রুশ মিসাইল অচল করে দিয়েছিলো মার্কিন সুপারসনিক যুদ্ধবিমানকে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সুপারসনিক বম্বার হলো বি-৫৮ হাসলার - ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ডটঅর্গ

  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ জুন ২০২০, ২১:০৮

যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় উভয় দেশ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে। নতুন নতুন সমরাস্ত্র উদ্ভাবন করা হয়। একের পর এক আসতে থাকে নতুন নতুন প্রযুক্তি। নতুন ধরনের সমরাস্ত্র উদ্ভাবনের ফলে প্রতিপক্ষের অনেক ব্যয়বহুল সমরাস্ত্র সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে।

১৯৫০ এর দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সারফেস টু এয়ার আন্ত মহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র উদ্ভাবনের ফলে অককার্যকর হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের অতি ব্যবহুল আর শক্তিশালী দুটি যুদ্ধ বিমান প্রকল্প। অকার্যকর হয়ে যায় শতাধিক সুপারসনিক ভারী বম্বার। রাশিয়ার শক্তিশালী মিসাইল উদ্ভাবন ব্যাপক প্রভাব ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি ডকট্রিনে ।

রাশিয়ার মিসাইল উদ্ভাবনের কারনে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি যুদ্ধবিমান প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। এগুলো হলো বি-৫৮ হাসলার এবং এক্সবি-৭০ ভলকায়ার। যুক্তরাষ্ট্র ১১৬টি বি-৫৮ হাসলার বম্বার তৈরি করলেও বেশি দিন এই যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সুপার সনিক বম্বার হলো বি-৫৮ হাসলার। ১৯৫৮ সালে এ বিমান প্রথম আকাশে ওড়ে । এর গতি শব্দের চেয়ে দ্বিগুন বা ম্যাচ-২। এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত বম্বার যা পারমানবিক বোমা বহনে সক্ষম।
প্রথমে একটি মাত্র পারমানবিক বোমা বহনের উপযুক্ত করে তৈরি করা হয় এ বম্বার। পরবর্তীতে আরো চারটি বোমা বহনের সক্ষমতা যোগ করা হয় এতে।

সোভিয়োত কোনো ইন্টারসেপ্টর এয়ারক্রাফট যেন বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র অতি উচুতে এবং অতি দ্রুত গতির একটি কৌশলগত বম্বার নির্মানের উদ্যোগ নেয়। সে লক্ষ্যে ১৯৫০ সাল থেকে বি-৫৮ হাসলার উদ্ভাবনের কাজ শুরু করে। ১৯৬০ সালের ১৫ মার্চ ইউএস এয়ারফোর্সে যুক্ত হয় এ বম্বার। এ বম্বার ‘সনিক বুম’ নামে পরিচিতি পায়। কারন যখনই এ বিমান কোনো এলাকা দিয়ে সুপার সনিক গতিতে অতিক্রম করত জনসাধারণ এর তীব্র শব্দ শুনতে পেত । এ বিমান নির্মান করে কনভেয়ার নামক প্রতিষ্ঠান। এর ইঞ্জিন সংখ্যা চারটি। পাইলট তিনজন।

যুক্তরাষ্ট্র মোট ১১৬টি বি-৫৮ হাসলার নির্মান করে। কিন্তু ১৯৫০ এর দশকের শেষে রাশিয়ার তীক্ষè নিশানার এয়ার টু সারফেস মিসাইল উদ্ভাবনের ফলে এ বিমান অকার্যকর হয়ে যায় । মাত্র ১০ বছরের মাথায় ১৯৭০ সালে শেষ হয়ে যায় শক্তিশালী এ সুপার সনিক বম্বারের মিশন। অকার্যকর হয়ে পড়ে ব্যয়বহুল ১১৬ টি শক্তিশালী সুপারসনিক যুদ্ধ বিমান। আসুন জেনে নেই এ সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

১৯৫৯ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপকভাবে মোতায়েন করতে থাকে তাদের নব উদ্ভাবিত এস-৭৫ সারফেস টু এয়ার মিসাইল। এ মিসাইল আকাশের অতি উচুতে ওড়া বিমান ও মিসাইলে অতি নিখুতভাবে আঘাত করতে সক্ষম। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাতেও মোতায়েন করে এ মিসাইল । ফলে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয় বি-৫৮ বম্বারের অপারেশন বন্ধ করতে ।

রাশিয়ার শক্তিশালী মিসাইল উদ্ভাবনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো অনেক শক্তিশালী য্দ্ধু বিমান অকাকর্যকর হওয়ার মুখে পড়ে। তবে সেসব অনেক বিমান যুক্তরাষ্ট্র সংস্কার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বি-৫৮ হাসলার সংস্কার করে প্রচলিত বোমা বহনকারী যুদ্ধ বিমানে পরিণত করা সম্ভব হয়নি । কারন এ কাজ ছিল অনেক ব্যয়বহুল। বি-৫৮ হাসলার রক্ষানবেক্ষন ছিল যেমন ব্যয়বহুল তেমনি এর আকাশে ওড়ার খরচও ছিল অন্যান্য সকল বম্বারের তুলনায় অতিরিক্ত।
একটি বি-৪৭ বম্বার আকাশে প্রতি ঘন্টায় ওড়ার খরচ ৩৬১ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভারী কৌশলগত বম্বার-৫২ প্রতি ঘন্টায় আকাশে ওড়ার খরচ ১ হাজার ২৫ ডলার। আর একটি বি-৫৮ হাসলার প্রতি ঘন্টায় আকাশে ওড়ার খরচ ছিল ১ হাজার ৪৪০ ডলার।

