ন্যায়পরায়ণ সাহসী শাসকের প্রতীক জাস্টিন ট্রুডো

- সংগৃহীত

  • ফারজানা তানিয়া
  • ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩৪

এই গ্রহে শাসকদের চরিত্র ক্ষয়ে যেতে যেতে কুৎসিত আকার ধারণ করেছে। কেউ ক্ষমতায় আছেন সাধারণের টুটি চেপে ধরে, কেউ আছেন নীতি-বিবর্জিত মোড়লদের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে। হাতেগোনা ক’জন আছেন, যারা ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে তাবৎ গ্রহের মানুষের কাছে প্রিয়? ক’জন আছেন, যাদের মুক্ত গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা যায়? বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘুদের পক্ষে সাহসী, অসহায় অভিবাসন-প্রত্যাশীদের প্রতি উদার মন কিংবা মানবাধিকারের প্রতি উচ্চকণ্ঠ- এমন শাসকদের সংখ্যা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নামতে বসেছে। ঠিক এমন সময় যাকে মানুষ ভালোবাসায় আবদ্ধ করে নিয়েছেন, তিনি জাস্টিন ট্রুডো। কানাডার প্রধানমন্ত্রী।

সম্প্রতি ‘খালিস্তান মুভমেন্ট’ ঘিরে তোলপাড় করা ঘটনায় জাস্টিন ট্রুডো যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে বীরত্বের প্রতীক হয়ে থাকবেন।

এই মুভমেন্টের নেপথ্য কাহিনী হলো- একটি ছোট্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি একটি বড় সম্প্রদায়ের মর্মান্তিক নিপীড়নের ইতিহাস। ভারতে শিখ ধর্মাবলম্বীরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। তাদের মূল আবাস পাঞ্জাবে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তাদের ওপর হিন্দুদের যে-নির্যাতন হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। ১৯৭০-এর দশকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের হাজার হাজার মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে, হাজার হাজার লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। শেষ পর্যন্ত তারা হিন্দুদের সঙ্গে থাকতে চায়নি; আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছে।

জাস্টিন ট্রুডো ভারতের দেড়শ কোটি মানুষের বিশাল বাজারের দিকে তাকিয়ে ভারতের পক্ষে থাকতে পারতেন। ইতিহাসের সত্যকে উপেক্ষা করে গতানুগতিক লাভ-লোকসানের হিসাব মেলাতে পারতেন। তিনি তা করেননি। বরং, তিনি অল্প কিছু মানুষের পক্ষে গিয়ে ভারতের বাজার হারানোর মতো ঝুঁকি নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিত করেছেন। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার কথা সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। সেই গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে বহিষ্কারের মতো দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এরপর ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার এবং তাদের লালিত সংবাদমাধ্যম ট্রুডোর পেছনে এমনভাবে লেগে আছে, যেন কানাডা জঘন্য কিছু করেছে, এখনই দেশটি ধ্বংস হওয়ার পথে, ট্রুডোর সরকারের যেন এখনই পতন হবে, ইত্যাদি। কিন্তু, ট্রুডো তার মানবিক নীতিতে অটল; কোনো কিছুই আমলে নিচ্ছেন না। অবশ্য, এই ইস্যুতে তিনি যথারীতি বিশে^র মানবতাবাদী শাসকদের সমর্থন পাচ্ছেন।

শুধু শিখ নয়, বিশে^র বিভিন্ন দেশে চলতে থাকা সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কানাডার প্রধানমন্ত্রী। এ-কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছেও তিনি ভালোবাসার পাত্র হয়ে আছেন।

এ-ই তো, বছর দুয়েক আগের ঘটনা। কানাডায় ট্রাক তুলে দিয়ে একটি মুসলিম পরিবারের চার সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনায় জাস্টিন ট্রুডো যেভাবে মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তা মুসলিমরা কখনও ভুলবেন না। এ-ঘটনায় বিশাল ধর্মীয় ভোটব্যাঙ্কের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি নিরাপত্তা-শঙ্কায় থাকা কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়কে আশ^স্ত করে বলেছিলেন, মুসলিমদের সঙ্গে আছে তার সরকার।

পরিকল্পিতভাবে মুসলিম জেনেই পরিবারটির ওপর ট্রাক উঠিয়ে দিয়েছিল চালক। নিহতদের স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ট্রুডো লিখেছিলেন, ‘এই ঘটনার খবর পেয়ে আমি স্তম্ভিত হয়েছি। যারা বিদ্বেষপ্রসূত এই আচরণের শিকার হয়েছেন, তাদের স্বজনদের পাশে আমরা আছি, থাকব।’ তার আশ^স্ত করার ভাষা ছিল অসাধারণ। বলেছিলেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুটির পাশে আমি থাকব।’ মুসলিমদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই কঠিন সময় কাটিয়ে উঠতে আপনারা আমাকে বন্ধু ভাববেন।’

