এসল্ট শিপের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে ১০টি এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়াস্প ক্লাসের এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ ইউএসএস বনহোম রিচার্ড আগুন লেগে অকেজো হয়ে গেছে। ফলে এ সংখ্যা নেমে এসেছে চারটিতে। যুক্তরাষ্ট্র নেভি কর্মকর্তারা চিন্তিত এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

অবসরপ্রাপ্ত ইউএস মেরিন কর্পস কর্মকর্তা ও সাবেক ক‚টনীতিক গ্রান্ট নিউশাম যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তাব দিয়েছেন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মিত্র দেশগুলো নিয়ে মাল্টিন্যাশনাল এমফিবিয়াস টাস্ক ফোর্স গঠনের। চীনকে মোকাবেলায় টাস্ক ফোর্স গঠনকে সবচেয়ে ভালো কৌশল বলে মনে করেন তিনি।

দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিমানবাহী রণতরী এখন মহড়া পরিচালনা করছে । বিশেষজ্ঞদের মতে এর মানে এখানে এখন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি নৌ বাহিনী রয়েছে। এর একটি বিরোধীদের নরকের ভয় দেখানোর জন্য। আরেকটি শত্রুদের মাথা খামচাতে বাধ্য করার জন্য।

চীন নীরবে নৌশক্তি বাড়িয়ে চলছে। গত ১০ মাসে চীনা নেভি দুটি টাইপ ০৭৫ এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ নামিয়েছ। আরো একটি চীনা নেভিতে যোগ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র নেভি সম্প্রতি ইউএসএস ত্রিপোলী নামে নতুন একটি এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ যোগ করেছে তাদের নেভিতে। আর দুই সপ্তাহ আগে সানদিয়াগো ঘাটিতে সার্ভিসিংয়ের সময় আগুন লেগে ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ ইউএসএস বনহোম রিচার্ড।

বনহোম রিচার্ডকে ফিফথ জেনারেশনের এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার অপারেশনের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শেষ পর্যায়ে ছিল। বনহোম রিচার্ড বাদে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৯টি বিগ ডেক এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ রয়েছে। এসব এসল্ট শিপের মধ্যে বর্তমানে তিনটিতে এফ-৩৫ বিমান অপারেশন পরিচালনা করতে পারে। অপরগুলোতে ছোট যুদ্ধ বিমান ওঠা নামা করতে পারে।

বনহোম রিচার্ড ধ্বংস হওয়ায় বেশ চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্র নেভি। যুক্তরাষ্ট্রের একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলছেন, একটি এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ হারানোয় যুক্তরাষ্ট্র নেভি যদি এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তাহলে বোঝা যায় গত ২০ বছর ধরে তারা বড় কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়নি। কারন এ ধরনের যুদ্ধে এক বিকেলেই এ ধরনের কয়েকটি রণতরী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

এই বিশ্লেষক ব্যঙ্গ করে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উপক‚লীয় যুদ্ধ জাহাজ চীনা নেভির রণরতীরর বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধে ভাল করতে পারবে। আর ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে নির্মান করা হচ্ছে জুমওয়াল্ট ক্লাসের তিনটি ডেস্ট্রয়ার আর এর গান ঠিকমত কাজ করে না। একে একটি চরম ব্যর্থ প্রকল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

ইউএস নেভি ইচ্ছা করে ছাটাই করেছে জুনিয়র সারফেস ওয়ারফেয়ার অফিসার্স ট্রেনিং। এটা শুরু হয়েছিল ২০০০ সালে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে চীনা নেভিকে পরাজিত করার চেয়ে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এখন তাই ইউএস নেভি ক্রমে সঙ্কুচিত হচ্ছে আর চীনা নেভি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে।

যুক্তরাষ্ট্র নেভিতে বিমানবাহী রণতরী, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার এবং অন্যান্য রণতরী যতটা গুরুত্ব পেয়েছে ততটা গুরুত্ব পায়নি এমিফিবিয়াস এসল্ট শিপ। আর এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি অনেক সংখ্যায় এটি নির্মান করেও তবু চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়া কঠিন হবে। কারন চীন ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এমফিবিয়ায়স এসল্ট শিপের অধিকারী হয়ে গেছে।

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং বন্ধু দেশ জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়ার কাছে কমপক্ষে ৫০টি এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ রয়েছে। এর সবগুলো আধুনিক নয় কিন্তু এগুলো কাজে লাগানো যাবে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

জাপানের কাছে সাতটি এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ রয়েছে এবং এর মধ্যে দুটিতে এফ-৩৫ অপারেশন পরিচালনা করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে রয়েছে তিনটি এমফিবিয়াস এবং এর মধ্যে দুটি নতুন। এগুলো এফ-৩৫ বিমান অপারেট করতে পারে।

এ অবস্থায় মাল্টি ন্যাশনাল এমফিবিয়ায়স টাস্ক ফোর্স গঠন চীনের মোকাবেলায় হতে পারে একটি জোরালো পদক্ষেপ। অপারেশনাল এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটা নতুন বার্তা দেবে শত্রুপক্ষকে। আর একই সাথে এটা চাপ কমাবে আমেরিকান এমফিবিয়াস ফোর্সের ওপর।

ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপে যেমন থাকে একটি বিমানবাহী রণতরী, ডেস্ট্রয়ার, ক্রুজার, সাপ্লাইশিপসহ সাড়ে সাত হাজার নৌ সেনা তেমনি একটি এমফিবিয়াস রেডি গ্রুপে বা এআরজিতে থাকে তিনটি এমফিবিয়াস, ২ হাজার সশস্ত্র মেরিন সেনা, যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য সাপ্লাই শিপ।

এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলে বর্তমানে মাত্র একটি ফরওয়ার্ড ডিপ্লয়মেন্ট ইউনিট রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এটি গঠিত জাপানের ওকিনাওয়ায় ৩১ তম মেরিন এক্সপিডিশনারি ইউনিট এবং সাসেবোর এমফিবিয়াস স্কোয়াড্রোন ১১ নিয়ে। বিশাল অঞ্চলের হিসেবে একটি মাত্র এআরজি তেমন কিছু নয়।

এমফিবিয়াস অপারেশনের মাধ্যমে একই সাথে আকাশ, সমুদ্র এবং স্থল তিন ক্ষেত্রেই যুদ্ধ পরিচালনা করা যায়। মাল্টি ন্যাশনাল এমফিবিয়াস টাস্ক ফোর্স গঠনের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়ার মাধ্যমে। ইতোমধ্যে সামরিক ক্ষেত্রে দুই দেশ এক সাথে অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

উত্তর অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে রয়েছে চমৎকার বন্দর সুবিধা। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্রে সরাসরি চলে আসার ক্ষেত্রে উত্তর অষ্ট্রেলিয়া কৌশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত কার্যকর। সানদিয়াগোর করোনাডো ট্রেনিং সেন্টারের মত অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র নেভির এমফিবিয়াস ট্রেনিং সেন্টার।

অস্ট্রেলিয়ার পর জাপান হতে পারে মাল্টি ন্যশনাল এমফিবিয়াস টাস্ক ফোর্স গঠনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ভারত, তাইওয়ান, দক্ষিন কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইনস, নিউজিল্যান্ড ছাড়া এ অঞ্চলের অন্য আরো অনেক দেশের রয়েছে এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ। ফলে এখানে একাধিক এমফিবিয়াস গ্রুপ গঠন করা সম্ভব।

এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ হলো উভচর হামলা রণতরী । এ রণতরী একই সাথে স্থল এবং সমুদ্রে শত্রæর বিরুদ্ধে আক্রমন পরিচালনায় সক্ষম। যুদ্ধের সময় এ রণতরী ঘাটিতে মোতায়েন করা হয় স্থল বাহিনীর সমর্থনে। গ্রাউন্ড ফোর্সের সহায়তায় এমফিবিয়াস এসল্ট শিপে বহন করা হয় হেলিক্টার এবং এটি কাজ করে ল্যান্ডিং ডক হিসেবে।

বনহোম রিচার্ড ধ্বংস হওয়ায় বেশ চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্র নেভি। ছবি : এএফপি
বনহোম রিচার্ড ধ্বংস হওয়ায় বেশ চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্র নেভি। ছবি : এএফপি

 

তবে বিমানবাহী রণরতীর মত অনেক এমফিবিয়াস এসল্ট শিপে রয়েছে যুদ্ধ বিমান ওঠা নামার ব্যবস্থা। ফলে এসব এমফিবিয়াস এসল্ট শিপকে সেমি বিমানবাহী রণতরীও বলা যায়। বর্তমানে বিমানবাহী রণতরী হিসেবে সেকেন্ডারি ভ‚মিকা পালন করে থাকে এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে ১১টি পরমানু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। তবে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারসহ অনেক সংস্থার মতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যা ২০টি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এমফিবিয়াস এসল্ট শিপকেও বিমানবাহী রণতরী হিসেবে গণ্য করে থাকে। অপর দিকে এমফিবিয়াস রেডি গ্রুপ একই সাথে স্থল, সাগর এবং আকাশে শত্রæর বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনায় ব্যবহার করা হয়।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এমফিবিয়াস এসল্ট শিপের বহর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওয়াসপ ক্লাস এবং আমেরিকা ক্লাস। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ হলো ওয়াসপ ক্লাসের এসল্ট শিপ। এর প্রথম এমফিবিয়াস এসল্ট শিপের নাম ইউএসএস ওয়াস। ১৯৮৯ সালে এটি যুক্তরাষ্ট্র নেভিতে যুক্ত হয়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে