কেমন আছে উহান

ছবি - সংগৃহীত -

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ১৯ এপ্রিল ২০২০, ২৩:৫১

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ শহর। ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি এবং পর্যটনের জন্য পরিচিত। তবে এ বছর শহরটিকে নতুন করে পরিচিত করেছে প্রাণঘাতি ভাইরাস ‘করোনা’। ভাইরাসটি প্রলয় শুরু করেছে প্রাচীন শহর উহান থেকে। এখন কাঁপাচ্ছে বিশ্বকে। এই সময়ের মধ্যে প্রকোপ কমে এসেছে উহানে। শহর থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে লকডাউন। বাইরে বেরিয়ে এসেছে ঘরবন্দি মানুষ। হিড়িক লেগেছে বেড়ানোর।

মধ্য চীনের এই ঐতিহ্যবাহী শহর কেটে বয়ে গেছে ইয়াংৎজি নদী। একে ঘিরে সুশোভিত আধুনিক এই শহরের বড় সৌন্দর্য্য। ইয়াংৎজি পারাপারের জন্য রয়েছে বিশাল এক সেতু। প্রদেশটিতে এটিই প্রথম হাইওয়ে এবং রেলওয়ে সেতু। বানানো হয়েছিলো ১৯৫৫ সালে। দুই বছর পর এটি চালু করা হয়। এই সেতু থেকে উহান শহর আর শহরের নদী দেখার জন্য আছে দর্শনার্থী টাওয়ার। নিচ থেকে লিফট দিয়ে টাওয়ারে উঠা যায়।

গোটা উহানকে পাখির চোখে দেখতে হলে উঠতে হবে ‘ইয়েলো ক্রেন টাওয়ার’-এ। এটি শহরের ¯েœক হিলের চূড়ায়, ইয়াংৎজি নদীর দক্ষিণে। বানানো হয়েছিলো খৃস্টের জন্মের ২২৩ বছর পর। সেই তখন থেকেই টাওয়ারটিকে বিবেচনা করা হয় স্বর্গের অংশ হিসেবে। কারণ এর চ’ড়ায় উঠলে পাহাড়, নদী, হ্রদ, বন আর শহর মিলিয়ে যা দেখা যাবে, সেটা হবে স্বর্গে দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখার মতো।

তাং রাজবংশের বিখ্যাত কবি কুই হাও এই টাওয়ারটিকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। কবিতার শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘ইয়েলো ক্র্যান টাওয়ার’। পরে এই নামেই টাওয়ারটি পরিচিতি পেয়ে যায়। এই টাওয়ার থেকে পাওয়া যায় চীনের ইতিহাসের অনেক তথ্য।
উহানে যেমন আছে ইতিহাস, তেমন আধুনিকতা। আর তারচাইতেও বেশি আছে মনোরকম প্রকৃতি। ইয়াংৎজি নদীকে ঘিরেই প্রকৃতির বিশাল আয়োজন। নদীর দক্ষিণে আছে একটি হ্রদ। একে ডাকা হয় ‘পূবের হ্রদ’ নামে। হ্রদটি ৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এর ভেতর পানিই আছে ৩৩ বর্গকিলোমিটার। চীনের অন্য কোনো শহরে এতো বড় হ্রদ নেই। পূবের হৃদও বহু পুরনো। এখানে আছে প্রাচীন চু সংস্কৃতির নির্দশন। মনোরম বাগান। আর পাখিদের বিশাল আয়োজন। হ্রদটির কাঠামো যেমন বৈচিত্রে ভরপুর। নান্দনিকতা তেমন মন ঠেসে নেওয়ার মতো। পূবের হ্রদ ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে নানারকম রাইড।

করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব ঠেকাতে জানুারির শেষ দিকে চীনা কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে তারা অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। সেই অভূতপূর্ব পদক্ষেপ ছিলো শুধু উহান শহর নয় হুবেই প্রদেশটিকে লকডাউন করে দেয়া। তখন অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন যে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে একই ধরণের পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হবে। এক দলীয় শাসনের জন্য চীন যা পারছে বাকি বিশ্ব তা পারবে না। এখন প্রমান হচ্ছে চীনের সেই পদক্ষেপ ছিলো সঠিক।

যখন গোটা উহান পরিণত হয়েছিলো মৃত্যুপুরীতে। ভাইরাসের প্রকোপে মৃত্যু হচ্ছিলো একের পর এক মানুষের। একেবারে নতুন ধরনের এই ছোয়াছে রোগের গতিবিধি ছিলো ধারণার বাইরে। নিজেদের নিরাপদ রাখতে উহানবাসীকে সেঁধিয়ে যেতে হয়েছিলো ঘরে। বন্দিজীবন চলেছে দীর্ঘদিন।

গত বছরের ডিসেম্বর মাসে উহান শহরে বন্যপ্রানীর একটি বাজার থেকে আকস্মিকভাবেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। এর প্রকোপ ঠেকাতে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে শহরটিকে শুধু চীন থেকে নয়, সারা বিশ্ব থেকেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। হুবেই প্রদেশের রাজধানী এই উহান শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন এবং এই রোগে হুবেই প্রদেশে কমপক্ষে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
সেই শোক এখন কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছেন উহানের মানুষ। দীর্ঘ দুই মাসের সেই বন্দি জীবনের অবসান হয়েছে। চীনের মানুষ এখন উহানে যেমন যেতে পারছে, তেমনি উহানবাসিও বাইরে বের হতে পারছেন। চীনের সরকার চেষ্টা করছেন পরিস্থিতি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করতে। উহানকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে। উহান বাসীও যেনো বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেতে বাইরে চলে এসেছেন। পার্ক আর সুপারশপ গুলো আগের মতো জেগে উঠেছে। লেগে থাকছে ভীর। তবে সবাই সর্তক।

উহানকে ভাইরাসমুক্ত রাখতে চীনের নেয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল ৫ কোটি ৬০ লাখ নাগরিকসহ পুরো হুবেই প্রদেশকে কোয়ারেন্টিন করে ফেলা এবং সংক্রমিতদের চিকিৎসার জন্য ১০ দিনের মধ্যে হাসপাতাল তৈরি করা। প্রায় দুই মাসের কোয়ারেন্টিন ছিলো উহানবাসী। ১০ই মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং উহান সফর করে দুনিয়ার মানুষকে জানিয়ে দেন শহরটি এখন নিরাপদ।

যে রাতে লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছে, সেই রাতেই দলে দলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে মানুষ। মধ্যরাতে শহর থেকে ছেড়ে গেছে একটি ট্রেন।এরপর উহান জেগে উঠতে আর বেশি সময় লাগেনি। শহরের ১৭টি ট্রেন স্টেশন এবং পাতাল রেলসহ যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। লোকজনকে শহরে আসতে শুরু করেছে। প্রায় তিন মাস পর উহানে ফিরে এসেছেন ১৯ বছর বয়সী ছাত্র গু লিয়াংকাই।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, আমি খুব খুশি কারণ পরিবারের সবার সঙ্গে তার আবার দেখা হচ্ছে। সবাইকে আমি জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন যেহেতু খারাপ সময় যাচ্ছে - তাই আমরা এ থেকে বিরত থাকছি। অর্থাৎ উহান জেগে উঠছে বটে তবে সর্তকতার সাথে। এ কারনে রাস্তায় সবার মুখে এখনও মাস্ক। যে দু:সহ সময় এখানকার মানুষ কাটিয়েছেন তা এখনও তারা করে ফিরছে।

উহান সব সময় পর্যটকে ভরপুর থাকে। এখনও পর্যটকরা এই শহরে আসা শুরু করেনি। তবে বিমান বন্দর খুলে দেয়া হয়েছে। যদিও আগের মতো ভীর নেই। উহানের বাইরে যারা ছিলেন তারা ফিরে আসছেন নিজ শহরে। বিদেশি পর্যটকরা অবশ্য এখন উহানমুখি হয়নি। স্থানীয়রা বন্ধু স্বজনদের নিয়ে বের হচ্ছেন বাইরে। এভাবে ফিরে আসছে উহানে প্রানের স্পন্দন।  শুধু তাই নয়। ৭৬ দিনের লকডাউনে অনেকে তরুন বসতে পারেননি বিয়ের পিড়িতে। তারা দ্রুত সেরে নিচ্ছেন বিয়ের কাজটি। অনলাইনে পাত্রী খোজার সংখ্যাও বেড়ে গেছে। এ যেনো নতুন করে জেগে উঠার সময়। ঝলমলে আলোয় আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে রাতের উহান। বহু রংগের আলোকচ্ছটায় পুরো শহর যেনো আবার ডাকছে, ভয় নেই ফিরে এসো।

উহানকে বলা হয় চীনের শিকাগো। উহানে দেখার মতো যা আছে, এর সবগুলোতেই লেগে আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। চীনের সবচেয়ে পুরনো শহর এটি। দেশটির বহু বছরের ইতিহাস বয়ে চলেছে এই শহর।

উহান বিখ্যাত অনেক কিছুর জন্যই। জলপথ, সড়কপথ, রেলপথ সব দিক থেকেই উহানের সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ রয়েছে বিশ্বের। এ কারণেই চীনের পরিবহন এবং ব্যবসার বড় একটি কেন্দ্র এটি। কাঠ, চা, সিল্ক, তুলাসহ নানা পণ্যের পসরা এখানে। শুধুমাত্র উহানেই ১৬৫৬টি বড় কারখানা রয়েছে। এছাড়া আরো নানা ধরনের ছোট কারখানা তো রয়েছেই। এই উহানেই রয়েছে বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, ফার্মাকিউটিকলসের মতো উৎপাদন শিল্পও। এবং চীনের তৃতীয় বৃহৎ গাড়ি উৎপাদন কেন্দ্র।
এছাড়া নানারকম প্রাণীর কেনাবেচার জন্যও শহরটি কুখ্যাত। অভিযোগ রয়েছে অনেক বিরল প্রাণী কেনাবেচা হয় উহানের বাজারে। জীবন্ত পশুপাখির পাশাপাশি ওইসব হাটে এদের প্রক্রিয়াজাত মাংসও বিক্রি করা হয়। চীনে ওই ধরনের বাজারকে বলা হয় ‘ওয়েট মার্কেট’। ওইসব মার্কেট থেকে বার বার জন্ম নিচ্ছে একেকটি মহামারি।

বন্য প্রাণী কেনা-বেচার এই বাজারগুলোর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক ক্রেতার। কেবল খাওয়ার জন্য নয়, ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের জন্যও নানা দেশে ওইসব প্রাণীর বিপুল চাহিদা। চীন সরকার এখন আইন করে দিয়েছে কোন ধরনের প্রানী বিক্রি ও খাওয়া যাবে। কোন গুলো খাওয়া যাবে না।

চীন সরকারের লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট। এমন দু:সময় যেনো আর ফিরে না আসে। এজন্য নেয়া হচ্ছে কঠোর পদক্ষেপ। সাথে হুবেই প্রদেশকে যত দ্রুত সম্ভব সচল করা যায়। সারা দুনিয়া যখন অবরুদ্ধ তখন চীন হয়ে উঠছে স্বাভাবিক। উহান থেকে যেনো নুতন চীনের আরেক উন্থানের যাত্রা শুরু হলো।