আমেরিকা বনাম চীন : আকাশ প্রতিরক্ষায় কে শক্তিশালী

এফ-৩৫, মার্কিন এিই জঙ্গি বিমানের রয়েছে রণাঙ্গন পরিস্থিতি বোঝার বিশেষ ক্ষমতা - ইউএস এয়ারফোর্স

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৫ জুন ২০২০, ২২:৩৮

একসময় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে, আর এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান 'লড়াই'টা হচ্ছে চীনের সাথে। বাণিজ্যযুদ্ধ, কূটনৈতিক লড়াই, সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই - কত রকমের লড়াই যে এ দু' দেশের মধ্যে চলে! এর কোনোটিতে এগিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র, আবার কোনোটিতে চীন। এই যেমন কিছুদিন আগে আকাশ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা রায় দিয়েছেন, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মার্কিন বিমান বাহিনীর এফ-৩৫কে চ্যালেঞ্জ করতে পারে চীনের নবতম স্টিলথ জঙ্গি বিমান জে-২০।

বছরখনেক আগে চীনের নতুন স্টিলথ জঙ্গি বিমান জে-২০এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন হয়েছে এবং এখন ওটি দেশ প্রতিরক্ষার মূল এয়ারপ্লেনে পরিণত হয়েছে।

তা হোক, কিন্তু চীনের নতুন জঙ্গি বিমানটিকে কী করে এর প্রধান শত্রূ মার্কিন বিমান বাহিনীর মাল্টিরোল জঙ্গি বিমান এফ-৩৫এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে? - এমন প্রশ্নের জবাবে চীনের এক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেন, চীনের জে-২০ যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫এর চাইতে আরও উন্নত প্রযুক্তিরও তো হতে পারে!

কিছুদিন আগে চীনা গণমুক্তি ফৌজের বিমান বাহিনী জে-২০ জঙ্গি বিমানের একগুচ্ছ ছবি প্রকাশ করে। এতে একটি কমব্যাট ইউনিটের সিরিয়াল নাম্বার ৬২০০১-ও দেখা যায়। ছবির ক্যাপশনে লেখা - ''বিমান বাহিনীর একটি জে-২০ জঙ্গি বিমান সত্যিকার যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।'' এর সাথে ছিল একটি বিবৃতি, যাতে চীনের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত ক্ষমতার বিবরণ দেয়া হয়।

চীনের সিয়ান থেকে প্রকাশিত জাতীয় প্রতিরক্ষাশিল্প বিষয়ক সাময়িকী 'অর্ডন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি সায়েন্স টেকনলজি'কে একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা জানান, চীনা গণমুক্তি ফৌজের প্রচলিত প্রথা অনুসারে কোনো আকাশযানের নাম্বার '৭' দিয়ে শুরু হলে বুঝতে হবে সেটি এখনও কোনো ট্রায়াল ইউনিটের সাথে যুক্ত আছে। জে-২০ জঙ্গি বিমানের নাম্বার '৬' দিয়ে শুরু হওয়া মানে ওটি এখন কমব্যাট ইউনিটে যুক্ত হয়ে গেছে।

গণমুক্তি ফৌজের কর্মকর্তারাও পরে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, জে-২০ এখন প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের দাবি, এর মধ্য দিয়ে জঙ্গি বিমানটি চীনের আকাশ প্রতিরক্ষায় নতুন এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। একই সাথে তারা তাইওয়ানের প্রতি ইঙ্গিত করে হুঁশিয়ার করে দেন যে এসব জঙ্গি বিমান সহজেই যে কোনো রকম আক্রমণ প্রতিহত করে দূরের ও কাছের শত্রূর আকাশসীমান্ত ঘেঁষে উড়ে যেতে পারে।

চীনের একজন আকাশ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ 'গ্লোবাল টাইমস' সাময়িকীকে বলেন, ট্রায়াল ইউনিটের অধীনে ট্রেইনিংয়ের সাথে কমব্যাট ইউনিটের ট্রেইনিংয়ের তফাৎ আছে; দু'টো ট্রেইনিং এক রকম নয়। ট্রায়াল ইউনিটের অধীনে ট্রেইনিংয়ে প্রধানত আকাশযানটির বিশেষ ক্ষমতাটি কী, সেটা খোঁজার চেষ্টা করা হয়। অপরদিকে কমব্যাট ইউনিটের ট্রেইনিংয়ে জোর দেয়া হয় ট্যাকটিক্যাল প্র্যাকটিসের প্রতি। উভয় ক্ষেত্রে ট্রেইনিং সিলেবাস আছে, রক্ষণাবেক্ষণ ম্যানুয়াল আছে।

ওই বিশেষজ্ঞের বিশ্বাস, চীনের জে-২০ জঙ্গি বিমান মার্কিন বিমান বাহিনীর এফ-৩৫ অপেক্ষা অনেক উন্নত।

বছরখনেক আগে চীনের নতুন স্টিলথ জঙ্গি বিমান জে-২০এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন হয়েছে- উইকিপিডিয়া
বছরখনেক আগে চীনের নতুন স্টিলথ জঙ্গি বিমান জে-২০এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন হয়েছে- উইকিপিডিয়া

 

প্রশ্ন হলো, নিজ দেশের জঙ্গি বিমানের শক্তিমত্তার ব্যাপারে ওই বিশেষজ্ঞের এ বিশ্বাস সব দিক বিচারেই একটু বেশি বাড়াবাড়ি নয় কি? কেননা, তুলনা করলে বলতে হয়, আমেরিকার এফ-৩৫ কর্মসূচিকে আজকের দিনে বিবেচনা করা হয় মার্কিন সামরিক ইতিহাসের সবচাইতে ব্যয়বহুল এবং সবচাইতে বেশি ভুলমুক্ত প্রকল্প হিসেবে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ এফ-৩৫এর পেছনে এত অর্থ ঢেলেছে যে, কোনো সমাধানহীন বিপর্যয় এসে প্রকল্পটিকে যেন ভণ্ডূল করে দিতে না-পারে সেজন্য মার্কিন বিমান বাহিনী বেশ-কিছু পদক্ষেপ নেয়। ৫৫ বছর মেয়াদী প্রকল্পটিতে দেড় ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়।

মার্কিন মিলিটারি পাইলটরাও এফ-৩৫ সম্বন্ধে চমৎকার মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, এ জঙ্গি বিমানের রয়েছে রণাঙ্গন পরিস্থিতি বোঝার বিশেষ ক্ষমতা।

এসব কিছুর পরও সেই চীনা বিশেষজ্ঞ, যার কথা আমরা একটু আগেই বলেছি, তিনি বলেন, জে-২০ বেশি সংখ্যায় বানানো হবে এবং ভবিষ্যতে এর আরও উন্নয়ন ঘটানো হবে। এর ইঞ্জিন, অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন, রেডার, উইপনস অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস সিস্টেমস, অ্যাভিয়নিকস অ্যান্ড ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম আরও উন্নত করা যেতে পারে।

'চায়না পাওয়ার' সাময়িকীর মতে, জে-২০ চীনের সশস্ত্র বাহিনীতে একটি মাল্টিরোল স্টীলথ জঙ্গি বিমানের প্রথম প্রবেশ।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ সূত্রগুলো বলছে, চীন স্টিলথ প্রযুক্তিকে দেখছে তার বিমান বাহিনীকে নতুন রূপ দানের একটা প্রধান উপকরণ হিসেবে। নতুন রূপে তার বিমান বাহিনী আগের ক্ষমতা ছাড়িয়ে আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক - উভয় ক্ষমতার অধিকারী হবে। নতুন এ জঙ্গি বিমানে রয়েছে সেই সম্ভাবনা, যা চীনকে দেবে এমন আক্রমণের সুযোগ, যা আগে তার ছিল না। পাশাপাশি বাড়াবে তার ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ।

'চায়না পাওয়ার' সাময়িকীর খবরে বলা হয়, চীনের জে-২০ জঙ্গি বিমান বিভিন্ন সাবসিস্টেম এবং ফিল্ড সিগনেচার রিডাকশন টেকনোলজি দিয়ে সজ্জিত। এর ফলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এটি 'ফিফথ জেনারেশন' বা পঞ্চম প্রজন্মের এয়ারক্র্যাফট বলে গণ্য হতে পারে।

মার্কিন বিমান বাহিনীর একজন শীর্ষ কর্মকর্তার মতে, জে-২০ হলো তথ্যযুগের বিমান, যা স্যাটেলাইট ও মানুষবিহীন আকাশযান থেকেও তথ্য জেনে নিতে পারবে। এতে করে জে-২০ ও এফ-৩৫ একই ফ্যামিলি অব সিস্টেমসের অন্তর্ভুক্ত হলো।

আকাশ থেকে আকাশে কিংবা আকাশ থেকে ভূমিতে যুদ্ধ চালানোর ক্ষেত্রে জে-২০ জঙ্গি বিমানের তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অবশ্য নানা মুণির নানা মত পাওয়া যায়। কোনো-কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, ফ্রন্টাল স্টিলথে বেশি জোর দেয়ায় জে-২০কে মাঝ-আকাশে দূরপাল্লার হামলা প্রতিরোধে বিশেষ সক্ষমতা দিয়েছে। এটি বহু দূরে বসে শত্রূর আকাশ প্রতিরক্ষা তছনছ করে দিতে এবং ভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করতে বিশেষ কার্যকর।

জে-২০ জঙ্গি বিমানের দূরপাল্লার আওতা কতটুকু, তা নিয়েও মতভেদ আছে। তবে অনেক মতামত বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়, এটি ১২০০ থেকে ২৭০০ কিলোমিটার দূর থেকেও হামলা চালাতে বা ঠেকাতে পারে।

তথ্যের এমন অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও বলা চলে, জে-২০ জঙ্গি বিমানের আক্রমণক্ষমতার আওতা চীনের মূল ভূখণ্ডকে বেড় দিতে পারার মতোই বিশাল। মার্কিন নেভাল ওয়ার কলেজের মতে, এ বিমানটি আকাশ থেকে সমুদ্রের কয়েক শ' মাইল এলাকায় হামলা চালাতে পারে।

গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, জে-২০ সম্ভবত স্টিলথ জঙ্গি বিমানের আওতা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের আকাশজুড়ে বিস্তৃত করবে।

আকাশে ডগ ফাইট অর্থাৎ দুই জঙ্গি বিমানের মুখোমুখি সংঘর্ষে কোনটি এগিয়ে থাকবে - এমন প্রশ্নের জবাবে অস্ট্রেলিয়ার একজন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেন, এক্ষেত্রে আমি এফ-৩৫এর পক্ষই নেবো। কেননা ডেটা সমন্বয়ের ক্ষত্রে এটি এগিয়ে আছে। তথ্য যোগাড় ও বিনিময়েও এটি পারদর্শী।

তিনি বলেন, এফ-৩৫ ও জে-২০ বিমানের মধ্যে যদি প্রচলিত নিয়মে ডগ ফাইট হয়, তাহলে কোনটা যে জিতবে, তা অবশ্য হলফ করে বলা মুশকিল। কারণ, এফ-৩৫এর রয়েছে স্টিলথে এগিয়ে থাকার সুবিধা এবং ব্যাটলফিল্ড অ্যাওয়ারনেস আর প্রতিপক্ষের আছে অধিকতর দ্রূত গতি, বেশি দূরপাল্লার আওতা এবং বেশি ভার বহনের ক্ষমতা।

অস্ট্রেলিয়ার ওই প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেন, আসলে কোনটি সেরা - এ প্রশ্ন করা যত সহজ, জবাবটা ততো সোজা নয়। এ নিয়ে চূড়ান্ত কথাটি বলার সময় এখনও আসেনি।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে