আলোচনার মধ্যেই পাকিস্তানের ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা


  • মোতালেব জামালী
  • ৩১ মার্চ ২০২১, ১০:২৪

পাকিস্তানের জাতীয় দিবস ছিল গত ২৩ মার্চ। এদিন দেশটির জনগণকে শুভেচ্ছা জানাতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে চিঠি লিখেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চিঠিতে তিনি বলেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত আশা করে পাকিস্তানের জনগণের সাথে তাদের একটি আন্তরিক সম্পর্ক থাকবে। তবে এর জন্য সন্ত্রাস ও শত্রুতামুক্ত একটি বিশ্বাসের পরিবেশ প্রয়োজন। চিঠিতে করোনাভাইরাস মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাকিস্তানের জনগণ ও ইমরান খানের সফলতা কামনা করেন মোদি।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে নানা ইস্যুতে বৈরী সম্পর্ক চলছে প্রতিবেশী ভারতের। সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে কাশ্মীর ইস্যুতে। কাশ্মির নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধও হয়েছে। কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণরেখা হিসেবে পরিচিত সীমান্তে মাঝেমধ্যে দুই দেশের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। কিন্তু হঠাৎ করেই গত মাস থেকে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই দেশের মধ্যে অস্ত্রবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া ইসলামাবাদে দেয়া এক বিবৃতিতে ভারতকে অতীত কবর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সেই আহবানেই সাড়া দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তবে দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে উত্তেজনা রয়েছে তাতে সম্পর্ক ভালো হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

দুই দেশের মধ্যে যখন সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস পাওয়া যাচ্ছে তখন ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য নতুন এক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে পাকিস্তান। ২৬ শে মার্চ দেশটির সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে সফলভাবে শাহিন-ওয়ান এ নামের এই ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালানোর তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, নতুন এই ক্ষেপণান্ত্রের পাল্লা নয় শ' কিলোমিটার।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই পরীক্ষার মূল লক্ষ্য হলো ক্ষেপণাস্ত্রটির বিভিন্ন নকশা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যাচাই করে দেখা। এ ক্ষেপণাস্ত্রটি আধুনিক দিক-নির্দেশনা প্রযুক্তি অনুসারে নির্দিষ্ট স্থানে আঘাত হানতে পারে কি না তাও যাচাই করা হয়।' প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা এ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সফল হওয়ায় প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও দেশটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের অভিনন্দন জানান বলে বিবৃতিতে বলা হয়।

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত অধিকৃত কশ্মিরের পুলওয়ামা জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ীতে বোমা হামলায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর ৫০ জনের বেশি সদস্য নিহত হন। ভারত অভিযোগ করে যে, পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট উগ্রবাদী গোষ্ঠির সদস্যরাই এই হামলা চালিয়েছে। ভারত এর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহনের হুমকি দিলে দুই দেশের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের কাছাকাছি অবস্থায় চলে আসে প্রবল বৈরি দুই প্রতিবেশি দেশ।

এ সময় পাকিস্তানের ভিতরে ভারত বিমান হামলা চালায়। ভারত দাবি করে, তারা বিমান হামলা চালিয়ে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠির প্রশিক্ষণ শিবির গুড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে তাদের অনেক সদস্য হতাহত হয়েছে। ভারতের হামলার সময় পাকিস্তানী বিমান বাহিনী ভারতের একটি যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত ও এর পাইলটকে আটক করে। তবে শান্তি উদ্যোগের অংশ হিসেবে তাকে ভারতের কাছে দ্রুতই ফেরত পাঠানো হয়।

কিন্তু ২০১৯ সালের আগষ্ট মাসে ভারত একতরফা ভাবে জম্মু ও কাশ্মিরের সাংবিধানিক স্বায়ত্বশাসন বাতিল করে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও বিশেষ মর্যাদা বাতিল করলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। সম্পর্কের আবারো অবনতি ঘটে। ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মিরকে কেন্দ্রের শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। পুরো অঞ্চলকে জম্মু ও কাশ্মির এবং লাদাখ নামে দুটিঅঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। সেখানে কয়েক মাস ধরে কারফিউ বলবত রাখা হয়। আটক করা হয় শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে। বাসিন্দরা বঞ্চিত হন তাদের মৌলিক অধিকার থেকে।

এরপর থেকে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রন রেখায় পাকিস্তান ও ভারতের সেনাদের মধ্যে নিয়মিত ভাবে গুলি বিনিময় হয়ে আসছে। এতে উভয় পক্ষেরই সামরিক-বেমামরিক লোকজন হতাহত হয়েছে। কিন্তুহঠাৎ করেই দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র বিরতির ব্যাপারে সমঝোতা হয় এবং দ্রুতই তা কার্যকর হয়। এখন ইমরান খানকে লেখা নরেন্দ্র মোদির চিঠিতে দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আহবানকে ঘিরে সবার প্রত্যশা আরো বেড়ে গেছে।

কিন্তু কাশ্মির নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিনের যে বিরোধ তার কোন সুরাহা না হলে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আদৌ সম্পর্কের উন্নতি হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। দুই দেশের বিরোধের মূল কারণই হচ্ছে কাশ্মির ইস্যু। এই ইস্যুর ন্যায়সগংত সমাধান না হলে পাক-ভারত বিরোধ থেকেই যাবে। নরেন্দ্র মোদি বা ভারত সরকার বিরোধপূর্ণ কাশ্মির ইস্যুর সমাধানে কি পদক্ষেপ নেয় সে দিকে রয়েছে সবার দৃষ্টি ।

ভারত অধিৃকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী সংগঠন সর্ব দলীয় হুরিয়াত কনফারেন্সের নেতারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নরেন্দ্র মোদির চিঠি লেখাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এই উদ্যোগ তখনই সফল হবে যখন দুই প্রতিবেশি দেশ কাশ্মির ইস্যুকে তাদের আলোচনার মধ্যে আনবে।

সর্বদলীয় হুরিয়াত কনফারেন্স এক বিবৃতিতে বলেছে, দুই দেশের সুপ্রতিবেশিসুলভ সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে তারা সতর্কবানী উচ্চারণ করে বলেছে, এই অঞ্চলে ভীতিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলেই কেবল দুই দেশের মধ্যে আলোচনা সফল হবে। হুরিয়াত একথা দঢ়ভাবে বিশ^াস করে যে, যদি কাশ্মিরে বাস্তবে ভয়-ভীতি ও নির্যাতন-নিপীড়নমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করা না হয় তাহলে দুই দেশের মধ্যে সুপ্রতিবেশি সুলভ আন্তরিক সমস্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কখনোই সফল হবেনা।

হুরিয়াতের বিবৃতিতে কাশ্মিরে সব রাজবন্দি ও যুবকদের জেল থেকে মুক্তি, এবং যাদেরকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে তাদের সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে গোয়েন্দ সংস্থার মাধ্যমে ভয়-ভীত দেখানো ও হয়রানী করার নীতির অবসান ঘটানোরও দাবি জানানো হয়।

হুরিয়াত নেতা আব্দুল গণি ভাট আরব নিউজকে বলেন, দুই প্রতিবেশি দেশের বৈরি সম্পর্কের মাঝখানে পড়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরণের নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হচ্ছি। যদি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, ব্যবসায়িক কর্মকান্ড, রাজনৈতিক বিনিময়সহ নানা ক্ষেত্রে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে তাহলে আমরা সত্যিকার অর্থেই উপকৃত ও লাভবান হবো।

যখন কেউ বিরোধ মিমাংমার উদ্যোগ নেবে, তখন সেই সমস্যাগুলোকে আলোচনায় আনতে হবে যেগুলো সম্পর্কের অবনতি ঘটায়, শত্রুতা ও তিক্ততার সৃষ্টি করে। আর এক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হচ্ছে কাশ্মির। কাজেই কাশ্মির ইস্যুটিকে অবশ্যই আলোচনার টেবিলে আনতে হবে।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন যশোবন্ত সিনহা। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের সাথে শান্তি আলোচনা শুরুর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। নরেন্দ্র মেদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সিনহা বিজেপির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সম্পতি তিন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর তৃনমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। কাশ্মীর নিয়ে তিনি তার পর্যবেক্ষন তুলে ধরেছেন।

আরব নিউজকে যশোবন্ত সিনহা বলেন, কারো প্রভাবেই হোক, আর কোন চাপের কারনেই হোক ভারতের বর্তমান সরকার পাকিস্তানের সাথে আলোচনার দরজা উন্মুক্ত রেখেছে। এজন্য আমি আনন্দিত। তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানের সাথে আমাদের কথা বলা উচিত, স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখা উচিত।

মোদি সরার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর পরিস্থিতি বদলে যাওয়া সত্বেও আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন যশোবন্ত সিনহা। তিনি বলেন, যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান খুজে পাওয়া যাবে। পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব, বিশেষ করে সামরিক নেতৃত্ব শান্তির কথা বলছেন, এই সুযোগটি গ্রহন করা উচিত।

দিল্লিতে বসবাসকারি ভারতীয় লেখক ও বুদ্ধিজীবি রাধা কুমার এক সময় কাশ্মিরে শান্তি প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। তিনি মনে করেন , পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে সুযোগ ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। একই সঙ্গে এটা কাশ্মিরে ভারতের ‘সঠিক পথে’ এগুনোর ক্ষেত্র তৈরি করবে।

কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হলেও এখন সেখানে সর্বোচ্চ স্বায়ত্ব শাসন দিয়ে পাকিস্তান ও ভারতে মধ্যে আলোচনার পথকে সুগম করা যেতে পারে বলেও তিনি মনে করেন। তিনি ক্ষুব্ধ ও উত্তপ্ত কাশ্মিরে সহিংস পরিস্থিতি অবসানের একমাত্র উপায় হচ্ছে শান্তি আলোচনা শুরু করা।