ভারতের রাফালে না চীনের জে -২০ কোনটা শক্তিশালী

চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান হলো তাদের নিজেদের তৈরি ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার চেংদু জে-২০ - সিনোডিফেন্স

  • মেহেদী হাসান
  • ০৫ আগস্ট ২০২০, ১৭:২৫

ফ্রান্সের কাছ থেকে পাওয়া রাফালে যুদ্ধ বিমান নিয়ে ব্যাপকমাত্রায় উচ্ছসিত ভারত। ফোর প্লাস জোনরেশনের এই যুদ্ধ বিমান লাভের পর ভারতের বিমান বাহিনী এখন চীনা বিমান বাহিনীর চেয়েও অনেক শক্তিশালী এমন দাবি করছেন অনেক ভারতীয় বিশ্লেষণ । তাদের মতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতো এখন ভারতের সাথে কোনো তুলনাতেই আসতে পারে না।

দীর্ঘকাল ধরে ভারতের বিমান বাহিনীর দুর্বলতা নিয়ে তীর্যক সমালোচনা চলছে । এমনকি বারবার তারা পাকিস্তানের বিমানাহিনীর কাছে বিপর্যয়কর পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে। এ অবস্থায় ফ্রান্সের শক্তিশালী ফোর প্লাস যুদ্ধবিমানের অধকারী হওয়াকে ভারতের জন্য গেম চেঞ্জার হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে এমন এক সময় ভারত এ বিমানের অধিকারী হলো যখন লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে উত্তেজনা চলছে। ভারতের বিরুদ্ধে চীন ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দুই ফ্রন্টে হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

২৯ জুলাই ভারতের আম্বালা এয়ার স্টেশনে অবতরণ করেছে ৫টি রেফালে যুদ্ধবিমান। পাকিস্তান ও চীনকে মোকাবিলায় দীর্ঘ ২৩ বছর পর ভারতীয় বিমান বাহিনী এমন শক্তিশালী যুদ্ধ বিমানের অধিকারী হলো। ভারত ফ্রান্স থেকে ৩৬টি রাফালে কিনছে। বাকী বিমান বুঝে পাবে ২০২২ সালের মধ্যে।

ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলছে রাফালে যুদ্ধ বিমান বন্দনা। রাফালের শক্তি সামর্থ্য নিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক রিপোর্ট। রাফালের সাথে তুলনা করা হচ্ছে চীনের জে-২০, চীন ও পাকিস্তানের কাছে থাকা জে-১৭ এবং পাকিস্তানের এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের শক্তি ও সামর্থ্য বিষয়ে।

চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান হলো তাদের নিজেদের তৈরি ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার চেংদু জে-২০। ভারতের গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলের দাবি রাফালে যুদ্ধ বিমান চেংদু জে-২০ এর তুলনায় অনেক শক্তিশালী। আর জে -২০ যুদ্ধ বিমানের শক্তি সামর্থ্য বিষয়ে চীনের দাবিও অসত্য প্রমানের চেষ্টা করছে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম। ভারতের গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে জে-২০ আসলে প্রকৃত স্টেলথ ফাইটার নয়।

রাফালে একটি বহুমুখী যুদ্ধ বিমান। এর রয়েছে এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু গ্রাউন্ড এবং এন্টি শিপ মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। এ ছাড়া এরিয়েল রিকনিসন্সসহ আরো অনেক কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম এ বিমান। রেফালের রয়েছে পরমানু বোমা বহনকারী মিসাইল ছোড়ারও ক্ষমতা। রাফালে এয়ার টু এয়ার যেসব মিসাইল বহন করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মেটিওর, মিকা, মেজিক, সাইডউইন্ডার, আসরাম, আরাম। আসুন আমরা জেনে নেই রাফালে সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

এয়ার টু এয়ার মেটিওর মিসাইলের নির্মাতা ইউরোপীয়ান ফার্ম এমবিডিএ। মেটিওর একটি দীর্ঘ পাল্লার রকেট এবং র‌্যাম জেট পাওয়ার্ড। এর আওতায় ১৫০ কিলোমিটার। তার মানে আকাশে ১০০ কিলোমিটার দূরের শত্রু বিমানকে আঘাত করতে পারবে ভারত রেফালের মাধ্যমে। আর এজন্য তাকে ভারতের সীমানাও অতিক্রম করতে হবে না। । এয়ার টু গ্রাউন্ড আক্রমনের জন্য রেফালে বহন করে এপাচি, এলার্ম, হার্ম, মাভারিক. এএস৩০এল এবং পিজিএম মিসাইল ।
রাফালে ভ‚মিতে আক্রমনের জন্য ব্যবহার করে দীর্ঘ পাল্লার ক্রুজ মিসাইল। এ ধরনের একটি মিসাইলের ওজন ১ হাজার ৩০০ কেজি। এক থেকে দুটি এ ধনের মিসাইল বহন করতে পারে রাফালে। এ মিসাইলের আওতা ৬০০ কিলোমিটার এবং এর আঘাত ক্ষমতা নিখুত। একই সাথে ভারত রেফালের মাধ্যমে ভ‚মিতে আক্রমন পরিচালনার জন্য ফ্রান্সের হ্যামার মিসাইল বাছাই করেছে। এটি একটি প্রিসিশন গাইডেড মিসাইল। লাদাখ সংঘাতের কারনে ভারত জরুরি ভিত্তিতে এ মিসাইল কিনছে। এর আওতা ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার।

ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবি ভারতের আকাশ সীমায় অবস্থান করেই রাফালে শত্রুরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালাতে পারবে। রাফালের এন্টি-শিপ মিসাইলের মধ্যে রয়েছে এক্সোসিট, পেঙ্গুইন৩ এবং হারপুন । ফ্রান্সের তৈরি এক্সোসিট এন্টি শিপ মিসাইলের রয়েছে রাডার ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা যা বহন করে রেফালে।

চীনের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের জে-২০ স্টেলথ ফাইটারের মাধ্যমে চীন বিশ্বের তৃতীয় দেশ যারা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরে এ ধরনের শক্তিশালী বিমান তৈরি করতে সক্ষম। সব আবহাওয়ায় অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম এ বিমান। এর রয়েছে প্রিসিশন স্ট্রাইক সক্ষমতা। চেংদু চীনা বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় ২০১৭ সালে।

জে-২০ জঙ্গি বিমান চীনের তৈরি স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘ পাল্লার এয়ার টু এয়ার মিসাইল বহন করতে পারে। এসব মিসাইলের মধ্যে একটি হলো পিএল-২১। এটি একটি একটিভ রাডার গাইডেড মিসাইল। এটি ইউরোপের এমবিডিএ তৈরি মেটিওর, রাশিয়ার আর-৭৭, যুক্তরাষ্ট্রের এআইএম-১২০ আমরাম এবং ডারপা ট্রিপল থ্রেট থার্মিনেটর এয়ার টু এয়ার মিসাইলের সমান শক্তি সম্পন্ন।

চেংদুর আরেকটি এয়ার টু এয়ার মিসাইল হলো চীনের তৈরি পিএল-১৫। এ মিসাইলের গতি শব্দের চেয়ে ৪ গুন বেশি বা ম্যাক-৪। এর আওতা ৪০০ কিলোমিটার । তার মানে জে-২০ বিমান আকাশে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের শত্রæর বিরুদ্ধে আক্রমন পরিচালনা এবং প্রতিহত করতে পারে। জে-২০ চারটি পিএল-১৫ বোমা বহন করতে পারে।

চেংদুতে বহনযোগ্য আরেকটি এয়ার টু এয়ার মিসাইলের নাম পিএল ১২। এটিও রাশিয়ার আর-৭৭, যুক্তরাষ্ট্রের এআইএম-১২০ আমরাম এর সমান ক্ষমতাসম্পন্ন রাডার গাইডেড মিসাইল। এ ছাড়া চেংদু জে-২০ বহন করতে পারে চীনা তৈরি এলএস পিসিশন গাইডেড বোমা।

রাফালের গতি শব্দের চেয়ে ১ দশমিক ৮ গুন বেশি বা ম্যাক ১.৮। অপর দিকে জে -২০ এর গতি শব্দের চেয়ে ২ গুন বেশি বা ম্যাক ২। রাফালের ম্যাক্রিম্যাম টেক অফ ওয়েট ২৪ টন ৫০০ কেজি। চেংদুর ম্যাক্রিম্যাম টেক অফ ৩৭ টন।

রাফালের দৈর্ঘ্য ৫০ ফিট। ইউং স্প্যান ৩৫ ফিট ৯ ইঞ্চি। উচ্চতা ১৭ ফিট ৬ ইঞ্চি। শুধু বিমানটির ওজন ১০ টন ৩০০ কেজি। চেংদুর দৈর্ঘ্য ৬৬ ফিট ৮ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৪৪ ফিট ২ ইঞ্চি। শুধু বিমানটির ওজন ১৯ টন ৩৯১ কেজি।

চেংদুর ইন্টারনাল ফুয়েল ক্যাপাসিট ১১ টন ৩৪০ কেজি। ফালের ইন্টারনাল ফুয়েল বহন ক্ষমতা ৪ দশমিক ৭ টন। এক্সটারনাল ফুয়েল বহন ক্ষমতা ৬ দশমিক ৬ টন। রাফালে উড়তে পারে ৫০ হাজার ফিট উচ্চতায়। চেংদু উড়তে পারে ৬৫ হাজার ফিট উচ্চতায় ।

ভারত যে রাফালে কিনছে তার মধে ২৮টি এক আসনের এবং ৮টি দুই আসনের। দুই আসনের বিমানগুলো মূলত প্রশিক্ষণ বিমান। রাফালের হার্ড পয়েন্ট ১৪টি। নেভি ভার্সনের হার্ড পয়েন্ট ১৩টি। এর মধ্যে ৫টি ভারী অস্ত্র বহনের জন্য। টোটাল এক্সটারনাল লোড ক্যাপাসিটি সাড়ে নয় টন। চেংদুর হার্ড পয়েন্ট আটটি।

রাফালের ইঞ্জিন সংখ্যা দুটি। চেংদুরও ইঞ্জিন সংখ্যা দুটি। রাফালে বিমানে অটো ক্যানন গান রয়েছে। চেংদুতে গান নেই। ভারত তাদের রাফালে বিমানে ব্যবহার করবে ইসরাইলের রাডার এবং সেন্সর সিস্টেম।

এতে রয়েছে স্পেক্ট্রা -ইন্টিগ্রেটেড ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট। এর মাধ্যমে লং রেঞ্জ ডিটেকশন, আইডেনটিফিকেশন এবং লোকালাইজেশন করা সম্ভব শত্রুর হুমকি। এতে রয়েছে রাডার, লেজার এবং মিসাইল ওয়ানির্ং রিসিভার। এভয়নিং রাডার এবং উইপন সিস্টেমের কারনে রাফালে বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি যুদ্ধ বিমান হিসেবে বিবেচিত। একটি ফ্লাইটে একাধিক অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম রাফালে। রাফালের শক্তি প্রমানিত। এর রয়েছে দীর্ঘ অপারেশন পরিচালনার ইতিহাস। ২০০১ সালে এটি ফ্রেন্স এয়ার ফোর্স ও নেভিতে যুক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া অভিয়ানে অংশ নিয়েছে রাফালে।

ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলছে রাফালে যুদ্ধ বিমান বন্দনা। ছবি : ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট
ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলছে রাফালে যুদ্ধ বিমান বন্দনা। ছবি : ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট

 

সে তুলনায় জে-২০ এর বাস্তব ক্ষেত্রে যুদ্ধ ক্ষেত্রে শক্তি এখনো পরীক্ষিত হয়নি । তবে চীনা মিডিয়ার দাবি জে-২০ এর উইপন ক্যপাসিটি যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ এবং এফ ৩৫ এর চেয়েও বেশি। সাউথ চায়না মনিটরিং পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের জুলাই মাসে চীন জে-২০ এর নতুন ভার্সন জে-২০বি এর ম্যাস প্রডাকশন শুরু করেছে। আর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর হলো জে-২০ বি জে ২০ এর তুলনায় আরো শক্তিশালী এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ এর প্রকৃত প্রতিদ্বদ্বী।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চীনা জে-২০ বিমান নিয়ে যেসব তুলনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় তাতে সাধারণত তারা জে-২০ এর সাথে তুলনা করে বিশ্বের সবচেয়ে এডভান্সড ফাইটার জেট যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‌্যাপটর, এফ -৩৫, রাশিয়ান এসইউ-৫৭ আর সাথে। ফ্রান্সের রাফালের সাথে নয়। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছে ফিফথ জেনারেশন চীনা জে-২০ কে ফোর প্লাস জেনারেশন রাফালের চেয়ে কম ক্ষমতা সম্পন্ন প্রমানের। জে-২০ ছাড়া চীনের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের আরেকটি যুদ্ধ বিমান হলো জে-৩১ । এটিও একটি স্টেলথ ফাইটার। যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ বিমানের সমকক্ষ বিবেচনা করা হয়।

এ ছাড়া চীনের কাছে রয়েছে তাদের নিজস্ব তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের বহুমুখী যুদ্ধ বিমান জে-১৭। জে সিরিজের আরো অনেক যদ্ধ বিমান ছাড়া চীনের কাছে ব্যাপক সংখ্যক রাশিয়ার এসইউ-২৭ এসএইউ-৩০, এসইউ-৩৫ বহুমুখী যুদ্ধ বিমান রয়েছে বিমান। রাফালের আগে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান হলো এসইউ-৩০ এমকে। তবে এটা ঠিক রাফালের কারনে ভারতের বিমান বাহিনীর শক্তি আগের তুলনায় অনেক বাড়বে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে