করেনাকালে রমজান

ছবি - সংগৃহীত -

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০১ মে ২০২০, ১৩:৫৯

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর কারণে মানুষ শুধু যে জীবন-মৃত্যু নিয়ে আতঙ্কে ভুগছে তা নয়, সারা বিশ্বের ধর্মপ্রান অসংখ্য মানুষও পড়ে গেছেন বিপদে। করোনাকালে সব রকম সমাবেশ নিষিদ্ধ করায় মসজিদ, গির্জা, সিনাগগ ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্টানে ও বন্ধ হয়ে গেছে নামাজ, প্রার্থনা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এলো রমজান।

সারা বিশ্বের মুসলিমদের সবচাইতে পবিত্র স্থান হলো সউদি আরবের মক্কা ও মদিনা নগরী। করোনা মহামারীর কারণে এ দু' নগরীও এখন বহির্বিশ্বের মুসলিমদের জন্য তো বন্ধ বটেই, এমনকি স্থানীয় মুসলিমদের জন্য পর্যন্ত পবিত্র ক্বাবা ও মসজিদে নববীসহ সকল মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এমন অবস্থায় পবিত্র রমজান মাস। এ মাসকে বলা হয় সংযম ও সহমর্মিতার মাস। এ মাসেও কি পবিত্র মক্কা-মদিনা বন্ধই থাকবে? - এমন একটা প্রশ্ন গুঞ্জরিত হতে শুরু করেছিল বিশ্ব মুসলিমের মনে। তাঁরা আশা করছেন, পবিত্র রমজানে এ কড়াকড়ি কিছুটা হলেও শিথিল করা হবে। কেননা, এ মাস মুসলিমদের শিক্ষা দেয় অপর মুসলিম ভাইয়ের যত্ন নিতে।

তুরস্কের বসরা নগরীর উলুদাগ ইউনিভার্সিটির ধর্মতত্ত্বের প্রফেসর চেফার কারাদাস বলেন, পবিত্র রমজান মানেই একটা অন্য রকম আবহাওয়া, যা মানুষকে অপরের কথা ভাবতে শেখায়। রমজানের চেতনাই হলো, এ সময় মুসলিমরা নগদ অর্থ কিংবা সেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে অভাবী মানুষকে সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, রমজান মানে শুধু দিনের বেলায় উপবাস করা আর নির্দিষ্ট কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা নয়। বরং এটা হলো উপবাসের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সেসব মানুষের কষ্টকে উপলব্ধি করতে শেখা, যাদের খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই।

প্রফেসর কারাদাস মনে করেন, অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে এবার করোনা ভাইরাস মহামারীর সময়ে পবিত্র রমজানের গুরুত্ব অনেক বেশি। রমজানের শক্তিশালী চেতনা দিয়ে করোনা মহামারীর বেদনাদায়ক প্রভাব লাঘব করা সম্ভব। কারণ, করোনার সংক্রমণ এড়াতে লোকজনকে নিজ নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। এভাবে কর্মহীন বসে থাকতে হওয়ায় তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের এবং জীবনধারণের অন্য সব সামগ্রীর সংস্থান করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। রমজান মাস এসব অভাবী মানুষের দরজায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেয়ার একটা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।

সবার জানা যে, লকডাউন ব্যবস্থার কারণে বাড়িতে আটকে পড়া অসংখ্য মানুষ আয়ের পথ হারিয়ে ফেলেছে। সারা পৃথিবীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা মহাদেশ থেকে এশিয়া, সবখানেই বেকারত্ব বাড়ছে রকেটের গতিতে। এ অবস্থায় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাহায্য সংস্থা অক্সফাম ক'দিন আগে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে , করোনা মহামারীর পরিণামে বিশ্বের ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ গরীব হয়ে যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও সম্প্রতি বলেছে, করোনার থাবায় বিশ্বের প্রায় ২০ কোটি ফুলটাইম ওয়ার্কার তাদের চাকরি হারাতে পারে। এমন অবস্থায় পবিত্র রমজান মাসের আগমনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকে। এ রকম একজন হলেন হুসেইন আরি। যিনি তুরস্কের একজন ইসলাম বিষয়ক পন্ডিত ব্যক্তি। তিনি মনে করেন, করোনার কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে পড়ে ছটফট করতে থাকা বহু পরিবার পবিত্র রমজানের সহমর্মিতার চেতনার কারণে অভাবের দুর্ভোগ রক্ষা পাবে।

