চ্যালেঞ্জের মুখে ন্যাটো

ছবি - সংগৃহীত

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৫ এপ্রিল ২০২০, ২০:৫৭

এ যেন আরেক বিশ্বযুদ্ধ। এর একদিকে সারা বিশ্ব, অন্যদিকে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস। বিশ্বের ধনাঢ্য দেশগুলো এতোদিন একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করার বা অপর দেশকে ধ্বংস করার জন্য যত রকম বিধ্বংসী মারণাস্ত্র বানিয়েছে, তার কোনোটাই কিন্তু চলমান অঘোষিত বিশ্বযুদ্ধে কোনো কাজে আসছে না। বরং সব অস্ত্র গুদামে মজুদ রেখে অসহায়ের মতো পড়ে পড়ে মার খেতে হচ্ছে অদৃশ্য দানব করোনার কাছে। শুধু কি তা-ই, এমন কথাও উঠছে যে, এটা হচ্ছে জীবাণু অস্ত্র পরীক্ষারই একটা পরিণাম। উহান নগরীর ল্যাবে গোপনে চলছিল জীবাণুকে অস্ত্র বানানোর পরীক্ষা, সেখান থেকে কোনো এক ফাঁকে কিছু জীবাণু ছুটে এসে লোকালয়ে তান্ডব শুরু করে। এটা অবশ্য সত্য না-ও হতে পারে, হতে পারে নেহাতই গালগল্প। কিন্তু প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষকরা যে সত্যটি বলছেন, তা যুদ্ধবাজ বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর নেতাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলবে বৈ কি।

অনেক প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক বলছেন, করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি যেমন গুরুতর ক্ষতির শিকার হবে, শিগগিরই তার প্রভাব পড়বে প্রতিরক্ষা খাতের ওপরও। করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যয় ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার ক্ষতিকেও অনেকদূর ছাড়িয়ে যাবে। এ লড়াইয়ের আর্থ-সামাজিক ফলাফল এতোই ব্যাপক হবে যে, ইউরোপের দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার চিন্তা বাদ দিয়ে সামনে উপস্থিত অর্থনৈতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার কথাই অগ্রাধিকারভিত্তিতে ভাবতে বাধ্য হবে। এটা তারা এমনি-এমনি বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করবে না। এটা হবে মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

করোনা সঙ্কটের কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো যদি সত্যিই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তা হবে গত এক দশকের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতের ওপর দ্বিতীয় আঘাত। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ সবে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরতে শুরু করছিল। যদিও অনেক দেশের সেই সামর্থ্যও ফিরে আসেনি। দেশগতভাবে এবং একই সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইইউ এবং ন্যাটো পর্যায়ে প্রতিরক্ষা বাজেটের বিশাল গ্যাপটি চোখে পড়ার মতো। গত দুই দশকে ইউরোপীয় সেনাবাহিনীগুলো তাদের এক-তৃতীয়াংশ সক্ষমতা হারিয়েছে আর একই সময়ে প্রকাশ্যে বৈরী রাশিয়া ও উদীয়মান চীনের কারণে সৃষ্টি হয়েছে হুমকির পরিবেশ।

ইউরোপের প্রতিরক্ষা বাজেট যখন এমন চাপের মুখে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখা হচ্ছে সম্ভাব্য ত্রাতার ভূমিকায়। বলা হচ্ছে, ন্যাটোর সক্ষমতা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের উচিত মিত্রদের সাথে একযোগে কাজ করা। তারাই পরস্পরবিচ্ছিন্ন মিত্রদের মধ্যে দায় ভাগাভাগির কোনো একটা ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে পারবে। অন্যথায় সামরিকভাবে দুর্বল ইউরোপ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারবে না।

পর্যবেক্ষকরাও বলছেন, অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি না চাইলে ইউরোপকে পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। তাদের মতে, ইউরোপের দেশগুলোর একটা বড় ভুল হলো, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় তারা প্রতিরক্ষা বাজেট কমিয়েছে নিজ নিজ সিদ্ধান্তে , গোটা ইউরোপের সবগুলো দেশ একসাথে বসে সমন্বিতভাবে নয়। এবার করোনার কারণে অর্থনীতিতে যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে, তা সামাল দিতে ইউরোপের সরকারগুলো আবারও সেই পুরনো পথেই হাঁটবে বলে মনে হচ্ছে। তেমন কিছু করা হলে তা হবে এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো প্রতিরক্ষা বাজেট হ্রাস। এতে করে ন্যাটো-র অনেক কিছুই আর করার থাকবে না। এর ফল হবে গুরুতর।

