যে কারনে নতুন সমরাস্ত্রে পবিত্র পানি ছিটাতে রাজি নয় রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চ

রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চ -সংগৃহীত -

  • মেহেদী হাসান
  • ০৯ মার্চ ২০২০, ১৩:৩৭

রাশিয়ার নিয়ম হলো নতুন কোনো সমরাস্ত্র তৈরি করা হলে তাতে চার্চের পাদরিদের পবিত্র পানির ছিটা নেয়া হয়। কালাশনিকভ থেকে শুরু করে নতুন মিসাইল, যুদ্ধ বিমান, রণতরি, নভোযান, সামমেরিন, পারমানবিক বোমা সব কিছুতে পাদরিদের আশীর্বাদ এবং পবিত্র পানির ছিটানো নেয়া হয়। রাশিয়ার সেনা কর্মকর্তারা বিশ্বাস করে এসব সমরাস্ত্র ঐশ্বরিকভাবে সুরক্ষা পাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে। বর্তমানে পবিত্র পানির ছিটা নেয়ার সংস্কৃতি ব্যাপক আকারে বেড়েছে। নতুন গাড়ি থেকে শুরু করে সশস্ত্র বাহিনীতে নতুন সৈন্য যোগদানের সময়ও তাদের শরীরে পবিত্র পানি ছিটানো হয়।


সমরাস্ত্রে পানি ছিটানো নিয়ে অর্থডক্ত চার্চের পক্ষ থেকে এক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যাতে অনেকে হতবাক হয়েছেন। চার্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তারা এখন থেকে আর এ পবিত্র পানি ছিটাতে এবং আশীর্বাদ করতে রাজি নন। কারণ এসব অনেক সমরাস্ত্র ব্যবহার করা হয় নির্বিচারে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে । অর্থডক্স চার্চের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রাশিয়ায় বেশ আলোচনা চলছে। রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চ কমিশন ফেব্রুয়ারি মাসে এ বিষয়ে একটি খসড়া ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছে । অনলাইনে প্রকাশিত এ ডকুমেন্টে তাদের প্রস্তাব নিয়ে নাগরিকদের মতামত দিতে বলা হয়েছে। আগামী জুন মাস পর্যন্ত এ প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে প্রস্তাব ও বিতর্ক চালূ রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। চার্চের এ প্রস্তাব পাশ হলে ব্যাপক বিধ্বংসী বিভিন্ন সমরাস্ত্রে পবিত্র পানি ছিটানোসহ ধর্ম যাজক বা পাদরিদের আশীর্বাদ নেয়ার রেওয়াজ বন্ধ হয়ে যাবে।
তবে সৈন্যবহন করা বিমান ও রণতরিতে তারা তাদের পবিত্র পানি ছিটানো অব্যাহত রাখবেন বলে রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে। অর্থডক্স চার্চ কমিশনের প্রকাশিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে সমরাস্ত্রকে আশীর্বাদ জানানো অর্থডক্স চার্চের ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে না। যে কোনো ধরনের সমরাস্ত্র যার মাধমে মাধ্যমে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা যায় তাতে চার্চের পাদরিদের আশীর্বাদ করার সংস্কৃতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তবে সৈনিকদের বহন করার জন্য নতুন তৈরি করা গাড়ি, বিমান ও রণতরীতে এ পানির ছিটা দেয়া যাবে যাতে সৃষ্টিকর্তা এসব যানবাহনের সৈনিকদের রক্ষা করেন।

রাশিয়া নতুন কোনো সমস্ত্র উদ্ভাবন করলে তাতে পাদরিদের আশীর্বাদ ও চার্চের পানির ছিটা নেয়ার রেওয়াজ অনেক পুরনো। চার্চের যাজকদের কর্তৃক ছিটানো পানিকে পবিত্র এবং ঐশ্বিরিক আশীর্বাদপুষ্ট গণ্য করা হয় রাশিয়ায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর পবিত্র পানি ছিটানোর এ রেওয়াজের পরিধি বাড়তে থাকে। নতুন উদ্ভাবিত সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র থেকে শুরু করে বর্তমানে তা সৈনিকদের পরিবহনের জন্য নতুন কোনো গাড়ি রাস্তায় নামানো হলে তাতেও পবিত্র পানির ছিটা দেওয়া হয়। অনেকে আবার ব্যক্তিগত কোনো বাড়ি ঘর বা ফ্লাটের মালিক হলে তাতেও চার্চের পানি ছিটায় আশীর্বাদস্বরূপ।

গত দুই দশকেরও বেশি ধরে ক্ষমতায় থাকা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রাশিয়ার অর্থডক্স চার্চের সাথে ঘণিষ্ট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাশিয়ায় বর্তমানে চার্চ এবং পাদরিদের কদর অনেক বেড়েছে। যা বলশেভিক বিপ্লব পরবর্তী সমজতান্ত্রিক রাশিয়ার আমলে ছিল কল্পনারও অতীত। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ায় নির্বিচারে পুড়িয়ে দেয়া হয় অসংখ্য চার্চ, ক্যাথেড্রাল। মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় শত শত যাজকদের। এক তথ্যে দেখা যায়, বলশেভিক বিপ্লবের প্রথম ৫ বছরেই মৃত্যুদন্ড দেয়া ১ হাজার ২শ যাজককে। এ ছাড়া যাজক, পাদরি ও আর্চ বিশপদের গ্রেফতার, নির্বাসন, আর নির্যতানের ঘটনা ঘটে অগণিত। হাজার হাজার চার্চ সরকারি দখলে নিয়ে হয় তা ধ্বংস করা হয় অথবা অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়। দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকে রাশিয়ায় চার্চ, পাদরি আর ধর্ম বিরোধী এ অভিযান। বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৮০ দশকের শুরু থেকে মিখাইল গর্ভাচেভের সময় থেকে চার্চ ও পাদরিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা হয় । বর্তমানে চার্চ ও পাদরিদের ধর্মীয় এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ছাড়াও ২০১০ সাল থেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে পাদরিদের পদ দেয়া শুরু করেছে । সামরিক বাহিনীর একটি এয়ারবর্ণ ইউনিটসহ বিভিন্ন বিভাগে পাদরিদের র‌্যাঙ্ক দেয়া হয়। কোথাও নতুন কোনো সামরিক ঘাটি খোলা হলে সেখানে স্থাপন করা হয় চার্চ এবং নিয়োগ দেয়া হয় পাদ্রীদের। যেমন বর্তমানে সিরিয়ায় স্থাপিত রাশিয়ার সামরিক ঘাটিতেও দেখা গেছে চার্চ এবং পাদ্রী ।

পবিত্র পানির ছিটা ও চার্চের আশীর্বাদ সংস্কৃতির কারনে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের সাথে ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে চার্চের সাথে। বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সার্গেই সইগুর সাথে রয়েছে চার্চ কর্তৃপক্ষের নিবিড় যোগাযোগ। মস্কোর বাইরে সেনা সদস্যদের জন্য বর্তমানে নির্মিত হচ্ছে বড় মাপের একটি ক্যাথেড্রাল। এটি তত্ত্বাবধান করছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
মারনাস্ত্রে চার্চের পবিত্র পানির ছিটানো বন্ধের প্রস্তাবকে অনেকে খূবই তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন এলাকায় যেসব যুদ্ধ চলছে তাতে যেভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যাসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করা হচ্ছে তাতে বিশ্ববিবেক মর্মাহত। রাশিয়ায়ও সিরিয়ায় বর্তমানে বাশার আল আসাদের পক্ষ নিয়ে ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত । রাশিয়ার বিমান হামলায় সেখানে মারা যাচ্ছে নারী শিশুসহ ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক লোক। ধ্বংস হচ্ছে ঘর বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। আসাদ বাহিনীর সাথে রাশিয়ার যৌথ হামলার কারনে লাখ লাখ সিরিয়ান ঘর বাড়ি আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। শুধূমাত্র গত ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ইদলিবে অভিযানের কারনে সেখান থেকে ৯ লাখ সিরিয়ান ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। অনেকে অনেক আগে থেকেই পারমানবিক বোমাসহ ব্যাপক বিধ্বংসী বিভিন্ন অস্ত্র নির্মূলের কথা বলে আসছেন। চার্চের এ প্রস্তাব অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের নৈতিক প্রতিবাদ ও অবস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া চার্চের সাথে পুতিন ও প্রতিরক্ষা বিভাগের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাতেও টানাপড়েন সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট পুতিন কখনো ধর্মীয় প্রতিষ্টানগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। বরং সুসর্ম্পক বজায় রেখে চলছেন।
নতুন সমরাস্ত্রের প্রতি ভক্তি আর বিভিন্ন ধরনের নৈবেদ্য প্রদানের সংস্কৃতি বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। যেমন সম্প্রতি ভারত ফ্রান্স থেকে রাফালে বিমান কেনার পর তাতে ভারতের একজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং হাতের আঙ্গুলে লাল রং দিয়ে ওম শান্তি লিখতে দেখা গেছে। এসময় যুদ্ধ বিমানের ওপর রাখা ছিল একটি নারকেল ও কিছু ফুল। নারকেলের গায়ে লাগানো হয়েছিল লাল রং। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার কেনার পর তা উড়ানোর আগে নারকেল ও ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। ভারতে বর্তমানে হিন্দুত্ববাদি সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে সেনাবাহিনীতে ধর্মীয় আচার ও অনুষ্টানের মাত্রা অনেকগুন বেড়ে গেছে।

বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর সাথে ধর্মের নিবিড় সর্ম্পক রয়েছে। সৈনিকদের ধর্মীয় অনুপ্রেরনা থেকে উজ্জীবিত করা হয়েছে। মুসলিমদের এ ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বে নানা ধরনের সমালোচনা করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সেনাবাহিনীতে ধর্মীয় আচারন ও সংস্কৃতির প্রভাব একেবারেই কম নয়। কিন্তু রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে পাদরিদের প্রভাব নিয়ে অতীতে খুব একটা আলোচনা হয়নি। অনেক শান্তিবাদি মনে করেন রাশিয়ার পাদরিরা সমরাস্ত্রে পানি না ছিটানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা এক ধরনের যুদ্ধ বিরোধী মনোভাবে বহি:প্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।