বাইডেনের যুদ্ধ মিশনের পরিণতি


  • মেহেদী হাসান
  • ০৪ মার্চ ২০২১, ১৪:৫৪

হোয়াইট হাউসের দায়িত্বগ্রহণের ৩৭ দিনের মাথায় ২৫ ফেব্রুয়ারি সিরিয়ায় বোমা হামলা চালিয়েছে জো বাইডেন প্রশাসন। বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সামরিক পদক্ষেপ নয় বরং কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেবেন। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বন্ধে উদ্যোগ নেবেন। ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তিতে পুনরায় যোগ দেবেন। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি উল্টে দিয়ে বাইডেন হামলা চালালেন ২০ বছর ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায়। সমস্যা সমাধানে কূটনীতি নয়, বরং সামরিক পদক্ষেপকেই বেছে নিলেন বাইডেন।

সিরিয়া হামলার পর পেন্টাগনের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সিরিয়ায় হামলা পরিচালনা করা হয়েছে। পেন্টাগন মুখপাত্র জন কারবি বিবৃতিতে বলেন, সিরিয়া হামলার মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীন বার্তা দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো, আমেরিকান এবং মিত্র সৈনিকদের রক্ষায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন পদক্ষেপ নেবেন। একইসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে পূর্ব সিরিয়া এবং ইরাকে সংঘাত বন্ধ করার লক্ষ্যে।

বাইডেনের সিরিয়া হামলাকে অনেকে বিপজ্জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সংঘাত বন্ধ নয় বরং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন। নির্বাচনের আগে বাইডেনকে কেউ কেউ যুদ্ধবাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এজন্য তারা তুলে ধরেছিলেন তার পেছনের রেকর্ড। কৃষ্ণাজ্ঞ সাংবাদিক গ্লেন ফোর্ড নির্বাচনের আগে বাইডেনকে একজন কট্টর বর্ণবাদী এবং যুদ্ধবাজ হিসেবে সমালোচনা করেছেন ।

বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকানদের যুদ্ধ, কঠোরতা এবং আরো বেশি হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা বর্ণবাদ উপহার দেবেন এমন আলোচনাও ছিলো। বাইডেন কি আসলেই একজন যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন এখন এ প্রশ্ন অনেকের মনে দেখা দিয়েছে ।

নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সিরিয়া হামলার ঘটনা তার বিপরীত। আর আমেরিকানরা এ জন্য তাকে ভোট দেয়নি। অনেক আমেরিকান বাইডেনের এ সিরিয়া হামলায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। বারবারা লি, বার্নি স্যান্ডারস মতো ব্যক্তিরা এ হামলা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশেষজ্ঞ বাইডেনের এ হামলাকে অবৈধ আখ্যায়িত করে বলেছেন এ হামলার আগে কংগ্রেসের অনুমতি নেওয়ার দরকার ছিল ।

সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার তাৎপর্য নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে। অনেকের মতে সিরিয়া হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে বার্তা দিয়েছে। পরমানু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ফিরে আসার জন্য হয়ত আলোচনায় বসবে দেশটি। কিন্তু তার মনে এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র -ইরান সব বিরোধ অবসান হয়ে গেছে। সিরিয়ায় এই হামলার মানে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান বিরোধ আগের মতই রয়ে গেছে। সিরিয়া হামলার অর্থ মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘ সংঘাত সহসা অবসানের আশা নেই বরং পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।

সিরিয়ায় হামলার পর পেন্টাগনের বিবৃতিতে জানানো হয় ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটিতে হামলার জবাবে সিরিয়ায় এ হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৫ ফেব্রুয়ারি ইরাকে রকেট হামলার ঘটনা ঘটে । এতে যুক্তরাষ্ট্র আর্মির একজন কনট্রাক্টর নিহত এবং আরেকজন সৈন্য আহত হয়।

সিরিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলাকে কাপুরুষোচিত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। চীন এবং রাশিয়ার পক্ষ থেকেও এ হামলার নিন্দা করা হয়েছে। রাশিয়া ফেডারেশন কাউন্সিলের একজন সদস্য আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলার মাধ্যমে এ অঞ্চলে বড় ধরনের সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তবে মজার বিষয় হলো, হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র জেন পসাকি ২০১৭ সালে ট্রাম্পের সিরিয়া আক্রমণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । তিনি বলেছেন, ট্রাম্প আমলে যে হামলা চালানো হয় তার আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে? তার মতে সিরিয়া একটি স্বাধীন দেশ কিন্তু আসাদ একজন বর্বর একনায়ক।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন এ ধরনের হামলার বৈধতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইনে। ১১ সেপ্টেম্বর হামলার পর আইন করা হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তায় বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র আর্মিকে যুক্ত করা যাবে। রিপাবলিকান সিনেটর বারবারা লি দীর্ঘ দিন ধরে চেষ্টা করছেন এ আইন বাতিলের। কারন এ আইনের অপব্যবহার হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

শুধু বাইডেন নয় তার পূর্বসূরী প্রেসিডেন্টরাও হোয়াইট হাউসে বসার পর বিভিন্ন দেশে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বুশ ২৭ দিনের মাথায় ইরাকে হামলা করেন। ওবামা ৩ দিনের মাথায় পাকিস্তানে হামলা করেন। ট্রাম্প ৯ দিনের মাথায় ইয়েমেনে হামলা করেন। আর বাইডেন ৩৭ দিনের মাথায় সিরিয়ায় হামলা পরিচালনা করে যুদ্ধ মিশন শুরু করলেন।

ইরাকে থাকা ইরান সমির্থত মিলিশিয়াদের ওপর হামলা না করে সিরিয়ায় হামলা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলছেন তাহলে কি বৃটিশ-ইরাকী প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল কাদিমি ইরাকের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার অনুমতি দেননি?

আল কাদিমির অনুরোধ ন্যাটো ইরাকে সৈন্য সংখ্যা ৫শ থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজারে পরিণত করছে। ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য এবং তুরস্ক থেকে এ সৈন্য আসবে ইরাকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে নয়। ইরাকে ন্যাটো সৈন্য বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের লাগাম টেনে ধরা। তবে ইরাকে শিয়া বিরোধী এ পদক্ষেপে শেষ পর্যন্ত আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে ক্ষমতা হারাতে পারেন কাদিমি।

সিরিয়া হামলার মাধ্যমে পেন্টাগন ইরানকে নতুন বার্তা দিতে চাইলেও এটিকে বাইডেনের ভুল সিদ্ধান্তই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে এ হামলা ইরানের সাথে আলোচনার পথকে কঠিন করে তুলবে। পরমানু চুক্তি নিয়ে ইউরোপীয় কূটনীতিকরা যখন ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আবার এক টেবিলে আনার চেষ্টা করছেন তখন এ হামলা পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেদের বের করে আনা। কারন ১ বছর আগে ইরাকের সংসদ ভোট দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্যদের ইরাক ছাড়ার পক্ষে। সিরিয়া হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে ইরাক সরকারের কাছ থেকে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিরিয়ায় ইরানী মিলিশিয়াদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়ড অস্টিন বলেন, সিরিয়ায় যাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে তারাই ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা চালিয়েছে।

কিন্তু ইরানের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয়েছে ইরাকে তারা যেসব মিলিশিয়াদের সমর্থন দিচ্ছে তাদেরকে এ ধরনের হামলা করা বিষয়ে কঠোরভাবে নিষেধ করে থাকে। আর ইরান এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো সংঘাতে জড়াতে চায় না, কারন ইরান চায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালের পরমানু চুক্তিতে আবার প্রবশে করুক । ইরাকের একজন মিলিশিয়া কমান্ডার মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, তাদের পরিচিত কোনো গ্রুপ ইরাকে এ হামলা চালায়নি। বাইডেন প্রশাসন কেমন হয় তা দেখার জন্য ইরান ধৈর্য্যরে সাথে অপেক্ষা করছে।

২০২০ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ছিল অন্তহীন সমালোচনা। কিন্তু তার বিরুদ্ধ প্রার্থী বাইডেনকে নিয়েও তেমন উচ্ছ্বাস ছিল না। এমনকি অনেক ডেমোক্রেটও ছিলেন হতাশ। নির্বাচনের আগে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন আমেরিকানদের দুর্ভাগ্য যে, এবার ট্রাম্প আর বাইডেনের চেয়ে ভাল কোনো প্রেসিডেন্ট বাছাই করার সুযোগ নেই তাদের। অনেকের মন্তব্য করেন ‘আমেরিকাস গট ট্যালেন্ট, জাস্ট নট পলিটিক্যাল ট্যালেন্ট’।

নির্বাচনের আগে যারা বাইডেনকে যুদ্ধবাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন সিরিয়া হামলার পর তারা আবারো তার অতীত রেকর্ড সামনে এনেছেন ।

বুশের ইরাক অভিযানের সময় জো বাইডেন ছিলেন ফরেন রিলেশন কমিটির চেয়ারম্যান। বুশ আর ও তার পদলেহী টনি ব্লেয়ারের ইরাক অভিযানের পক্ষে যুক্তি ছিল, সাদ্দাম হোসেন ব্যাপক বিধ্বংসী মারানাস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছে। এসময় জো বাইডেন এ অভিযানের পক্ষে তার এক লাইভ বক্তব্যে বলেন, সাদ্দাম হোসেন পারমানবিক বোমা বানাতে যাচ্ছে। সাদ্দামবিহীন পৃথিবী হবে একটি ভাল পৃথিবী।

জো বাইডেনও সাদ্দামের হাতে উইপন অব ম্যাস ডিসট্রাকশন, ক্যামিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল উইপনস থাকার কথা বলেছিলেন। ইরাক যুদ্ধের পক্ষে তিনি তখন জোরালো বক্তব্য রাখেন। সাদ্দাম হোসেনকে আল কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত করারও চেষ্টা করেন ।

এমনকি যুদ্ধের ৯ মাস পরেও বাইডেন ইরাক অভিযানের পক্ষে এবং এ অভিযানের জন্য বুশের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য দেন। বুশকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাহসী লিডার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাইডেন বলেন, আমি এবং অনেকেই তাকে সমর্থন করি।

সাদ্দাম হোসেনের কাছে কোনো ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র পায়নি যুক্তরাষ্ট্র এবং যুদ্ধের নয় মাস পরও বাইডন এ যুদ্ধকে সঠিক প্রমানের চেষ্টা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই ইরাক অভিযানের ফলে তছনছ হয়ে যায় গোটা মধ্যপ্রাচ্য।