বি-৫৮ হাসলার বম্বারের নির্মান খরচও ছিল অনেক উচ্চ। ১৯৬১ সালে এ বিমান নির্মানের খরচ পড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালের হিসেবে এ খরচ দাড়ায় ২০ বিলিয়ন ডলারের সমান। মাত্র ১০ বছরের অপারেশনে ২৬টি বি-৫৮ হাসলার বিধ্বস্ত হয়।

বি-৫৮ বিমান ছিল বি-৪৭ এবং বি-৫২ বম্বার থেকে বেশি কার্যকরী। কারন বি-৫২ বম্বার শুধু মাত্র আকাশের অতি উচুতে উড়তে সক্ষম। নিচ দিয়ে উড়তে পারে না। অপর দিকে বি-৫৮ আকাশের অতি উচুতে যেমন উড়তে সক্ষম তেমনি নিচ দিয়েও উড়তে সক্ষম। পাইলটরাও অধিকতর পছন্দ করত এ বিমান। বি-৫৮ এর ঝুলিতে রয়েছে ১৯টি গতির রেকর্ড। ১৯৬৩ সালে বি-৫৮ হাসলার টোকিও থেকে লন্ডনে পৌছায় ৮ ঘন্টা ৩৫ মিনিটে। এসময় প্রতি ঘন্টায় ৯৩৮ মাইল ওড়ে এ বিমান। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল এ রেকর্ড।

রাশিয়ার মিসাইলের কারনে অকার্যকর হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর দ্রুত গতির শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান এক্সবি-৭০ ভলকায়ার। পারমানবিক বোমা বহনে সক্ষম কৌশলগত এ বম্বারের গতি শব্দের চেয়ে ৩ গুন বেশি। ৭০ হাজার ফিট উচুতে উড়তে সক্ষম এ বিমান। এর ইঞ্জিন সংখ্যা ৬টি। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় পৃথিবীর এভিয়েশন ইতিহাসে আজো আলোচিত এক্সবি-৭০ ভলকায়ার। এখন পর্যন্ত বিশ্বের দ্রুতগতির যুদ্ধ বিমানের তালিকায় এক্সবি-৭০ ভলকায়ারের স্থান চার থেকে ছয়ের মধ্যে।

অতি উচুতে সুপারসনিক গতিতে ওড়ার কারনে এ বিমান রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম হয় । সোভিয়েত কোনো ইন্টারসেপ্টর এয়ারক্রাফট একে তখন বাধা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি।

তবে বেশি দিন এ বিমান সোভিয়েত আক্রমন থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫০ এর দশকের শেষে ইন্টারনকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র উদ্ভাবন করে। ব্যাপকভাবে মোতায়েন করে এস-৭৫ সারফেস টু এয়ার মিসাইল। ফলে বি-৭০ বম্বার নিচ দিয়ে উড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু নিচ দিয়ে ওড়ার কারনে যে উদ্দেশে এ বিমান তৈরি করা হয়েছিল তা নস্যাত হয়ে যায়।

সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর একটি যুদ্ধ বিমানের চিন্তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র নির্মান করে এক্সবি-৭০ ভলকায়ার। এ বম্বার প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৬৪ সালে। বিমানটির দৈর্ঘ্য ১৮৫ ফিট। প্রস্থ ১০৫ ফিট। জ্বালানি তেল বহন ক্ষমতা ১৪০ টন। শুধু বিমানটির ওজন ১৩০ টন। মেক্সিম্যাম টেকঅফ ক্ষমতা ২৪৫ টন।

এক্সবি-৭০ ভলকায়ারের নির্মানশৈলী নান্দনিক। বিমান বিশেষজ্ঞদের মতে এখন পর্যন্ত যত যুদ্ধ বিমান নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে এর গঠন সবচেয়ে সুন্দর আর আকর্ষনীয়। বিমান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এটি একটি সত্যিকারের মার্ভেল হিসেবে খ্যাত।

শব্দের চেয়ে তিনগুন গতিতে চলা যুদ্ধ বিমানের মধ্যে এক্সবি-৭০ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে ভারী অস্ত্র বহনে সক্ষম বিমান হিসেবে পরিচিত।

রাশিয়ার শক্তিশালী মিসাইল উদ্ভাবনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র মিলিটারি ডকট্রিনে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয় । ৫০ এর দশকের শেষে এবং ৬০ এর দশকের শুরুতে মিসাইল উদ্ভাবনের ফলে মনে করা হয় মানুষচালিত যুদ্ধ বিমানের দিন শেষ হয়ে গেছে।

সামনের দিন হবে মিসাইলের দিন। সে কারনেও তখন কেনেডি প্রশাসন আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এক্সবি-৭০ বিমানের প্রকল্প। ২টি বিমান নির্মানের পর বাতিল করা হয় এ বিমান নির্মান। মাত্র দুটি বিমান তৈরিতে খরচ হয় ১০ বিলিয়ন ডলার। ১৯৬৯ সালে বি-৭০ বিমান পাঠায় ওহাইও যাদুঘরে। এক্সবি-৭০ ভলকায়ারের ডিজাইন তৈরি করে নর্থ আমেরিকান এভিয়েশন। এ বিমান নির্মান গবেষণার সাথে যুক্ত ছিল মহাকাশ সংস্থা নাসা।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে