চীন-ভারত দ্বন্দ্বে মিয়ানমারের পরিণতি কী হবে

ইলাস্ট্রেশনটি করেছেন লিও রুই - গ্লোবাল টাইমস

  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ জুন ২০২০, ২১:৪৫

ভারত এবং মিয়ানমার নতুন কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এ দুই দেশের উদ্দেশ্য চীনের আঞ্চলিক প্রভাব মোকাবেলা করা। সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে চীনের বেশ দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কারণ মিয়ানমার সেনাবাহিনী চেষ্টা করছে ধীরে ধীরে চীনের অতিরিক্ত প্রভাব এবং চীনা নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসার। অপরদিকে দীর্ঘদিন চীনের সন্দের তালিকায় থাকা অং সাং সুচি ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চীনের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

মিয়ানমারকে ধীরে ধীরে চীনের প্রভাব থেকে বের করে আনার চেষ্টার অংশ হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সম্প্রতি ২২ জন বিদ্রোহীকে তুলে দিয়েছে ভারতের হাতে। বিশ্লেষকদের মতে চীনের প্রভাব কমিয়ে আনার চেষ্টার এটি একটি অংশ। ভারতীয় এই বিদ্রোহীদের মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ প্লেন মিয়ানমারের উত্তরের সাগিং রাজ্যের ছোট শহর হাকমতি থেকে উডডয়ন করে। প্লেনটি প্রথমে ভারতের মনিপুর রাজ্যের রাজধানী ইমফল যায়। এরপর সেখান থেকে থেকে আসাম রাজ্যের রাজধানী গৌহাটি পৌঁছায়। প্লেনে ছিল মনিপুরের ১২ জন ও আসামের ১০ জন বিদ্রোহী। বিদ্রোহী হস্তান্তরের পুরো বিষয়টি তদারকি করেন ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার অজিত দোভাল।

মিয়ানমারের এ আচরণ অনেকটা অস্বাভাবিক। এর মাধ্যমে ভারতের প্রতি সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে দেশটি। যার মধ্যদিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পরিবর্তিত নীতির বহিপ্রকাশ ঘটেছে। নিরাপত্তা এবং অস্ত্রের ক্ষেত্রে মায়ানমার দীর্ঘদিন ধরে মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্রোহীদের ভারতের হাতে তুলে দিয়ে মিয়ানমার আর্মি ভারতের প্রতি যে সদিচ্ছা দেখাল এর মাধ্যমে তারা তাদের বিদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার বার্তা দিয়েছে।

মিয়ানমার এমন এক সময় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যখন হিমালয় অঞ্চলে চীন-ভারত সংঘাতের মুখোমুখি। চীনের পিপলস আর্মিকে যখন যুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিং। চীন-ভারত নতুন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে মায়ানমারের এ আচরণ নতুন কৌশলগত মাত্রা যুক্ত করেছে। বস্তুত মিয়ানমার সেনাবাহিনী এর মাধ্যমে বড় ধরনের একটি ঝুকি নিয়েছে । যদি বড় দুই দেশের মধ্যে দ্ব›দ্ব যদি শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের সংঘর্ষে গড়ায় তবে মিয়ানমারকে এ জন্য বড় ধরনের মূল্য দিতে হতে পারে।

মিয়ানমাররের বড় অংশ চীন ও ভারত সীমান্ত বেষ্টিত। ১৯৬০ সাল থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীরা মিয়ানমারকে ব্যবহার করে আসছে। মনিপুর, নাগাল্যান্ড এবং আসামের বিদ্রোহীরা মিয়ানমারের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে তাদের নাগাল পাওয়া কঠিন। এতোদিন মায়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের এলাকায় উপজাতিদের ঘাটি থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে এ নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ছিলো।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাগা অভিযানে বিদ্রোহী গ্রেফতার এবং তাদেরকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি পরির্তনের ইঙ্গিত হিসাবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা একে বৃহত্তর ভূ-কৌশলগত আঙ্গিকে দেখছেন।

মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধ এবং বর্জনের পর দেশটির প্রতি সব ধরনের সহায়তা এবং সমর্থন অব্যাহত রাখে চীন। এমনকি মিয়ানমারের ওপর নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে বড় ধরনের অবরোধ চেষ্টাও আটকে দেয়। এসব তৎপরতার মাধ্যমে দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তারেও সক্ষম হয়। পশ্চিমাদের বর্জন আর অবরোধের সুযোগে ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকজুড়ে চীন মায়ানমারে ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগ, ঋন প্রদান এবং অস্ত্র বিক্রি করে । কিন্তু মিয়ানমারের ২০১১ সালে রাজনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর চীনা প্রভাব কমতে শুরু করে। ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। এ নির্বাচনের পর পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের দিকে আবার মুখ ফেরাতে শুরু করে। কিন্তু ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর তা ভেস্তে যায়।

রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের চীনা প্রভাব বাড়তে থাকে। মিয়ানমারকে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে যুক্ত করে চীন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমারে চীন স্থাপন করবে একটি কৌশলগত করিডোর। যার মাধ্যমে চীনের দক্ষিন অঞ্চলকে যুক্ত করবে ভারত মহাসাগরের সাথে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী শঙ্কিত চীনের এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশটি চীনের ওপর ব্যাপমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এ চিন্তা থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সম্প্রতি তাদের পুরনো মিত্র রাশিয়ার দিকেও দৃষ্টি দিয়েছে। রাশিয়া থেকে সামরিক প্রশিক্ষন এবং সমরাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেছে । এর মধ্যে রয়েছে ২০৪ মিলিয়ন ইউএস ডলারে ৬টি সুখোই এসইউ ৩০ এম যুদ্ধ বিমান।

পশ্চিমাদের মোকাবেলায় মিয়ানমারের প্রতি চীনের অকুন্ঠ সমর্থন মূলত মিয়ানমার আর্মির প্রতি সমর্থন। কারণ দেশটিতে কয়েক দশক ধরে বজায় ছিল সামরিক শাসন। আর চীনা প্রশ্রয়ে থাকা মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন চেষ্টা করছে চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্বরশীলতা কমিয়ে আনার। ফলে চীনের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। অপর দিকে চীনের গুডবুকে না থাকা অং সাং সুচি চেষ্টা করছেন নভেম্বরের নির্বাচনে চীনা সমর্থন তার পক্ষে নেয়ার। নভেম্বরের নিবাচনে চীনের ভূমিকা নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সন্দেহের চোখে দেখছে। মিয়ানমার সেনানেতৃত্ব নতুন বন্ধু খোজার চেষ্টা করছে।

রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সারগেই সইগু ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার সফর করেন । এসময় তিনি সাক্ষাত করেন মায়ানমার সেনা প্রধান মিন অং লাইংয়ের সাথে। এ সফরে রাশিয়ার কাছ থেকে সমরাস্ত্র কেনা ও সেনা প্রশিক্ষন বিষয়ে চুক্তি হয়। রোহিঙ্গা নিধনের সময় চীন এবং ভারতের মত রাশিয়াও সম্পূর্ণ নিরব ভূমিকা পালন করে।
এ সময় ভারত নিরব ভূমিকা পালন করে কারণ চীনের মোকাবেলায় মিয়ানমারকে পাশে রাখতে চেয়েছে। রোহিঙ্গা নিধনের সময় বৃটেন যখন মিয়ানমার সেনাদের প্রশিক্ষন বন্ধের ঘোষনা দেয় ভারত তখন মিয়ানমারের সাথে সেনা প্রশিক্ষনের বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যায়।

এর আওতায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার ও ভারত ইতিহাসে প্রথমবারের মত যৌথ মহড়া চালায়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অনুষ্ঠিত এ মহড়ার আনুষ্ঠানিকভাবে এর নাম দেয়া হয় ‘পিসকিপিং অপারেশন’। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ভারত ও মিয়ানমার নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়া চালায়। ভারত-মিয়ানমার মহড়া স্থলে বর্তমানে চীনা সাবমেরিন হানা দিচ্ছে বলে ভারত অভিযোগ করে আসছে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে মায়ানমার চীনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। চীনের সুদুর প্রসারী রোড এন্ড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের কারনে এ গুরুত্ব আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আগে থেকেই মিয়ানমারে রয়েছে চীনের বহুমুখী স্বার্থ। মিয়ানমার থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন সরাসরি তেল গ্যাস নিচ্ছে । মিয়ানমারে রয়েছে চীনের বন্দর, অর্থনৈতিক জোন, রেল, সড়কসহ অনেক বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প। যা সরাসরি চীনের আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার রাজনীতির সাথে জড়িত।

এ অবস্থায় চীনের দিক থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মুখ ফেরানো কিংবা ভারত বা অন্য দেশের দিকে ঝুকে পড়া কোনোভাবে মেনে নেবে না চীন। মিয়ানমারকে বশে রাখা এবং লাগাম টানার অনেক উপায় আছে চীনের কাছে। অতীতেও চীন তা ব্যবহার করেছে। ভবিষ্যতেও চীন একই পথ অবলম্বন করবে। এর একটি হলো মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ । এমনকি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহীদেরও ব্যবহারকে করে ভারতকে বেকায়দায় ফেলার সক্ষমতা রয়েছে চীনের।

ভারত ভালো করেই জানে, মিয়ানমার সীমান্তে চীনের ইউনান রাজ্যের রুইলি শহরে রয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহীদের অবস্থান। ভারত চাচ্ছে মিয়ানমার-চীন সীমান্ত হয়ে চীনা অস্ত্র যেন ভারতী বিদ্রোহীদের হাতে না পৌছে। ভারতের অভিযোগ মনিপুর ভিত্তিক বিদ্রোহী গ্রুপগুলো চীনের সমর্থন পেয়ে থাকে। আসামের উলফা কমান্ডার পরেশ বড়–য়াও ইউনান প্রদেশকে ব্যবহার করত বলে অভিযোগ রয়েছে ভারতের।

রাশিয়ার সাথে মায়ানমারের সামরিক আতাতকে চীন হয়তো ততটা অসুন্তষ্ট হবে না কিন্তু ভারতের সাথে মায়ানমারের আতাত মেনে নেবে না চীন। ১৯৬০ এবং ১৯৮০ দশকে নাগাল্যান্ড, মনিপুর এবং মিজোরাম বিদ্রোহীদের নানাভাবে সাহায্য, অস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষনের অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে।

বিশ্লেষকদের মতে মিয়ানমার বা ভারত কোনো দেশই চীনের সাথে কোনো ধরনের গেম খেলতে পারবে না। চীনের বিরুদ্ধে মিয়ানমার ও ভারতের গেম ভন্ডুল করে দেয়ার সব ধরনের উপায় চীনের হাতে আছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী চীনের নাগাল থেকে বের হয়ে আসার যে চেষ্টা করছে তা হিতে বিপরীত হতে পারে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে