জীবন্ত ইতিহাসের শহর কায়রো

কায়রো নগরী - সংগৃহীত

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ২১ নভেম্বর ২০১৯, ১০:১৫


নীল নদ আর পিরামিডের দেশ মিশর। প্রাচীন মিশরিয় সভ্যতা গড়ে উঠেছে নীল নদ ঘীরে। আর এই সভ্যতার ধারবাহিকতায় অবাক উদাহরণ পিরামিড। গিজা মালভ’মির ‘গ্রেট পিরামিড অব গিজা’ চুম্বকের মতো টানছে বিশ্ব পর্যটন। প্রতাপশালী ফেরাওন খুফু, খাফরে ও মেনকাওরের স্মৃতিকে পাহারা দিচ্ছে গ্রীক পুরানের সিংহমানবি স্ফিংস। এতোসব প্রাচীন নিদর্শন দেশটির রাজধানী কায়রোর উপকণ্ঠে।


বিডিভিউজের আজকের আয়োজন কায়রো নিয়ে, যার গলি-ঘুঁপচিতেও আছে জীবন্ত ইতিহাস। কায়রোর বর্তমানের ভেতর গড়াগড়ি খায় অতীত। সেই অতীতের এক বিজয়ের গল্প থেকেই রাখা হয়েছে শহরের নাম। ‘কায়রো’কে স্থানীয়রা ডাকে ‘ক্বাহিরাহ’। আরবি ভাষার এই শব্দের অর্থ ‘বিজয়ী’। ইংরেজরা ‘ক্বাহিরা’ উচ্চারণ করতে পারে না। তাই বাইরের দুনিয়ায় ‘ক্বাহিরাহ’কে এরা পরিচিত করিয়েছে ‘কায়রো’ নামে।


কায়রোর ‘বিজয়ে’র গল্প বয়ে এসেছে নীল নদের প্রবাহ ধরে। শুকনো মরুতে এই নদের প্রবাহ ঘীরেই ছিলো মানুষের বসতি। সেই প্রস্তর যুগ থেকে এলাকাটা ছিলো জলপথের ‘স্বর্গ’। মরু ও মালভ’মির লোকেরা এই স্বর্গ ঘিরে বসতি গড়ে। নীল নদের ভেজা তীরে শুরু হয় বসতির প্রতিযোগিতা। জমে উঠতে থাকে বাণিজ্য। প্রথম ফারাও মেনেসের সময় বাণিজ্যের কলেবর বাড়ে। তিনি নদের উজান এবং ভাটির বসতিতে সমন্বয় আনেন। আর উজান-ভাটির মাঝখানে তৈরি করেন নিজের রাজধানী ‘মেমফিস’। কায়রো থেকে এই শহরের দূরত্ব ১৫ মাইল।


নীল নদকে ঘিরে ‘স্বর্গবসতি’ বইরের লোকদেরকেও আকর্ষণ করে। খৃস্টের জন্মের ৫২৫ বছর আগে পারস্য থেকে আক্রমণ করা হয়। তারা মিশর দখলে নেয়। মেমফিসের উত্তরে ব্যাবিলন-অন-দ্যা-নীল দুর্গ স্থাপন করে। খৃস্টের জন্মের ৩৩২ বছর আগে পর্যন্ত এখান থেকেই মিশর শাসন করা হয়। এর পর মিশর যায় বীর আলেক্সান্ডারের দখলে। তার সাম্রাজ্যের রাজধানী হয় আলেক্সান্দ্রিয়া। কমতে থাকে ব্যাবিলনের গুরুত্ব। পরে মিশরের কপ্টিক গির্জা বাকি পৃথিবীর খৃস্টানদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই খুব সহজেই ব্যাবিলন চলে যায় আরবদের নিয়ন্ত্রণে।


দশম শতকে প্রতিষ্ঠা হয় কায়রো শহরের। খৃস্টের জন্মের ৯৬৯ বছর পর ফাতেমীয় সেনাপতি জওহর আল-সিকিলি এই শহর গড়ে তুলেন। তিনিই ওখানে বানিয়েছিলেন আল-আজহার মসজিদ। পরে এই মসজিদটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। জওহর আল সিকিলি উত্থান অনেকটা রোমাঞ্চকর। তিনি ছিলেন ফাতিমীয় খলিফা আল মনসুরের দাস। পরে হন খলিফার ব্যক্তিগত সহকারি। মনসুরের পর তার ছেলে আল মুইজ জওহরকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। পরে তিনি নিয়োগ পান খতিব হিসেবে। তারপর উজির এবং সবশেষে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পান। খলিফা মুইজ জওহরকে ‘আবুল হোসাইন’ নাম দেন। খলিফার নির্দেশে আবুল হোসাইন জওহর কায়রো শহরটি নির্মাণের কাজে হাত দেন। প্রায় চার বছর ধরে কাজ চলে। প্রথমে শহরের নাম দেওয়া হয়েছিলো আল মনসুরিয়া। ৯৭৩ সালে মুইজ আল মনসুরিয়াকে রাজধানী ঘোষণা করেন। তখন শহরের নাম বদলে রাখা হয় ‘ক্বাহিরাহ’। অর্থাৎ কায়রো।


সেই দিনের কায়রো এখনো ধারণ করছে নীল নদের ¯্রােত। ¯্রােতের তোড়ে পাল্টেছে শহর। তবে ইতিহাস পাল্টানো যায় না। জওহরের আল আজহার মসজিদটি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হলেও ইতিহাসের জৌলুশ ঢাকা পড়েনি। এই মসজিদের প্রথম জুমআর খুতবা দিয়েছিলেন খলিফা আল মুইজ। ৯৮৮ সালে খলিফা আজিজ এই মসজিদে ৩৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এটিকে মসজিদ থেকে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। ১২ শতকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির শাসনের পর পতন হয় ফাতেমীয় খেলাফতের। ১৩ থেকে ১৬ শতকের শুরুর সময় পর্যন্ত এখানে মামলুক এবং ১৫১৭-১৭৯৮ পর্যন্ত উসমানীয় সা¤্রাজ্যের শাসন কায়েম ছিল। ১৭৯৮-১৮০১ সাল ছিল নেপোলিয়নের অধিকারে। ১৮৮২ সালে কায়রো ব্রিটিশ অধিকারে। ১৯২২ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলেও ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সেখানে কার্যত বৃটিশ ওপনিবেশ টিকে ছিলো। মিশরীয় নেতা নাসেরের নেতৃত্বে বিপ্লবের পর কায়রো পেতে থাকে নতুন চেহারা। এর পর দীর্ঘ পথ।


কায়রোতে বসন্ত এসেছিলো ২০১১ সালে। আরব বসন্তের ফুল ফুটেছিলো তাহরির স্কোয়ারে। হাজার হাজার জনতার প্রতিবাদের মুখে একনায়ক হুসনি মুবারকের পতন হয়। শুরু হয় গণতন্ত্রের। কিন্তু গণতন্ত্রের পথ মসৃণ ছিলো না। ২০১৩ সালে মিশরের প্রথম এবং শেষ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হন সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। বন্দী হন কারাগারে। এ বছরের ১৭ জুন তার মৃত্যু হয়। অভিযোগ রয়েছে, মন্থর বিষ প্রয়োগ করে তাকে মেরে ফেলেছে স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি সরকার।
‘মুহাম্মদ মুরসি’ একটি নাম। ‘আরব বসন্ত’ পৃথিবীজাগানো এক বিপ্লব। এই নাম এবং বিপ্লব কায়রোকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। আরব বসন্তের কারণেই তাহরির স্কোয়ার পরিণত হয়েছে কায়রোর গুরুত্বপূর্ণ পর্যটক আকর্ষণে।


কায়রোতে পর্যটকদের দেখার মতো আকর্ষণের অভাব নেই। শহরজুড়ে আছে প্রাচীন স্থাপনা, সুউচ্চ মিনার। কায়রোর আরেক নাম ‘হাজার মিনারের শহর’। এসবের বেশিরভাগ বানানো হয়েছে সুলতানি এবং ওসমানীয় সময়ে। আছে রোমানদের বাড়ি। ব্যাবিলনের স্থাপনা। গ্রীক জৌলুশ। এবং ফেরাওনদের স্মৃতি।


একের ভেতর অনেক পেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে মিশরীয় জাদুঘরে। ওটা কায়রোর কেন্দ্র তাহরির স্কোয়ারের কাছেই। ওখানে পাওয়া যাবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শনও। ফেরাওনদের স্মৃতিতে ভরপর ওই জাদুঘর। রহস্যময়ী বালকরাজা তুতেনখামেনের মুখোশ তুলে রাখা হয়েছে। আছে তার কফিন ও সমাধি থেকে পাওয়া রতœভান্ডার। জাদুঘরে সাজানো আছে ফেরাওনদের সিংহাসন, পরনের কাপড়। পর্যটকদের আকর্ষণ করে জাদুঘরে রাখা রাজকীয় মমি।


কায়রোর আরেক জাদুঘর ‘মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট’। ওই জাদুঘরে বিশ্বের সেরা ইসলামি শিল্পের সংগ্রহ আছে। ওখানকর দেয়ালচিত্র, খোঁদাই করা প্লাস্টার, কাঠের সিলিং এবং সূক্ষ্ম কাজ নজরে পড়ার মতো।জাদুঘরের বাইরে বের হলে সবার আগে আপনার যাওয়া উচিৎ গেজিরা ও জামালেক। কায়রোর এই দুটো এলাকাই নীল নদের দ্বীপ। গেজিরার দক্ষিণে আছে কায়রো অপেরা হাউজ। এটি শহরের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ। আধুনিক মিশরের বেশিরভাগ সুরের দলের ঠিকানা এখানেই।


কায়রোতে বড় পর্যটক আকর্ষণ সালাহউদ্দিন আইয়ুবির দুর্গ। ক্রুসেডারদের থেকে সুরক্ষার জন্য তিনি এই দুর্গটি বানিয়েছিলেন ১১৭৬ সালে। পরে মূল কাঠামোর সাথে আরও কয়েকটি স্থাপনা তৈরি করা হয়। এই দুর্গে আছে মোহাম্মদ আলির মসজিদ। এর মিনার সাদা পাথরের তৈরি। ওখান থেকে গোটা কায়রোকে দেখা যায় পাখির চোখে। মসজিদের উত্তর-পূর্ব দিকে মামলুক সুলতান হাসান এল নাসিরের বানানো মসজিদও আছে। বর্তমানে ওখানকার কয়েকটি ভবনে পুলিশ জাদুঘর, ন্যাশনাল মিলিটারি জাদুঘর ও ক্যারিজ জাদুঘর বানানো হয়েছে। শহরের ডেল্টা অঞ্চলে আছে কপটিক দুর্গ। ওখানে মিশরের প্রাচীন কপটিক আর্টের সংগ্রহশালা। ওই এলাকার চার্চ অপ সেন্ট সেরজিয়াস পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় থাকে।


কপটিক কায়রোর কেন্দ্রে আছে দা হ্যাংগিং চার্চ। ওখানে যে ভবনটি দেখা যায়, সেটা সপ্তম শতাব্দীর সময়ের। রোমান ব্যাবিলিয়ন দুর্গের ফটকবাড়ির ওপর এই চার্চটি ঝুলন্ত। চার্চের ভেতরটা সুন্দর। কাঠের সিলিং-এ ঘেরা। আছে ধর্মীয় সংগ্রহ। জীবন্ত ইতিহাসের আরেক ঠিকানা সাক্কারা। ওটা মূলত ফিরাওনদের সমাধিক্ষেত্র। যেখানে মেমফিসসহ অনেক ফেরাওনদের পরিষদবর্গকে সমাহিত করা হয়েছিল। সাক্কারায় প্রচুর পিরামিড। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরটির নাম স্টেপ পিরামিড।


পিরামিডের শহরে বেড়াতে গেলে ঘুরে আসতে পারেন ‘খান ঈল-খালিলি’ থেকে। খোলা আকাশের নিচে এটি এক প্রাচীন বাজার। এই বাজারে সোনা, রুপাসহ ধাতুর তৈজস বিক্রি হয়। ইচ্ছে হলে অর্ডার করে বানাতেও পারেন। পাওয়া যায় স্থানীয়দের হাতে তৈরি তৈজস, বাহারি মসলা।


১৩৫৮ সালে আমির জারকাস ঈল-খালিলি এই বাজারটি জমিয়ে তুলেন। তিনি বড় একটি পান্থশালা বানিয়েছিলেন। পরে সুলতান আল-ঘুরি এই বিপণিসমাগম গুড়িয়ে দেন। ষোড়শ শতকে নতুন করে জমে উঠে বাজার। তারপর সুনাম ছড়ায় বিশ্বজুড়ে।খান ঈল খালিলি’র পসরা দেখে কেনার লোভ সামলানো কঠিন। তবে কিনতে গেলে কিছুটা বুদ্ধি খাটাতে হয়। বিক্রেতার সঙ্গে দরদাম না করলে ঠকে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায়।