চীন-আমেরিকা মহাযুদ্ধের ইঙ্গিত

কার্টুনটি করেছেন ফার্গুসন - এফটি ডটকম

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৮ জুন ২০২০, ২০:৫৭

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে প্রধানত বামপন্থীদের মুখে 'মার্কিন' শব্দটির সাথে 'সাম্রাজ্যবাদ' কথাটি অনিবার্যভাবেই উচ্চারিত হতো। আজ স্নায়ুযুদ্ধ নেই, দেশে দেশে বামপন্থীরাও বিলুপ্তপ্রায়, কিন্তু বামপন্থীদের উচ্চারিত শব্দযুগলের সত্যতা এখনো সমুজ্জ্বল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একক পরাশক্তি হলেও তাদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র একটুও পাল্টায়নি, বরং আরো উগ্র হয়েছে। সেই উগ্রতার চেহারা দেখতে ইরাক, আফগানিস্তান এবং বিশ্বের সংঘাতক্ষুব্ধ আরো কিছু অঞ্চলের দিকে চোখ রাখলেই চলে। না-বললেও চলে, যেখানে সংঘাত, সেখানেই আমেরিকা। এতেও বুঝি তাদের যুদ্ধতৃষ্ণা থামছে না। তাই এবার তারা চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়ার হুঙ্কার ছাড়তে শুরু করেছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের চীন বিষয়ক উপ-সহকারি প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাদ সব্রাগিয়া কোনো রাখঢাক না-রেখেই বলেছেন, চীনের সাথে সম্ভাব্য সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। এজন্য বানাতে হবে নতুন নতুন অস্ত্র, বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক করতে হবে আরো জোরদার এবং পেন্টাগনের দক্ষতা বাড়াতে হবে। যদিও এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, কিন্তু আমাদের হতে হবে ক্ষিপ্র ও সুদক্ষ।

আমেরিকা যখন এরকম হুঙ্কার ছাড়ছে তখন খবর পাওয়া গেছে, করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের অনেক খাতে স্থবিরতা নেমে এলেও অস্ত্র খাত এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। অস্ত্রনির্মাতারা বলছেন, করোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে ব্লেয়ারির গোড়ার দিক থেকেই তারা যুদ্ধবিমান নির্মাণের কাজ পূর্ণ মাত্রায় শুরু করেছেন।

একদিকে মার্কিন তর্জনগর্জন, অন্যদিকে কথিত সাম্যবাদী চীনের সামরিক শিল্পের অব্যাহত অগ্রগতি - সব মিলিয়ে একটি আসন্ন মহাযুদ্ধের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন চীনকে নিয়ে এত ভীত বা উদ্বিগ্ন, ইউএস-চায়না ইকনমিক অ্যান্ড সিকিউরিটি কমিশনের কাছে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন চাদ সব্রাগিয়া। যিনি একসময় চীনে মার্কিন দূতাবাসের ডিফেন্স অ্যাটাশে ছিলেন। তিনি বলেন, বহুদিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অভূতপূর্ব নতুন নতুন সম্পদ সংগ্রহের মধ্য দিয়ে চীনের গণমুক্তি ফৌজ বা পিএলএ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্দমনীয় প্রতিপক্ষে পরিণত হয়ে উঠছে। এর ফলে বিশ্বে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ছে, তাদের সামরিক সক্ষমতার আরো আধুনিকায়ন হচ্ছে এবং তারা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের প্রতি আরো কার্যকর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে। চীন যখন তার সীমানার বাইরে নিজের ক্ষমতা দেখাতে সক্ষম হবে, পেন্টাগনের তখন আরো প্রাণঘাতী ও দক্ষ যৌথ বাহিনী গঠন ও মোতায়েন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

চীন বিষয়ক মার্কিন উপ-সহকারি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতে এখন প্রতিরক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হলো, মিত্রদের সাথে বন্ধুত্ব আরো জোরদার করা এবং নতুন বন্ধু যোগাড় করা। এর মাঝ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমন এক অগ্রগতি অর্জন করবে, যার সাথে চীন কিছুতেই পেরে উঠবে না।

পেন্টাগন যখন তার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাথে জোট বাঁধাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু কাজবিরক্ত করে তুলেছে দেশটির পুরনো অনেক ইউরোপীয় ও এশীয় মিত্রদেশকে। বাণিজ্যক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে ট্যারিফকে আগ্রাসী ব্যবহার, বিভিন্ন বহুজাতিক চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা ও অনাকাঙ্খিতভাবে সরে আসা এবং ''আমেরিকা ফার্স্ট'' নীতি - প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এসব কাজ মিত্রদের বিরক্তির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

চাদ সব্রাগিয়া মনে করেন, চীনের একটি দীর্ঘমেয়াদী উচ্চাভিলাষী সামরিক নীলনকশা রয়েছে। যেমন, বহির্বিশ্বে আরো সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, প্রয়োজনে জোর করে তাইওয়ান দখল, বহির্বিশ্বে আরো বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক ও সামরিক সংযোগ স্থাপন। এমনটি হলে চীন-মার্কিন সামরিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে।

আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের ওপর এই কার্টুনটি আাঁকা হয়েছে - স্পুটনিক নিউজ
আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের ওপর এই কার্টুনটি আাঁকা হয়েছে - স্পুটনিক নিউজ

 

চাদ সব্রাগিয়া বলেন, অবশ্য চীনের সাথে প্রতিযোগিতা মানেই যে যুদ্ধ, তা কিন্তু নয়। কিন্তু দেশটি বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে অব্যাহতভাবে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে। এ অবস্থায় আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। নইলে পরাজয় ঠেকানো যাবে না।

