তুরস্ক-পাকিস্তান মৈত্রীর বিপরীতে ভারত-গ্রিস জোট কতটা কার্যকর?


  • মোতালেব জামালী
  • ০১ মার্চ ২০২১, ০৯:২৪

আধুনিক যুগে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। গঠন করা হচ্ছে নতুন নতুন জোট। এসব জোট গঠনের প্রতিক্রিয়ায় ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা উত্তেজনা আবার সামনে চলে আসছে। পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক বহু পুরনো। বর্তমানে দেশ দুটির মধ্যে এই সম্পর্ক আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু এই সর্ম্পককে ঘিরে উপমহাদেশ ও পূর্ব ভূমধ্যসাগীয় এলাকায় আছে এক ধরনের উত্তেজনা।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে তুরস্ক ও গ্রীসের মধ্যে বিরোধের অবসান হয়নি। অন্যদিকে কাশ্মির বিরোধ নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গ্রীস ও ভারতের মধ্যে নতুন করে একটি অংশীদারিত্ব গড়ে উঠার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

অপরদিকে গত ২৩ জানুয়ারি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন বিধ্বংসী রণতরী নির্মাণ চুক্তির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে দুই দেশের সম্পর্কের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। তুরস্কের জাহাজ নির্মান প্রকল্প বা মিলজেম প্রকল্পের আওতায় আঙ্কারা পাকিস্তানের জন্য এই রণতরী নির্মন করছে।

তুরস্কের জাহাজ নির্মাণ বা মিলজেম প্রকল্প একটি উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ। ১৯৯০ এর দশকে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সম্পদ ব্যবহার করে ও অভ্যন্তরীন বেসরকারি খাতের উদ্যোগে এই প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয়। এখানে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোতে সরবরাহ করাই এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দ্যেশ্য।

পাকিস্তান তুরস্কের এই লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে এসে ৪টি সাবমেরিন বিধ্বংসী রণতরী কেনার আদেশ দিয়েছে। অনুষ্ঠানে এরদোয়ান ‘তুরস্ক ও পাকিস্তান তাদের ঐতিহাসিক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক আরো একধাপ এগিয়ে নিয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি ভারত ও গ্রীসের সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আঙ্কারা ও ইসলামাবাদ যে কোন আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে।

প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্ক-পাকিস্তান সহযোগিতার ক্ষেত্রে মিলজেম প্রকল্প একটি মাইলষ্টোন হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্চে। তুরস্কের প্রতিষ্ঠান এসটিএম ও পাকিস্তান নৌবাহিনীর মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তুরস্কের এই কোম্পানীটির সাথে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। একটি চুক্তির আওতায় পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য একটি নেভী ফ্লিট ট্যাঙ্কার নির্মান করা হবে। অন্য চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান নেভাল ফোর্সেস কমান্ডের জন্য আগোষ্টা ৯০বি ক্লাশ সাবমেরিন নির্মান করা হবে।

পাকিস্তান ও তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প খাতে সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে সামরিক পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বৃদ্ধিরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানি ফ্রিগেট আলমগীর এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি স্পেশাল টিম পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সামরিক মহড়ায় অংশ গ্রহন করে আসছে। এই মহড়াটি সাগরের এমন একটি এলাকায় করা হয়েছে যেটির মালিকানা নিয়ে তুরস্ক ও গ্রীসের মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

তুরস্কের অভ্যন্তরীন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রতি আঙ্কারার উন্মুক্ত সমর্থন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২০ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ইজাজ আহমদ শাহ ও পাকিস্তানে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদুতের মধ্যে বৈঠক হয়। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একটি সূত্রের খবর অনুযায়ী ঐ বৈঠকে উভয় পক্ষই পরস্পরের নাগরিকদের দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রদানে একটি বিল পাশের বিষয়টি বিবেচনা করছে।

দুই দেশের মধ্যে বিশেষ সম্পর্কের আরেকটি মৌলিক বিষয় হিসাবে যোগ হয়েছে কাশ্মির বিরোধ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত তুরস্কের মেইনষ্ট্রিম মিডিয়াগুলো ভারতের কাশ্মির নীতির প্রশ্নে পকিস্তানকে সমর্থন ও ভারতের সমালোচনা করেছে। আনাতোলিয়ান ইয়ুথ এসোসিয়েশনের মতো তুরস্কভিত্তিক এনজিওগুলো কাশ্মিরে ভারতের ভূমিকা সীমিত করার জন্য অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তারা তুরস্ক সরকারকে ‘কাশ্মিরিদের কন্ঠস্বর’ হিসেবে কাজ করার আহবান জানাচ্ছে।

২০১৯ সালের শেষের দিকে তুরস্কের ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির এমপি আলী শাহীন প্রকাশ্যেই বলেন যে, আঞ্চলিক ঐতিহাসিক বিরোধ পর্যবেক্ষন করা এবং তা সমাধানে তুরস্কের একটি ইসলামিক মেকানিজম বের করা উচিত। এ কে পার্টির আরেকজন এমপি মোহাম্মদ বালাত বলেছেন, আমরা একথা বিশ^াস করি যে, কাশ্মির ইস্যু বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করা যায়না।

প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি ভারত অধিকৃত কাশ্মির, পাকিস্তান ও অন্যান্য স্থানে কাশ্মির সংহতি দিবস পালন করা হয়। এ দিবসটি উপলক্ষ্যে আঙ্কারায় পাকিস্তানি দুতাবাস আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এমপি মোহাম্মদ বালাত একথা বলেন। গত বছর জাতিসংঘে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের কাশ্মির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সে কথা তুলে ধরে একে পার্টির এই নেতা বলেন, আমাদের দেশ ও পুরো জাতি কাশ্মিরি জনগণের পাশে রয়েছে যারা অতীতে যুগ যুগ ধরে অত্যন্ত বেদনাময় দিন পার করেছে এবং বর্তমানেও করছে।

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে গত জানুয়ারিতে আজারবাইজান, পাকিস্তান ও তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা বৈঠক করেন। ত্রিপক্ষীয় এই বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু ও সিদ্ধান্ত ইসলামাবাদ ঘোষণায় তুলে ধরা হয়। এতে তিন দেশ বিশ^ব্যাপি সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠির অবস্থা পর্যবেক্ষন , তাদের প্রতি সমর্থন ও সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়। বিশেষ করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের মোকাবেলায় সমন্বিত কৌশল গ্রহনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আলোচনায় কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তান-ভারত বিরোধ এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের জলসীমা নিয়ে তুরস্ক ও গ্রীসের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিশেষ গুরুত্ব পায়।

তিন দেশ এ বিষয়গুলোতে তাদের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে পরস্পরের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে ঐকমত্য পোষণ করে। তাদের এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে নাগর্ণো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধের সময়ে। এই যুদ্ধে তুরস্ক ও পাকিস্তান আজারবাইজানকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করে। এর ফলে যুদ্ধে বিজয়ী হয় আজারবাইজান। অনেক গনমাধ্যমে এমন খবর আসে যে পাকিস্তানের বিশেষ বাহিনীর কিছু সদস্য এই যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। আজারবাইজের সাথে আর্মেনিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের সমর্থনের দিকটি গোপন ছিলো না। অপরদিকে আর্মেনিয়ার পক্ষে গ্রিস ও ফ্রান্স জোরালো সমর্থন প্রদান করে।

এরপর পাকিস্তানের সাথে আজারবাইজানের ঘনিষ্ট সর্ম্পকের নানা দিক প্রকাশ হতে থাকে। পাকিস্তানের জ্বালানী চাহিদার একটি বড় অংশ সম্ভবত আজারবাইজান পূরন করতে যাচ্ছে। এতদিন দেশটি এজন্য সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল ছিলো। পাকিস্তান – তুরস্ক সর্ম্পককে ভিত্তি ধরে দেশটি মধ্যএশিয়া ভূ রাজনীতিতে অংশ গ্রহনের চেষ্টা করছে। চীনের ঘনিষ্ট মিত্র হিসাবে এতে পাকিস্তানের প্রতি বেইজিংয়ের নীরব সমর্থন আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে মৈত্রীর প্রেক্ষাপটে এ দেশ দু’টির প্রতিপক্ষ ভারত ও গ্রীস পারস্পারিক স্বার্থে কৌশলগত অংশিদারিত্ব গড়ে তোলার বিষয়টি বিবেচনা করছে। যদিও নয়াদিল্লী ও এথেন্সের মধ্যে অনেক আগে থেকেই ভাল কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তাদের এই সম্পর্ক কখনোই সামরিক সহযোগিতার কিংবা অভিন্ন পররাষ্ট্র নীতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়নি। কিন্তু পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সাথে বিরোধের পর থেকে গ্রীস অনেক বেশি সক্রিয় পররাষ্ট্র নীতি গ্রহন করেছে এবং তুরস্কের আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে প্রতিহত করতে নতুন জোট গঠনের দিকে মনোযোগ দিয়েছে।

২০২০ সালের অক্টোবরে গ্রীক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিকোলাস পানাজিওটোপোলাস সেদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অমৃত লোগানের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। তারা দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী ও প্রতিরক্ষা শিল্পের মধ্যে পাস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। অন্যদিকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্প্রতি পর্তুগালের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে বৈঠককালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের উপর গুরুত্বারোপ করেন। পর্তুগাল আগামী ৬ মাসের জন্য ইইউ কাউন্সিলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবে। এক্ষেত্রে গ্রীস ইউরোপের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নত করার মধ্যস্থতাকারি হিসেবে কাজ করছে। এর ফলে গ্রীস ও ভারতের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়ে উঠেছে।

গ্রীস আসলে তুরস্কের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বলয় গড়ে তুলতে চাইছে। এজিয়ান সাগর অঞ্চল থেকে শুরু করে তা মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে ভারত পর্যন্ত সম্প্রসারন করতে চায় এথেন্স। গ্রীস চাইছে ভারতের সাথে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আগামী মাস গুলোতে দুই দেশের মধ্যে এ ক্ষেত্রে চুক্তি অথবা সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।

ভারতের অবস্থান ও বিপুল জনসংখ্যা তুরস্কের ভ-ূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে একটি বড় বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। আবার তুরস্কের ঘোর শত্রু গ্রীসের ভারতের সাথে গাটছড়া বাঁধা তুরস্কের জন্য বিব্রতকর বিষয় হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে ভারত যে গ্রীসকে তার কাছে টেনে নেবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

গ্রীস এখন কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হবে তা দেশটির উপরই নির্ভর করছে। এছাড়া গ্রীস-ভারত জোট আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কি ভূমিকা পালন করবে বা কতটুকু গুরুত্ব বহন করবে তা বলার সময় এখনো হয়নি।