সে-সময় তিনি স্পষ্ট করেন, ‘এ-দেশের কোথাও ইসলামভীতির জায়গা নেই। এমন অপরাধ নিকৃষ্ট ও বিশ^াসঘাতকতার শামিল। এই কর্মকাণ্ড আমি শক্ত হাতে দমন করব।’ এ-ঘটনায় হামলাকারীর বিরুদ্ধে তার নেওয়া পদক্ষেপে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন মুসলিমরা।

মুসলিমদের কাছে উদার মানবতাবাদী নেতা হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে ট্রুডোর। পবিত্র রমজান মাসের শুরুতে তিনি সারা বিশে^র মুসলিমদের শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেন না। সিয়াম সাধনা শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপনের ঠিক আগমুহূর্তে কানাডা-সহ সারা বিশে^র মুসলিমদের শুভেচ্ছা জানান তিনি।

এবার মুসলিম সম্প্রদায়কে জানানো শুভেচ্ছার প্রথমেই সালাম দেন তিনি। এরপর বলেন, ‘ঈদ মোবারক! রমজান মাসের সমাপ্তি উপলক্ষে যারা ঈদুল ফিতর উদযাপন করছেন, তাদের সবাইকে আমি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এক মাস ধরে রোজা পালন এবং বিভিন্ন ইবাদাত করার পর আমি আশা করি, আপনারা এই সময়টাতে আনন্দ ভাগাভাগি করবেন।’

শুধু এই ঘটনাগুলোই নয়, মুসলিমদের প্রতি তার মমত্ববোধ সবসময়ই উল্লেখ করার মতো।

মিয়ানমারের রাখাইনে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন বন্ধে ট্রুডোর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। মিয়ানমারের সে-সময়কার রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি-কে ফোন করে মুসলিমদের ওপর নির্মম আচরণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এরপর সু চি-র সঙ্গে বৈঠক করে তাকে মুসলিম নির্যাতন বন্ধের জন্য চাপ দিয়েছিলেন।

কানাডার টরেন্টোর সাবেক এমপি বব রে-কে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন ট্রুডো। রোহিঙ্গাদের কানাডায় আশ্রয় দিতে সুপারিশ করেছিলেন এই বিশেষ দূত। পাশাপাশি, রোহিঙ্গা সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞারও সুপারিশ করেছিলেন তিনি।

টুইটারে ট্রুডোর একটি বক্তব্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘নির্যাতিত, সন্ত্রাস ও যুদ্ধপীড়িত অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের কানাডায় স্বাগতম।’

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে কয়েকটি মুসলিম দেশের শরণার্থী বা অভিবাসীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। এরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় শরণার্থীদের পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলেছিলেন ট্রুডো। শরণার্থীদের উদ্দেশে কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের জন্য কানাডার দরজা খোলা।’

অভিবাসন-নীতি নিয়ে ট্রাম্পের অব্যাহত সমালোচনার মধ্যেই একটি টুইট করেছিলেন ট্রুডো। সেখানে তিনি একটি ছবি পোস্ট করেন। ২০১৫ সালের এই ছবিতে তাকে কানাডার বিমানবন্দরে একজন সিরীয় শরণার্থীকে স্বাগত জানাতে দেখা গেছে।

ট্রুডো যেভাবে বিমানবন্দরে গিয়ে সিরীয় শরণার্থীদের তার দেশে বরণ করেছিলেন, তা ইতিহাসে বিরল। একটি সামরিক বিমান ১৬৩ জন সিরীয় শরাণার্থীকে নিয়ে কানাডায় অবতরণ করেছিল। মন্ট্রিয়াল নগরীর বিমানবন্দরে শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়ে ট্রুডো বলেছিলেন, ‘কীভাবে আমরা হৃদয় খুলে শরণার্থীদের গ্রহণ করছি, তা দেখুক বিশ^বাসী।’

এখন প্রায় ৪৫ হাজার সিরীয় মুসলিম শরণার্থী কানাডায় বাস করছেন। পূর্বসূরি রক্ষণশীল দলীয় স্টিফেন হারপারের শরণার্থী-নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাদের আশ্রয় দেন ট্রুডো। তার এই উদারতা দেখে দেশের ১০টি প্রদেশই শরণার্থী গ্রহণ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল।

জাস্টিন ট্রুডোর প্রতি সিরীয় মুসলিমদের ভালোবাসার একটি নজির এখানে তুলে ধরা যায়। সিরিয়ার শরণার্থী মোহাম্মদ ও আরফা বিলান কানাডায় আশ্রয় দেওয়ার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ট্রুডোর নামে সন্তানের নাম রেখেছিলেন। পুরো নাম জাস্টিন ট্রুডো আদম বিলান। ট্রুডো সেই শিশুকে কোলে তুলে আদর করেছিলেন; ছবিটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।

রাজনীতিতে ট্রুডোর জনপ্রিয়তা এক ঈর্ষণীয় বিষয়। টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় তিনি। জন্ম ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর কানাডার অটোয়ায়। পুরো নাম জাস্টিন পিয়ের জেমস ট্রুডো। বাবা কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আধুনিক কানাডার জনক পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডো। মা মার্গারেট ট্রুডো একজন অভিনেত্রী, লেখক এবং সমাজসেবক। তিন ছেলেসন্তানের মধ্যে বড় জাস্টিন ট্রুডো। ট্রুডোর বয়স যখন ৬, তখন তার বাবা-মার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বাবার আদরেই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে তিনি বেড়ে ওঠেন। রোজ সকালে স্কুলবাসে করে অটোয়ার পাবলিক এলিমেন্টারি স্কুলে পড়াশোনা করতে যেতেন। এভাবেই কেটেছে তার শৈশব।

কত কিছু করেছেন তিনি। শিক্ষকতা করেছেন, রেডিও স্টেশনে কাজও করেছেন। তারপর লিবারেল পার্টিতে রাজনীতিবিদ হিসেবে আগমন তার। রাজনীতিতে সরাসরি প্রবেশ ঘটে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই, পার্লামেন্টের সদস্য হন ২০০৮ সালে। প্রথমবার পার্লামেন্ট মেম্বার হয়েই মনোযোগ কাড়েন সবার। সেইসঙ্গে ভূমিকা পালন করেন নাগরিকত্ব, অভিবাসন, শিক্ষানীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর দক্ষ সমালোচক হিসেবে। পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য পান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ডায়মন্ড জুবিলি পদক। এরপর ট্রুডোর জনপ্রিয়তার ইতিহাস পুরো পৃথিবীই জানে।

ট্রুডো যুক্তিতে জয়ী হওয়ার চেয়ে পরামর্শ শুনতে পছন্দ করেন। তিনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, ‘আপনাকে প্রতিটি যুক্তিতে জয়ী হতে হবে না।’ তিনি প্রশ্ন ছুড়েছেন, ‘আপনি তর্ক জিততে চান, নাকি পৃথিবী পরিবর্তন করতে চান?’ তার মতে, অন্যদের কথা শোনা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যারা ভিন্ন পটভূমির এবং ভিন্ন অভিজ্ঞতার। তিনি এমন একটি নেতৃত্বে বিশ^াসী, যা মানুষকে একত্রিত করে। তার এই চিন্তাধারাই মানুষের কাছে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। কানাডার মুক্ত গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে তিনি শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু প্রতিশ্রুতি দেননি, প্রতিশ্রুতির ৯২ শতাংশই বাস্তবায়ন করেছেন।

আরও অনেক কারণে তিনি বিশ^ব্যাপী জনপ্রিয়। কারণ, ট্রুডোর নেতৃত্বে কানাডা সবসময়ই মানবাধিকার আর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ। তিনি ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির বিরোধিতা করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বিমান হামলারও বিরোধিতা করেছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে অস্ত্রচুক্তি বাতিল করেছেন। অবলীলায় আশ্রয় দিয়েছেন শরণার্থীদের। কানাডাকে তিনি তুলে ধরেছেন মুক্ত আর স্থিতিশীল দেশ হিসেবে, যেখানে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুস্থ পরিবেশ খুঁজে পান অভিবাসীরা। তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন দমন-পীড়নের মুখে বাস্তুচ্যুতদের পক্ষে, অংশ নিয়েছেন ত্রাণ কার্যক্রমেও। সরকার পরিচালনায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই ইতিবাচক অবস্থান তাকে এনে দিয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা।

তবুও, ট্রুডোর মতো নেতাদের সমালোচনায় মুখর হওয়ার মতো রাষ্ট্রনেতা কিংবা মিডিয়া থাকে। সমালোচনা এখনও হচ্ছে। কিন্তু, কোনো কিছুই কি ট্রুডোকে ছাপিয়ে বড় হতে পারছে। না, পারছে না। পারবেও না।