করোনার প্রভাবে ন্যাটো-র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা কিনা ইউরোপকে আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রথিত করে রেখেছে, তা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা, স্ট্র্যাটেজিক এয়ার ট্রান্সপোর্ট অথবা নেভাল স্ট্রাইক গ্রুপস -এর মতো যেসব সক্ষমতা কেবল বহুজাতিক উদ্যোগে সৃষ্টি ও কার্যকর হয়, সেগুলো আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে এবং কোনো-কোনোটি হারিয়েও যেতে পারে। ইউরোপীয়রা যদি আবারও তাদের অস্ত্রভান্ডার থেকে অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার, সব ধরনের সাঁজোয়া যান এবং মাইন-ওয়ারফেয়ার ছেঁটে ফেলে, তাহলে তাদের সামরিক সক্ষমতাই বিপন্ন হবে। ১০ বছর আগে এসব তাদের যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। ন্যাটো-র এখন এগুলোর প্রয়োজন যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি। তাদের উচিত হবে যে কোনো মূল্যে এই ছাঁটাই ঠেকানো। কারণ, নতুন করে এসব গড়তে প্রয়োজন হবে বিপুল অর্থ ও অনেক সময়ের। নিজেদের মধ্যে দায় ভাগাভাগি করতে না-পারলে ইউরোপের দেশগুলো দুর্বল সামরিক শক্তির দেশে পরিণত হবে এবং এমনকি এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার হওয়ার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলবে।

প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট কমানোর বিষয়টি সমন্বিতভাবে না হলে তা অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও সংগ্রহ বিলম্বিত, এমনকি অর্ডার বাতিলের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে প্রতিরক্ষা শিল্পকেও ক্ষতিগ্রস্থ করবে। এর ফল ভোগ করতে হবে ইউরোপ ও আমেরিকান কম্পানিগুলোকে। এর ওপর ইউরোপে জাতীয় চেতনা যেভাবে ক্রমেই বেড়ে চলেছে তাতে করে বিভিন্ন কম্পানির সাময়িক একীভূতকরণও আর হতে পারবে না। অথচ দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এ অবস্থায় কম্পানিগুলো প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের রফতানি ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিয়ে আগ্রাসী রূপে আন্তর্জাতিকীকরণের দিকে পা বাড়াতে পারে। অথবা নির্ভরযোগ্য ক্রেতাদের হারিয়ে কেবল দেশের ক্রেতা অর্থাৎ সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। এতে করে প্রতিরক্ষা খাতে নতুন নতুন উদ্ভাবনা বিঘিœত হবে আর এর পরিণাম ভোগ করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর এমন সক্ষমতা ও অবকাঠামোর ক্ষতি রোধ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এখনই তার ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে কাজ শুরু করা। ন্যাটো-রও উচিত তার বর্তমান সক্ষমতা ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া এবং বিকল্প কিছু থাকলে তা সংহত করা। ন্যাটো-র লক্ষ্য ও অগ্রাধিকার পূণঃমূল্যায়নের জন্য নিতে হবে একটি সমন্বিত উদ্যোগ। এর লক্ষ্য হবে ন্যাটো-র সামরিক সক্ষমতা ধরে রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় ও সেকেলে সরঞ্জামগুলো বর্জন করা। এ ধরনের একটি সমন্বিত উদ্যোগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতাও নিশ্চিত করতে হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে ন্যাটো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। ন্যাটোকে টিকে থাকতে হলে ফ্রেমওয়ার্ক ন্যাশনস কনসেপ্টের ওপর ভর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে আরো বেশিসংখ্যক দেশকে নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করা। যে নেটওয়ার্ক হবে চলমান অর্থনৈতিক অভিঘাত মোকাবিলায় আরো সুসজ্জিত এবং কাজ করবে জাতিসমূহের নেতার মতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাতে কতটা সক্ষম হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

করোন পরবর্তী পরিস্থিতিতে ন্যাটো যদি কার্যকর ভুমিকা পালন করতে চায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা সক্ষমতাসমূহের সুরক্ষা দিতে হবে। ছোট শরীককেও দিতে হবে বড়দের সক্ষমতার অংশভাগী হওয়ার সুযোগ। যার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে একটি জরুরি বাহিনীর। এ ধরনের একটা ব্যবস্থা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও সামরিক সক্ষমতা ধারণক্ষমতার মধ্যে এনে দেবে অপেক্ষাকৃত ভালো একটা ভারসাম্য। পাশাপাশি ন্যাটোরও উচিত প্রচলিত সামরিক শ্রেষ্টত্বের ধারণার ঊর্ধে ওঠা এবং হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার ও ইউরোপের বিরুদ্ধে বিদেশি মদদপুষ্ট অভিযান থেকে শিক্ষা নেয়া।

মোটের ওপর ন্যাটোর কৌশলগত স্বশাসনের বিষয়টি মিত্রদের মেনে নিতে হবে। অনাগত দিনগুলোতে আটলান্টিকের উভয় পাড়কে বাঁচতে হবে একটাই লক্ষ্য নিয়ে। আর তা হলো  ন্যাটো ফার্স্ট। সবার আগে ন্যাটো। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন ন্যাটো ফাস্ট কথাটি বলা সহজ কাজে পরিনত করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে ন্যাটোর ব্যয়বহন নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশ্ন তুলেছেন। এখন যে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে তিনি চাইবেন ইউরোপের দেশগুলো সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াক। জার্মানী বা ইতালির মতো দেশ তাতে আগ্রহী হবে বলে মনে করার কারন নেই। ফলে নিরাপত্তার দিক দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোও বড় ধরনের সঙ্কটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।