ইসলামপন্থী দল এবার ইসরাইলের কিংমেকার

ইউনাইটেড আরব লিস্ট নেতা মানসুর আব্বাস - সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৫ এপ্রিল ২০২১, ০৪:৫২

এটা যেন কল্পনাকেও হার মানায়। ইহুদিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রে একটি ইসলামপন্থী দলই এখন সত্যিকারের কিংমেকার। যেনতেন কোনো ইসলামী দল নয়, সেটি আবার হামাসের আদলে গড়া। তারা চাইলে এখন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে ক্ষমতায় বসাতে পারেন আবার ইচ্ছে করলে ক্ষমতার বাইরেও ছুড়ে ফেলতে পারেন।

গত দু’বছরে ইসরাইলে চারবার জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। প্রতিবারই একই সমস্যা- নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আসনের জন্য হাহাকার করতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে।

প্রতিটি নির্বাচনেই কট্টরপন্থী নেতানিয়াহু বা তার প্রতিপক্ষ কেউই আসলে ক্ষমতায় যাবার মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। এর মধ্যে এবারের নির্বাচনেই ঘটেছে সবচেয়ে বড় চমকপ্রদ ঘটনা। এবার কিংমেকার হয়ে গেছে ইউনাইটেড আরব লিস্ট নামের একটি ইসলামপন্থী আরব দল। হিব্রু ভাষায় দলটি রাম নামেও পরিচিত।

চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায়, এবারের নির্বাচনে চারটি আসনে জয় পেয়েছে এ দলটি। তারা এখন নেতানিয়াহুকে ক্ষমতায় রাখা বা বিদায় করে দিতে পারে। তাদের চার আসন ছাড়া ইসরাইলে কোনো জোটই ক্ষমতা গঠন করতে পারবে না।

রক্ষণশীল মুসলিম মানসুর আব্বাসের নেতৃত্বে দলটি মূলত ফিলিস্তিনের গাজা শাসন করা হামাসের ধর্মীয় ভাবধারায় গড়ে ওঠা একটি ইসলামপন্থী দল। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি শুরু থেকে ইসরাইলের পার্লামেন্টে আসন পেয়ে আসছে। তবে কখনো সরকারের অংশীদার ছিল না। দেশটির বেশিরভাগই রাজনৈতিক দলই তাদেরকে সুনজরে দেখে না। ২০০৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো দেশটির নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ। পরে সুপ্রিম কোর্ট ওই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেয়।

২০২০ সালের নির্বাচনে ইসরাইলের আরব রাজনৈতিক দলগুলোর জোট- জয়েন্ট আরব লিস্টের অংশ ছিলো তারা। এ জোট নজিরবিহীনভাবে তখন পনেরটি আসন পেয়ে সংসদেও তৃতীয় বৃহত্তম জোটের পরিণত হয়।

তবে এবার একাই নির্বাচনে লড়ার জন্য গত জানুয়ারিতে ওই জোট ছেড়ে আসেন মনসুর আব্বাস। এ সিদ্ধান্ত দলটির 'কিংমেকার' হয়ে ওঠার পথ তৈরি করে দিয়েছে।

৪৬ বছর বয়সী মানসুর আব্বাস হলেন দলটির মূল ব্যক্তি। ইসরাইলের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে তিনি এখন রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছেন। জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা দন্ত চিকিৎসক তিনি। পরে হাইফা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

২০১৯ সালে তিনি ইউনাইটেড আরব লিস্টের নেতা মনোনীত হন এবং ওই জোটের অংশ হিসেবে পার্লামেন্ট সদস্যও নির্বাচিত হন।

ইসরাইলের প্রায় নব্বই লাখ মানুষের মধ্যে উনিশ লাখ বা মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগা আরব জনগোষ্ঠী। তারা ১৯৪৮ সালে ইসরাই়ল প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সেখানে থেকে গিয়েছিলেন।

ওই সময় প্রায় সাড়ে় সাত লাখ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন অথবা তাদেরকে বিতাড়ন করা হয়েছিল। তবে ইসরাইলের নাগরিক অনেক আরব নিজেদের ফিলিস্তিনি বা ইসরাইলি ফিলিস্তিনি হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। আর অন্যরা নিজেদের ইসরায়েলি আরব হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। মূলত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল কওে প্রতিষ্ঠিত হয় ইহুদিবাদী ইসরাইল।

ইসরাইলি আরবদের বেশিরভাগই সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী আর দ্বিতীয় বড় অংশটি খ্রিস্টান। ইসরাইলের দশ শতাংশ মুসলিম আরব বেদুইন গোত্র থেকে আসা। ১৯৪৯ সালের দেশটির প্রথম নির্বাচনেও তারা অংশ নিয়েছিলো।

আরব রাজনৈতিক দলগুলো দেশটিতে আরবদের সমান অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে এবং একই সাথে ফিলিস্তিনের প্রতিও তাদেও দৃঢ় সমর্থন আছে।

গত বছর নেতানিয়াহুর প্রতিপক্ষ বেনি গান্টজ আরব দলগুলোর সাথে জোট করে সরকার গঠনের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর আগে নেতানিয়াহু নিজেও মনসুর আব্বাসের সাথে জোটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে এবার ভোটের প্রচারণায় এ দলের বিরুদ্ধে তার সুর ছিলো নরম।

এখন যদি তারা একটি জোট করতে পারেন তাহলে নেতানিয়াহু ও আব্বাস- দুজনেই লাভবান হবেন। তবে নেতানিয়াহুর অন্য শরীকদের সাথে তারা কিভাবে একযোগে কাজ করবেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। শেষ পর্যন্ত কোয়ালিশনে না থেকেও নেতানিয়াহুকে সমর্থন দেয়ার চুক্তি করতে পারেন আব্বাস।

কিন্তু চুক্তি বা সমঝোতা যাই হোক এখন নিশ্চিত যে দরকষাকষির দুর্দান্ত সুযোগ আব্বাসের হাতে। তিনি বলেছেন ইসরাইলের আরব জনগোষ্ঠীর জন্য সেরা সিদ্ধান্তটিই তিনি নেবেন।

নেতানিয়াহুর বিরোধী জোটে আছে বামপন্থী, ডানপন্থী ও মধ্যপন্থীরা। নেতানিয়াহুর দল এবারও সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন পায়নি। ১২০ আসনের নেসেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ৬১ আসন।

১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মনসুর আব্বাস বলেছেন, তিনি ইসরাইলে ভিন্নতর বাস্তবতা তৈরি করতে চান। অন্যান্য রাজনীতিকের মতই তিনি কোনো সম্ভাবনাই বাতিল করে দিচ্ছেন না। এর অর্থ হচ্ছে যে জোটের সঙ্গে তিনি দরকষাকষিতে সুবিধা পাবেন সেই দিকেই ঝুঁকবেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা যে ইসরাইল রাষ্ট্রে একটি ইসলামপন্থী দল নির্ধারণ করবে কে হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। আরব দলগুলোকে সংসদে এবং রাজনীতিতে এতোদিন কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।

মনসুর আব্বাস ভোটের আগে বলেছিলেন তিনি নেতানিয়াহু কিংবা তার প্রতিপক্ষের জোটের সরকারের অংশ নেবেন না। এখনই উভয় জোটের সঙ্গেই তাদের আলোচনা চলছে।

আনাদলু বার্তা সংস্থাকে একান্ত সাক্ষাৎকারে মনসুর আব্বাস বলেছেন, ইসরাইলে নতুন সরকার গঠন নিয়ে তিনি বামপন্থী ও ডানপন্থী উভয় জোটের সঙ্গেই আলোচনা চালিয় যেতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ইসরাইলে আরব জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন এবং তাদের বিরুদ্ধে অবিচার, বৈষম্য, তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখার বিরুদ্ধে যে নেতা অবস্থান নেবেন তাকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থন দেবেন।

সম্প্রদায়ের সমস্যা নিরসনে তিনি দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, আমাদের চূড়ান্ত সীমা হলো আমাদের জাতীয় ও নাগরিক অধিকার। এ নিয়ে আমরা আপোস করব না। আমরা হয়তো সব দাবি আদায় করতে পারব না। তবে আমরা হাল ছাড়ব না।

আব্বাস বলেন, এখনো তিনি কোনো জোটকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। সব জোট থেকেই তারা সমান দূরত্ব রক্ষা করে চলছেন। তবে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে আরব সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করাকে তারা মেনে নেবেন না। আরবদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও অপরাধ বন্ধ করতে হবে। এসব করতে রাজি হলেই কেবল তার সমর্থন মিলবে।

মনসুর আব্বাসের ওই বক্তৃতা দেশটির বেশ কয়েকটিট টিভি চ্যানেলে প্রাইমটাইমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। কারণ একটাই তিনিই এখন কিংমেকার।

১৯৭৪ সালে তিনি উত্তর ইসরাইলের গ্যালিলিয়েন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামী বিশ^াস নিয়েই তিনি একজন ইসরাইলি হিসেবে বাস করতে চান।

মনসুর আব্বাস আরব ইসরাইলিদের মূলধারার রাজনীতিতে ও সমাজে অংশগ্রহণের পক্ষে কথা বলেন। ইসরাইলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফিফ আবু মুচ বলেন, মনসুর আব্বাসের বিজয় তাকে কিংমেকার বানিয়েছে। তিনি ইসরাইলে আরব ভোটারদের বদলে দিতে চাচ্ছেন। তিনি বলছেন যে তার নিজস্ব লক্ষ্য আছে। তিনি নেতানিয়াহু বা অন্য কারো পকেটের লোক হবেন না।

টাইমস অফ ইসরাইল পত্রিকায় বলা হয়েছে, মনসুর আব্বাস একজন দক্ষ রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তিনি অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন।

বৃহস্পতিবারের ভাষণে আব্বাস বলেছেন, আমি আশার প্রার্থনা করি। আমি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সত্যিকারের সাম্য নিয়ে সহাবস্থানের পক্ষে।

টাইমস অফ ইসরাইল বলছে, বৃহস্পতিবারের বহুল প্রতীক্ষিত ভাষণে তিনি কৌশলগত কারণে ফিলিস্তিনি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি। তিনি বলেছেন, আরব ইসরাইলিদের অবস্থান বুঝতে হবে ইহুদিদের। তবে এর মানে কিন্তু এই নয় যে তিনি ফিলিস্তিনিদের কথা ভুলে গেছেন। তিনি বাস্তববাদী এবং কৌশলী। ফিলিস্তিনিদের জন্য তিনি কৌশলে লড়াই চালিয়ে যাবেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মনসুর আব্বাসের বিজয় ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।