সোভিয়েতের ‘সন্ত্রাস দুর্ভিক্ষ’ ও অতুলনীয় কাজান

কাজান শহর - সংগৃহীত

  • শাহ মোহাম্মদ মোশাহিদ
  • ০১ নভেম্বর ২০১৯, ২২:৫৮


কাজান, রাশিয়ার শহর। তবে রাশিয়ার মতো নয়। অন্য এলাকা থেকে এর স্বাদ ভিন্ন। হাজার বছরের পুরনো এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভোলগা নদী। নদীর স্রোতে ভেসেছে ইতিহাস। ওইসব ইতিহাস তাতারদের।
তাতার ওই এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠির নাম। তাদের নামেই অঞ্চলের নাম ‘তাতারস্তান’। কাজান ওই অঞ্চলের রাজধানী।


তাতাররা ছিলো হিংস্র, বেপরোয়া। এদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো এশিয়ার মধ্যাঞ্চল। একটা সময় এদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে। দাওয়াতে সাড়া দিয়ে শান্তির ছায়ায় আশ্রয় নিতে থাকে। তারপর থেকেই অঞ্চলটি গড়ে উঠতে থাকে মুসলিম সংস্কৃতির ওপর ভর করে।


সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় এসব সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন গুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপরও টিকে আছে কিছু। নতুন করে নির্মাণ হয়েছে অনেক। কাজানের এইসব নির্মাণগুলো সারা পৃথিবী থেকে পর্যটক টানছে। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক ‘কাজান’ যান। শহরটিকে ডাকা হয় রাশিয়ার ‘ক্রীড়া রাজধানী’। ‘এফসি কাজান’ নামের একটি ক্লাবকে কেন্দ্র করে ওখানে জেঁকে বসেছে খেলাধুলার মহা আয়োজন।


কাজানকে ডাকা হয় আধুনিক রাশিয়ার ইসলামের রাজধানী। এই শহরেই আছে বিখ্যাত কুলশরিফ মসজিদ এবং রাশিয়ান ইসলামিক ইউনিভার্সিটি।


রাশিয়ার ৬ষ্ঠ জনবহুল এই শহরে লোকের সংখ্যা ১১ লাখ ৪৩ হাজার। ভোলগা এবং কাজানখা নদী যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানেই গড়ে উঠেছে কাজান। শহরটি রাশিয়ার ইউরোপিয় অঞ্চলের অংশ।


সমৃদ্ধ এই শহরে বছরের সবটা সময় পর্যটকের আনাগোনা থাকে। শহরের বড় আকর্ষণ সবুজ। আর সবুজের সমারোহ থাকে মিলেনিয়াম পার্কে। ২০০৫ সালে শহরের হাজারতম জন্মদিনের স্মারক হিসেবে এই পার্ক বানানো হয়। আরো এক সবুজ পার্ক আছে ওখানে। নাম ‘রিভেইরা অ্যাকোয়া পার্ক’। ঘুরে বেড়াতে চাইলে তুলনা হয় না।


গোটা কাজান শহরটিই অতুলনীয়। যেমন আবহাওয়া, তেমন মোহনীয় এর রূপ। প্রাচীন কাজানের পুরনো স্থাপত্যও মুগ্ধ করে রাখার মতো। কাজানের বড় স্থাপত্য ‘ক্রেমলিন’। না, মস্কোর সেই ক্রেমলিন নয় এটি। যারা নিয়মিত রাশিয়ায় যান, তারা ‘ক্রেমলিন’ শব্দটি শুনে বিভ্রান্ত হন না। তারা জানেন, এই শব্দের অর্থ ‘দুর্গ’। রাশিয়ার প্রায় প্রতিটি পুরনো শহরেই একটা করে এমন দুর্গ বা ক্রেমলিন আছে। গোটা ফেডারেশনের রাজধানী মস্কোতেও আছে একটা। বাইরের বিশ্ব ওটাকেই ক্রেমলিন বলে জানে। ওটা রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের আনুষ্ঠানিক বাসভবন।


আর অন্য শহরের ক্রেমলিনগুলো সাধারণত সরকারি, সামরিক এবং ধর্মীয় বিষয়াদীর কেন্দ্র। কাজান ক্রেমলিনের ভেতর আছে নীল গম্বুজের কুল শরিফ মসজিদ। কাজান খানেটের ইমাম কুল শরিফের নামে এই মসজিদের নাম রাখা হয়। খৃস্টান আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। মসজিদটি ইসলামি পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত।
এটি ষোড়শ শতাব্দীতে প্রথমে বানানো হলেও বর্তমান কাঠামো ২০০৫ সালে তৈরি করা হয়। মসজিদের উপরের অংশ নামাজ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করা হয় এবং নিচের অংশ ব্যবহার হয় জাদুঘর হিসেবে।


শুধু মুসলিমদের নয়, কাজানে আছে অর্থোডক্স খৃস্টানদের আনানেশন ক্যাথেড্রাল। আর আছে সকল ধর্মের প্রার্থনালয় ‘দ্যা টেম্পল অব অল রিলিজিয়ন’। একাধিক স্থাপত্যশৈলীর এই পবিত্র মন্দিরটি কাজানের সিটি সেন্টারের ঠিক বাইরে।
শহরের এক মাথা থেকে অন্যমাথায় হেঁটে যেতে খুব সময় দরকার হয় না। এই কম সময়ের মধ্যেই দেখে নেওয়া যায় অনেক কিছু। আর যারা একটু বাইরে যেতে চান, তারা যেতে পারেন তাতারস্তানের হৃদহুলি। হাতে সময় না থাকলে অ্যাকোয়া পার্ক।


মস্কোর মতো কাজানেরও কেনাকাটায় সুনাম আছে। সড়ক ধরে হাঁটলে দুই পাশে গড়াগড়ি খাবে হাজার রকমের পসরা। আবেদন নিয়ে ডাকবে বাউমান স্ট্রিট। ওই এলাকাটাকে ডাকা হয় কাজানের হৃদয়। রুশ বিপ্লবী নিকুলায় বাউমানের নামে এর নাম রাখা হয়েছে। তবে ১৬০০ শতকের শুরুর দিকে নাম ছিল বৃটিশ ট্রেট।


এই সড়ক মানেই উচ্ছ্বল পসরা। ওইসব পসরা আর উৎসবের মধ্য দিয়েই কাজানের চঞ্চলতা। ধর্মীয় ও স্থানীয় উৎসবের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উৎসবও হয় ওখানে। ফেব্রুয়ারি এবং আগস্টে শহরজুড়ে জমে গানের মজমা। আর সেপ্টেম্বরের অপেরা আয়োজনে তুলে ধরা হয় মুসলিম সংস্কৃতি।


কাজানের সংস্কৃতির আরেক অধ্যায় রান্না। কিছু খাবার শীতে খেতে হয়, কিছু গরমে। কনকনে শীতে পছন্দের তলিকায় থাকে উখা ফিশ স্যুপ। আর গরমে পরিবেশন করা হয় মিষ্টিজাতীয় খাবার চক চক ডোনাট। নদীর চোখে কাজানকে দেখতে ভাসতে হবে ভোলগায়। তীরে পর্যটকদের জন্য মুখিয়ে থাকে কিছু পর্যটন সেবাসংস্থা। তাদের আছে ওয়াটার বাস।


জলে ওয়াটার বাস। আর স্থলে দু’টো পা-ই যথেষ্ট। পায়ে হাঁটলে ডাঙার কাজান মোহনীয় হয়ে ধরা দেয়। স্থাপনাগুলো হাজির হয় হাজার বছরের গল্প নিয়ে। গল্পে থাকে তাতারিস্তানের আদি তাতারদের জীবন। তাতার নামের এই জনগোষ্ঠি তুর্কি যাযাবরদের উত্তরসূরি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া থেকে ভোলগার তীরে যায় এরা। তখন ভোলগা বুলগেরিয়া এবং দ্যা ম্যারি এবং উদমার্ট নামের দুটো ফিনিশ উপজাতির সীমান্তে ছিলো কাজান।


কাজান ছিলো তাতারদের কেন্দ্র, রাজধানী। তখনকার তাতাররা ছিলো বেপরোয়া, বিশৃঙ্খল। তবে যুদ্ধের মাঠে ছিলো দাপট।  তাতারস্তানের পাশের রাষ্ট্র ছিলো ভোলগা বুলগেরিয়া। এছাড়া ইউরেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং বাল্টিক রাজ্যজুড়ে বাণিজ্য যোগাযোগ ছিলো কাজানের। এরা ছিলো স্বাধীন।


৯২২ সালে ইবনে-ফাদলান এর সময় বাগদাদ থেকে মুসলমান ধর্ম প্রচারকরা ওই এলাকায় যান। তাদের মাধ্যমে ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয় তাতারদের। ১২৩০ সালের শেষের দিকে মঙ্গল যুবরাজ বাতু খানের হাতে ভোলগা বুলগেরিয়ার পতন হয়। আক্রমণের মুখেও বেঁচে থাকা ভোলগারস এবং কিছুসংখ্যক কিপচাকসকে এক করা হয়েছিল। ভোলগারসদেরকে ডাকা হতো গোল্ডেন হোর্ডস। রণাঙ্গনে এদের তাঁবুর রঙ ছিলো সোনালি। ওই ভোলগারসদের সঙ্গে কিপচাকসের মিশেলেই তৈরি হয় আধুনিক তাতার জনগোষ্ঠী।


ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে কাজান হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র। ১৪৩৮ সালে খান উলুঘ মুহাম্মদ এলাকাটি দখল করেন। তিনি স্থানীয় যুবরাজ সোয়ানকে হত্যা করেন। ভোলগাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজধানী ভোলগা থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরে কাজানকে রাজধানী করেন। তখন স্বাধীন ওই মুসলিম এলাকাটির নাম ছিলো ‘কাজান খানাত’। আর এর রাজধানী ছিলো কাজান। তখন থেকে এই শহরের বাজারের বিকাশ হতে থাকে। প্রসার হতে থাকে হাতের তৈরি শিল্পের।


১৫৫০ এর দশকে কুখ্যাত রুশ শাসক ইভান দ্যা টেরিবল কাজান খানাত আক্রমণ করেন। রাজধানী কাজানের পতন হয় ১৫৫২ সালে। বিপুল তাতারদের হত্যা করা হয়। জোর করে খৃস্টান বানানো হয় অনেককে।


ইভান দ্যা টেরিবল ওই এলাকাটিকে সাংস্কৃতিকভাবে রাশিয়ার অধীনে নিয়ে নেন। এরপর শুরু হয় ধ্বংশযজ্ঞ। ১৫৯৩ সাল নাগাদ সবগুলো মসজিদ ধ্বংশ করা হয়। কাজানে তৈরি করা হয় বড় গির্জা। নতুন করে মসজিদ নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়। অষ্টাদশ শতকের ক্যাথেরিন দা গ্রেট এর আগ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবত ছিলো। ক্যাথেরিনের অনুমতিক্রমে প্রথম মসজিদ বানানো হয় ১৭৬৬ থেকে ১৭৭০ সালের মধ্যে।


উনবিংশ শতকের মধ্যে তাতারস্থান একটি ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠে। নেতাদের প্রভাবে তারা রাশিয়ন সাম্রাজ্যের অন্য জাতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের পর সব ধর্ম বেআইনি ঘোষণা করা হয়। এবং ধর্মীয় নেতারা নির্বাসিত হন।


বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ১৯১৮ থেকে ১৯২০ এর গৃহযুদ্ধের সময় তাতার জাতীয়তাবাদীরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেতে চায়। কিন্তু বলশেভিকরা প্রতিহত করে। ১৯২০ সালের ২৭ মে তাতার স্বায়ত্বশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯২১ থেকে ১৯২২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির যুদ্ধনীতির ফলে তাতারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এতে ২০ লাখ তাতারের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুকে বলা হয় ‘সন্ত্রাস দুর্ভিক্ষ’। কেউ কেউ একে ডাকেন ‘দুর্ভিক্ষ গণহত্যা’ নামেও।


দুর্ভিক্ষে তাতারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ওই এলাকায় বসবাস করার জন্য রুশদের পাঠাতে থাকে। এতে রুশরাও সংখ্যায় বেড়ে যায়। তাতার ও রুশদের হার হয় সমানে সমান। সোভিয়েত ইউনিয়ন যতদিন টিকে ছিলো, তাতাররা ততদিন কোণঠাসা ছিলো।


১৯৯০ সালের ৩০ আগস্ট, তাতার সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তার সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে। এবং ১৯৯২ সালে তাতারস্তানের নতুন সংবিধানের ওপর গণভোট হয়। এতে ৬২ শতাংশ সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন। ১৯৯২ সালের সংবিধানে তাতারস্তানকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। তবে গণভোট এবং সংবিধান রাশিয়ান সাংবিধানিক আদালত দ্বারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়।


২০০২ সালে তাতারস্তানকে রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ২০০৮ সালের ২০ ডিসেম্বর রাশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার স্বীকৃতি পায় আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়া। তখন ‘মিল্লি মিজলিস অফ তাতার পিপল’ তাতারস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতিসংঘের স্বীকৃতি চায়। কিন্তু জাতিসংঘ ও রাশিয়া সেই স্বীকৃতি দেয়নি।