ইমরান কী এরদোয়ানের ভুমিকায় আসতে যাচ্ছেন?

- সংগৃহীত

  • অনলাইন ডেস্ক
  • ১৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫৯

ভূরাজনীতির খেলায় ইমরান খান হেরে গেলেও তিনিই এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে জননন্দিত নেতা। দেশ পরিচালনায় ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও সততা, গণমানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসা, মুসলিম বিশে^র জন্য তার অনুপম অঙ্গীকার তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। ইমরান খানের বিদায়ের পর তাই এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন : তিনি কী আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন ইলিয়াস হোসেন।


পাকিস্তানের চলমান ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে দেড় দশক আগের তুরস্কের ঘটনার দারুণ মিল রয়েছে। ২০০৭ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী রিজেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের দলের নেতা আবদুল্লাহ গুলকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দিলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেনাবাহিনী। প্রকাশ্যেই তারা সেক্যুলারিজম রক্ষার নামে তার নির্বাচনের ঘোরতর বিরোধিতা শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এরদোয়ান আগাম নির্বাচন দেন।

এরপরের ইতিহাস শুধুই এরদোয়ানের। তার দল একেপির নেতা সেই আবদুল্লাহ গুলই প্রেসিডেন্ট হন। এরপর থেকে এরদোয়ান সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উদ্যেগী হন। অবিশ^াস্যভাবে তিনি তাতে সফল হন। ফলে তুরস্কে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে। এখন দেশটির সেনাবাহিনীর আর কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। অথচ এই সেনারা দেশটিতে তিনবার ক্ষমতা দখল করেছে। সর্বশেষ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের আগে ইসলামপন্থী নেকমদ্দিন এরবাকান সরকারকে উৎখাত করে সেনবাহিনী।

তুরস্ক আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চরিত্র প্রায় একই রকম। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের আখের গোছানো তাদের মূল লক্ষ্য। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের ফল মেনে না নেয়ার কারনে ভেঙ্গে গিয়েছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্র। যেখানে সেনাবাহিনীর দায় কোনো অংশে কম ছিলো না।

তুরস্ক প্রতিষ্ঠার বহু যুগ পর এরদোয়ান সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের মধ্যে আটকে রাখতে সক্ষম হলেও পাকিস্তান তা পারেনি। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে আনা যে খুব জরুরি, তা নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করে না। সর্বশেষ ইমরান খান সরকারকে উৎখাতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এই প্রয়োজনকে আরও তীব্র করেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার হিম্মত কার আছে? মনে রাখতে হবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশটির সেনাবাহিনীই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে। অর্ধেকের বেশি সময় তো তারা সরাসরিই ক্ষমতায় ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই রাজনৈতিক অভিলাষ একজন মাত্র রাজনীতিকই নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্য। তিনি আর কেউ নন, দেশটির ক্যারিশম্যাটিক নেতা ইমরান খান।

ব্যক্তিগত জীবনে ইমরান যেমন জেনারেলদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মত রাখেন। তেমনি তার রয়েছে অত্যন্ত মজবুত জনভিত্তি। তার অতুলনীয় জনপ্রিয়তার প্রমাণ সর্বশেষ পাওয়া গেছে সংসদে আনাস্থা প্রস্তাবে। মাত্র তিন ভোটে তার পরাজয়ের পর পাকিস্তানজুড়ে তার সমর্থনে নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছে। তার সমাবেশে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি প্রমান করে তিনি কতটা জনপ্রিয়। সম্প্রতি পেশোয়ারের এক জনসভায় তিনি নিজেই বলেছেন যখনই পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা হারিয়েছেন। তখন জনতা মিস্টি বিতরণ করেছে। কিন্তু আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে আমি সরে যাওয়ার পর আপনারা রাস্তায় নেমে এসেছেন এবং আমাকে সম্মান দিয়েছেন।

কোনো একটি ক্ষমতাসীন দল বা সরকার বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার পক্ষে এতোবড় জনসমর্থন সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে তো দূরের কথা, দক্ষিন এশিয়ার আর কোনো দেশে দেখা যায়নি।

ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরদিনই তার সমর্থকরা ‘আমদানি সরকার অগ্রহণযোগ্য’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। করাচি থেকে পেশোয়ার, ইসলামাবাদ থেকে মুলতান পর্যন্ত ইমরান খানের সমর্থনে পরিবারসহ মানুষ রাস্তায় নেমেছিল।

শুধু পাকিস্তানে নয়, সারা বিশ্বে ইমরান খানের সমর্থনে বিক্ষোভ চলছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা এমনকি সৌদি আরবে বসবাসরত পাকিস্তানি প্রবাসীরাও তাকে পুনবর্হালের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। এ দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাবিত হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বিশ্বাস করে যে বিদেশী ষড়যন্ত্রে ইমরান গদি হারিয়েছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোনো সরকারের পতন হলে এন্টি ইনকামবেন্সির কারণে জনগণ উল্লাস করে। পাকিস্তানে ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটা।

পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও নওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ ইমরান ক্ষমতায় আসার আগের ১০টি বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে পাকিস্তানকে তলাবিহীন ঝুড়িতে রূপান্তর করেছিল। দল দুটি জনদুর্ভোগ ও গরিব সৃষ্টির জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। ইমরান খানের সততা, তার দলের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ না থাকার বিপরীতে প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদ, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর জোটকে ইমরানবিরোধী দুর্নীতিবান্ধব জোট বলে মনে হয়।
ইমরানের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ নেই, যা নওয়াজ শরিফ ও আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কাজেই ট্র্যাজেডির নায়ক হিসেবেই ইমরান খান এখন সবার সহানুভূতি পাচ্ছেন।


পাকিস্তানের চলমান ঘটনাপ্রবাহে একটি বিষয় প্রমান হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে জনগনের চিন্তা ও বিশ্বাসের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। যদিও পাকিস্তানের বিশাল সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারন মানুষের সব সময় সমর্থন দেখা গেছে। দ্বিদলীয় পরিবারতন্ত্রের দুর্নীতির কৃষ্ণগহ্বর থেকে ইমরান খান পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন। তার নেতৃত্বে পিটিআই নামে তৃতীয় শক্তির উত্থান ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটির শেষ ভরসার জায়গা।

পাকিস্তানের তরুণরা এখন জনসংখ্যার বড় অংশ। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ইমরানের পক্ষে কথা বলছেন। অনেক তরুন মনে করেন, নতুন নির্বাচন হলে জীবনের প্রথম ভোটটি তারা ইমরান খানকেই দেবেন।

পাকিস্তানের বিদেশ নীতি নিয়েও এই তরুনদের ভাবনাও ভিন্নরকম। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের যৌথ সামরিক অভিযানের ফল খুব খারাপ হয়েছে। যেভাবে দেশের মানুষ শুধু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হয়েছে। ফলে কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব পাকিস্তানে বেড়েছে।

এমন সময় ইমরান খানকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় থাকার বিষয়টি পিপিপি ও নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগকে বিদেশি প্রভুর অনুগত দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর সাথে যোগ দিয়েছে কট্রর সেক্যুলার মিডিয়া। যা সাধারন মানুষকে আরো ক্ষুদ্ধ করে তুলেছে। বশ্যতা স্বীকার না করায় যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়েছেন ইমরান খান। আর এতে ইমরানের প্রতি সহানুভুতি বেড়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক এবং পাকিস্তান বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বিবিসিকে বলেছেন, পাকিস্তানের সমাজে, এমনকি সামরিক বাহিনীতেও ইমরান খানের অনেক সমর্থক রয়েছে। তিনি বলেন, পুরো সেনাবাহিনী কিন্তু ইমরান খানের বিরুদ্ধে নয়। শুধু সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ইমরান খান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মার্কিন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন। ষড়যন্ত্রের এই গল্প পাকিস্তানে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পাকিস্তানের সাধারন মানুষ বিশ্বাস করে সবকিছুর পেছনেই আমেরিকার হাত আছে। তারা মনে করে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়া পাকিস্তানে কিছুই হয় না। ফলে ইমরান খানের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। পাকিস্তানে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগে দু'জন প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয়বার এমনকি তৃতীয়বারের মতোও ক্ষমতায় ফিরে আসার উদাহরণ রয়েছে। বেনজির ভুট্টো ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর একবার এবং নওয়াজ শরীফ দুবার প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে আসেন।

ইমরান খানের দল পিটিআই ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল হয়ে ওঠে। সরাসরি ভোটের ২৭২টি আসনে ইমরানের পিটিআই ১১৬টিতে জিতেছিল। প্রাদেশিক স্তরে পিটিআই খাইবার পাখতুনখোয়ায় বৃহত্তম দল ছিল। পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ ৬৪টি আসনে এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৪৩টি আসন জিতেছে। অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রধান দুটো দলের চেয়েও বেশি আসন পায় ইমরানের দল।

ইমরান খান বিদায় নিলেও প্রশ্ন হলো- বিরোধীরা কতটা এক হয়ে থাকতে পারবে। সেখানে দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে। তা ছাড়া ওই জোটের বড় দুটি দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে নীতিগত প্রশ্ন ও ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়েও বিভেদ দেখা দিতে পারে। ফলে বিরোধী জোট ঐক্য কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

মুসলিম বিশে^র একমাত্র পরমাণু বোমার অধিকারী এবং ভারতের মত বৃহৎ শক্তির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলা দেশ হিসেবে ইসলামী দুনিয়ায় পাকিস্তানের উজ্জল ভাবমূর্তি রয়েছে। ইমরান খান তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

২০১৯ সালে জাতিসংঘে ঐতিহাসিক প্রথম ভাষণে কাশ্মীরের ভারতের নিমর্মতা ও নরেন্দ্র মোদি সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। তার ক্ষুরধার যুক্তিপূূর্ণ ভাষণ বিশ^ব্যাপী প্রশংসিত হয়। এরপর থেকে তুরস্কের এরদোয়ানের পরই তিনি মুসলিম বিশে^র জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার সেই ভাষণ শুরু করেছিলেন বিসমিল্লিাহির রহমানির রাহিম এবং ‘ইয়াক্যানাবুদু ওই ইয়াকানাসতাইয়ন’ বলে।

ইমরান খান বিদায় নিলেও তিনি এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে আলোচিত নেতা। গুগল ট্রেন্ডস এবং নেট সেন্টিমেন্টের উপর ভিত্তি করে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, এই মুহূর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ইমরান খান এবং তার দল পিটিআই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।

ইমরান খান স্পষ্টই দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান আন্দোলনের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা একজন জনপ্রিয় আইকন। তার কারণেই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তকমা পাওয়া পাকিস্তান বিশ্বপরিম-লে নতুন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছে। ভবিষ্যতেও তিনি হতে পারেন পাকিস্তানের কা-ারি, সফল রাষ্ট্রনায়ক।