হুসেইন আরি বলেন, রমজান এমন একটা মাস, যখন দান-অনুদান প্রদান এবং অপরকে সহায়তার বিষয়টি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়। ধনী মুসলিমরা সাধারণত এ পবিত্র মাসেই জাকাত প্রদান করে থাকেন। জাকাত-ফিতরা ছাড়াও তাঁরা গরীবদেরকে প্রচুর দান-খয়রাত করেন, যাতে গরীবরাও পরিপূর্ণ সুখী মন নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারে।
ইসলাম বলে, পবিত্র রমজান মাসে যে কোনো ধরনের ইবাদত ও ভালো কাজ আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। হুসেইন আরি বলেন, এ কারণেই করোনার কারণে যারা চাকরি হারিয়েছেন কিংবা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে আছেন, তাদেরকে সাহায্য করলে তা আল্লাহর কাছে বেশি কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

তিনি এ প্রসঙ্গে উদাহরণ তুলে ধরেন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা)-এর, যাঁর দানের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না, বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসে। হাদিসে বর্ণিত আছে, নবীজী বলেছেন, ''যে মানুষ তার মুসলিম ভাইকে সাহায্য করবে, আল্লাহ সাহায্য করবেন তাকে''।
অনেক ইসলাম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি বলছেন, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা) তাঁর জীবনে সহায়তার যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা মেনে চলার দিকে মুসলমানদের মনোযোগী হতে হবে। ঈমান যদি ধর্মের অর্ধেক হয়, তাহলে বাকি অর্ধেক হলো নিজের সহায়-সম্পদ অন্যের সাথে ভাগ করে খাওয়া। তা যদি কেউ না-করে, তাহলে সে মানবতার জন্য কিছুই করলো না। পবিত্র রমজানে যদি করোনাপীড়িত মানুষের জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করা যায় , তাহলেই পবিত্র এ মাসের সত্যিকার চেতনা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে।

করোনার কারণে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ন্যাশনাল লকডাউন ঘোষণা এবং জনসমাগম নিষিদ্ধ হওয়ায় মানুষের জীবনে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণে সেসব দেশ ও জনগণ একে অপরকে সহায়তা করার নানা রকম কর্মকৌশল গ্রহন করেছে। যেমন, ইন্দোনেশিয়ার ধর্ম মন্ত্রণালয় দেশের ধনী মানুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা এবার রমজানের আগেই জাকাত দিয়ে দেন। সাথে এটাও যেন লক্ষ্য রাখেন যেন জাকাত দেয়ার সময় ভিড় হয়ে করোনা সংক্রমিত হতে না-পারে।

এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেন একটি নির্দিষ্ট স্থানে কিছু খাদ্য রেখে যান, আর গরীবরা এসে তা থেকে প্রয়োজনমতো তুলে নিয়ে যাক। পবিত্র রমজান সারা মুসলিম বিশ্বে এ ধরনের সৃজনশীল চিন্ত-চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারে। বিশেষ করে সরকারি কর্মী ও অন্যরা, যাদের চাকরি ও বেতন আছে তারা বেকার ও গরীব মানুষের কষ্ট লাঘবে পবিত্র এ মাসে কোনো-না-কোনো পন্থায় এগিয়ে আসেন তা হলে গরিবরা অনেক কম সঙ্কটে থাকবেন।
রোজার একটি অন্যতম দিক হচ্ছে সম্পদশালী সৌভাগ্যবানরা রোজা রেখে লাখ লাখ মানুষের বেদনা ও যাতনা, দুঃখ ও দুর্ভোগ উপলব্ধি করতে পারে।
মাহে রমজানের রোজা ধনী ও দরিদ্র, সচ্ছল ও নির্বিত্ত এবং প্রাচুর্যের অধিকারী ও অভাবীর মাঝে যোগসূত্র। এই অভিজ্ঞতা থেকে দয়া ও সহমর্মিতা বাড়ানো উচিত। অভাবগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার জন্য সম্পদ ও সময় ব্যয়ের মতো মহানুভবতায় এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। বিশেষ করে এই রমজান মাসে মুসলমানদের উৎসাহ দেয়া হয় ক্ষুধার্তকে খাওয়াতে এবং ভালো কাজে সম্পদ ব্যয় করতে। শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, লঙ্গরখানা স্থাপন এই ভালো কাজের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলের সা: হাদিসে বলা হয়েছে, রমজানে ভালো কাজের প্রতিদান বছরের অন্য সময়ের তুলনায় দশ গুণ। এই বরকতময় মাসে সর্বপ্রকার সৎকর্ম ও বদান্যতার দশ গুণ প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করেছেন আল্লাহতায়ালা। আর তা দেয়া হবে ইহকাল ও পরকাল, উভয় ক্ষেত্রেই।

করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে বলছেন মনোবল না-হারাতে। বলছেন, এ রকম দুর্দিনে ভেঙে পড়া নয়, মুসলিমদের উচিত এর থেকে বের হয়ে আসার একটা ভালো পথ খুঁজে বের করা। মুসলিম বিশ্ব এ পবিত্র মাসের চেতনায় কতোটা উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত হতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।