চীনা গণমুক্তি ফৌজের নিয়মিত সদস্যসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এর বাইরে আছে প্যারামিলিটারি, আর্মড পুলিস, কোস্টগার্ড ও রিজার্ভ ফোর্স। পক্ষান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ১৩ লাখ আর রিজার্ভ আছে আট লাখ। চীনের ঘোষিত সামরিক বাজেট ২০১৯ সালে ছিল ১৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ১৯৯৮ সালে ছিল ২৮ বিলিয়ন ডলার। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, চীন যা বলে, সামরিক বাজেটে বরাদ্দ রাখে তার চাইতে আরো বেশি।

চীনা সামরিক বাজেটের এই ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিও মার্কিনীদের মাথাব্যথার কারণ। চীন বিষয়ক মার্কিন উপ-সহকারি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কথা থেকেও তা পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বলেন, চীনের এই যে ব্যালাস্টিক ও ক্রূজ মিসাইল মোতায়েন, জঙ্গি বিমান নির্মাণ এবং সাইবার ও মহাকাশ প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে যা হবে তা হলো, কোনো সময় ডাক পেলেও চীনের বাধার মুখে আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক ময়দানে সামরিকভাবে উপস্থিত হতে পারবো না। অপর এক বিশেষজ্ঞ বলেন, চীন বহির্বিশ্বে তার সামরিক ও বাণিজ্যিক লক্ষ্যকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছে। সাংহাই কো-অপারেশন, চীন- পাকিস্তান করিডোর, বেল্ট অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভ এবং অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে এটা দৃশ্যমান।

এ-ই যখন অবস্থা, তখন করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় মোটামুটি বিপর্যস্ত চীনের ব্যবসাবাণিজ্যকে কিছুটা হলেও চাঙ্গা রাখছে সে দেশের অস্ত্রশিল্প খাত। দেশটির সমরবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি ক্রমেই বাড়ছে। কাজেই যে কোনো পরিস্থিতিতেই অস্ত্রশিল্পকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

চীনের সরকারি সংস্থা এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন অব চায়না বা এভিক-এর কয়েকটি সাবসিডিয়ারি সংস্থা সেনাবাহিনীর জন্য যুদ্ধবিমান তৈরি করে থাকে। তারা তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে, গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা তাদের উৎপাদনকাজ পুরো মাত্রায় শুরু করে দিয়েছে। অপরদিকে বিভিন্ন অ্যারোস্পেস ইন্সটিটিউট ও জাহাজনির্মাতা প্রতিষ্ঠান অঙ্গীকার করেছে যে তারা তাদের উৎপাদন ও গবেষণায় করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়তে দেবে না।

এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন অব চায়না বা এভিক-এর সাবসিডিয়ারি সংস্থা চেংদু অ্যারোস্পেস কর্পোরেশন বা সিএসি চীনা গণমুক্তি ফৌজের জন্য নতুন প্রজন্মের জে-২০ জঙ্গি জেট বিমানের ডিজাইন প্রণয়ন ও নির্মাণ করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, আগামী এক দশকের মধ্যেই তারা এ ধরনের কমপক্ষে ৩০০টি বিমান নির্মাণ করবে। একজন চীনা বিশেষজ্ঞ জানান, চলতি বছরটি শেষ হওয়ার আগেই গণমুক্তি ফৌজের এ ধরনের কমপক্ষে ৫০টি বিমান দরকার, যা তারা এশিয়া-প্যাসিফিক রিজিয়নে মোতায়েন করতে চায়। ইতিমধ্যে সেখানে এ ধরনের ২৪টি যুদ্ধবিমান মোতায়েন রয়েছে।

ইস্পাত কারখানার মতো আরো কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানও তাদের কাজ শুরুর কথা জানিয়েছে। এটাও সামরিক শিল্প খাতের জন্য ইতিবাচক দিক। কেননা, এসব কারখানা চালু না-হলে বিমান ও জাহাজ নির্মাণ কারখানা চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

চীনের একজন নৌ-বিশেষজ্ঞ লি চিয়ে বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমেরিকা যেহেতু উত্তর-পশ্চিম এশিয়া, বিশেষ করে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই শতাধিক অত্যাধুনিক এফ-৩৫ পঞ্চম প্রজন্মের জঙ্গি জেট বিমান মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে, কাজেই চীনেরও উচিত হবে তার নিজস্ব নতুন জঙ্গি জেট বিমান নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করা।

তিনি বলেন, আমেরিকা গত কয়েক বছরে তার ওকিনাওয়া অঙ্গরাজ্যের কাদেনা বিমানঘাঁটিতে এক ডজনেরও বেশি এফ-২২ জঙ্গি জেট বিমান মোতায়েন করেছে। এটা চীনের প্রতি প্রত্যক্ষ্য হুমকিস্বরূপ।

চীনের জে-২০ জঙ্গি জেট বিমানের নবতম সংস্করণটি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০১৮ সালে মোতায়েন করা মার্কিন এফ-২২ ও এফ-৩৫ জঙ্গি জেট বিমানকে মোকাবিলা করতে সক্ষম। লি জানান, করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে নতুন চান্দ্র্য বছরের প্রথম এক মাস অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণশিল্পে স্থবিরতা নেমে এসেছিল। এখন সবার আবার পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করা উচিত। এদিকে জঙ্গি জেট বিমান ছাড়াও চীন আরো দুই ধরনের ০০২ নিউ জেনারেশন এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এগুলো হবে পরমাণু অস্ত্রসম্বলিত মার্কিন ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ডের সমতুল্য, যা উৎক্ষেপণ করা হয় বিশ্বের সর্বাধুনিক ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এয়ারক্র্যাফট লাঞ্চ সিস্টেম দিয়ে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে