প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোর রাজনৈতিক মৃত্যু

ম্যাক্রোর এই অবস্থানের পেছনে ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনোভাবও কম দায়ী নন - এপি

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:২৬

কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার ফ্রান্স এখন ইসলামের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত। ইসলামি উগ্রপন্থা দমনের নামে দেশটিতে ডজন ডজন মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আবার নাগরিক স্বাধীনতার দেশটিতে পুলিশকে দেওয়া হয়েছে নিপীড়নের অবাধ ক্ষমতা। এসবই হচ্ছে এক সময় উদার রাজনীতিক হিসেবে প্রশংসিত প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর নেতৃত্বে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে ক্রমেই অজনপ্রিয় হয়ে ওঠা ম্যাক্রোর রাজনীতির কার্যত মৃত্যু ঘটতে চলেছে। তরুণ প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোর শাসনে ফ্রান্সের এই উল্টো যাত্রা নিয়ে থাকছে আজকের বিশ্লেষণ।

২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উগ্র ইসলামবিদ্বেষী ও জাতীয়তাবাদী নেত্রী মেরিন লি পেনকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন ম্যাক্রো। তার এই বিজয়কে ফ্রান্সসহ সমগ্র ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদ, অভিবাসন ও বর্ণবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে মধ্যপন্থী রাজনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। অনেকে মনে করেছিলেন তরুণ ম্যাক্রো বিশ্বে নব্য উদারতাবাদেন ঝান্ডাকে আরও উচ্চকিত করবেন।

ম্যাক্রোর এই বিজয়ের আগে থেকেই ফ্রান্সে জঙ্গি হামলা হয়েছে কয়েকবার। সেখানে উগ্রপন্থী রাজনীতিরও উত্থান ঘটছিল দ্রুততার সঙ্গে। তবে সারা বিশ্ব ফ্রান্সে জঙ্গি হামলার নিন্দা করেছে। মুসলিমরাও ছিলও নিন্দায় সোচ্চার।

ফ্রান্সে সম্প্রতি আবারও জঙ্গি হামলা হয়েছে। এর জেরে দেশটিতে মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে পুলিশের নিপীড়নও বেড়েছে। তবে এ সংকটে ম্যাক্রো নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেননি। ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে এক খ্রিস্টান মৌলবাদীর হামলার বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মৃত্যুর পর আর্ডেন দেশবাসীকে মুসলিমবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে তার দেশকে সারা বিশ্বে অকল্পনীয় উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

ম্যাক্রো কিন্তু সে পথে পা বাড়াননি। তিনি পাশ্চাত্যের অনেক নেতার মতই ইসলামকেই শত্রুজ্ঞান করতে শুরু করেছেন। আইন করে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলিমদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালিয়ে দিয়েছেন। আর নাগরিক স্বাধীনতার খর্ব করে পুলিশের নিপীড়নের ভিডিও ধারণকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। ম্যাক্রোর এই পদক্ষেপে সারা দুনিয়ায় নিন্দার ঝড় বইছে। এমনকি তার দেশের উদার রাজনীতিক ও পাশ্চাত্যের উদারপন্থী গণমাধ্যমে তার কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আর দেড় বছর পর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতেই ম্যাক্রো এই পথ আকড়ে ধরেছেন। কারণ ভোটারদের কাছে তিনি ক্রমেই অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি স্থানীয় নির্বাচনে তার দল শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে। এরপর করোনা সংকটে তিনি নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তার দেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ইসলাম নিয়ে তার বিতর্কিত অবস্থানে তিনি পাশ্চাত্যেরও সমর্থন পাননি।

ভূমধ্যসাগর, লিবিয়া ও সর্বশেষ নাগারনো-কারাবাখে তিনি তুরস্কের কাছে যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছেন, তাতে তার দেশের খ্রিস্টান ভোটাররা চরম অসন্তুষ্ট। তাদেরকে খুশি করতেই ইসলাম আতঙ্ককে পুঁজি করছেন ম্যাক্রো। অন্যদিকে শেতাঙ্গ ভোটারদের মন জয় করতে পক্ষ নিয়েছেন পুলিশি নিপীড়নের। ম্যাক্রো মনে করছেন, ডানপন্থার দিকে তার এই অবস্থানে তার রাজনৈতিক লাভ হবে। এতে তিনি উগ্রপন্থী রাজনীতিকদের উত্থান ঠেকাতে পারবেন। তবে তার এই পদক্ষেপে তার অনেক সমর্থকও খুশি নন। তারা মনে করছেন, ম্যাক্রো নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছেন এবং মুসলিমদের দোষারোপের রাজনীতি করছেন।

তাদেরই একজন সংসদ সদস্য অরিলিয়েন ট্যাচি। ম্যাক্রোর নীতির কারণে তিনি তার দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। নিউইয়র্ক টাইসমকে তিনি বলেন, প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষতা মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে আমরা এই মুল্যবোধের বিপরীত মেরুর উগ্র জাতীয়বাদীদেরই পক্ষ নিচ্ছি। এতে ধর্মনিরপেক্ষতা শক্তিশালী হবে না। যারা এসব করছেন, তারা মূলত মুসলিমদের বাদ দিতে চাচ্ছেন।

ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইউরোপের খ্রিস্টান প্রধান দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি মুসলিমের বাস। অথচ গুটি কয়েক লোকের ধর্মীয় চরমপন্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ফ্রান্স সরকার ‘ব্যাপক ও নজিরবিহীন’ পদক্ষেপ চালু করেছে বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানিন। তিনি জানান, ৭৬টি মসজিদকে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য সন্দেহজনক মনে করা হচ্ছে। দারমানিন বলেছেন, সামনের দিনগুলোতে এই মসজদিগুলোকে তদন্ত করা হবে। কোনো সন্দেহ প্রমাণিত হলে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে।

মহানবী হযরত মোহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কার্টুন প্রকাশের পর থেকেই উত্তপ্ত ফ্রান্স। মহানবীকে নিয়ে বিতর্কিত কার্টুন প্রকাশের জেরে স্কুলশিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে হত্যা করা হয়। এরপর দেশটিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে গত ২০ অক্টোবর প্যারিসের বাইরের মসজিদ সাময়িকভাবে বন্ধের নির্দেশ দেয় ফ্রান্স। এছাড়া ইতোমধ্যে দুইটি সংগঠন বন্ধ করে দিয়েছে ফ্রান্স। মুসলিম দাতব্য বারাকা সিটি এবং সংখ্যালঘুদের ওপর ঘৃণাবাদী অপরাধ পর্যবেক্ষণকারী নাগরিক অধিকার গ্রুপ কালেক্টিভ এগেইনেস্ট ইসলামোফোবিয়া ইন ফ্রান্সও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেরাল্ড গ্রুনবার্গ মনে করেন, ম্যাক্রো ভোটারদের উগ্রপন্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। জনগণ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চাচ্ছেন। ম্যাক্রোই তাদেরই মনজয় করছেন। ম্যাক্রোর এই অবস্থানের পেছনে ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনোভাবও কম দায়ী নন। তারা এমন ব্যবস্থাকেই সমর্থন করেন।

২০২২ সালের নির্বাচনে ম্যাক্রোকে চ্যালেঞ্জ করবেন উগ্র জাতীয়তাবাদী ও অভিবাসনবিরোধী মেরিন লি পেন অথবা মূলধারার কোনো উগ্রপন্থী কোনো রাজনীতিক। তারা সবাই ম্যাক্রোর এই বিতর্কিত নীতিকে সমর্থন করছেন।

ফ্রান্সের বিখ্যাত গবেষক ওলিভিয়ার রয় বলেছেন, ফ্রান্সের এই কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় তিনি হতাশ। এখানে শিক্ষকদের বলা হচ্ছে তোমাদের ছাত্রদের নিন্দা করো। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরপন্থি। অনেকে বলেছেন, ম্যাক্রোর এই নীতির দীর্ঘমেয়াদী মাশুল গুণতে হবে ফ্রান্সকে। এটা হিতে বিপরীত হবে। দেশের ১০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা করে ফ্রান্সের লাভ হবে না।

মুসলিমবিরোধী অবস্থানের পাশাপাশি পুলিশি নিপীড়ন আড়াল করতে দেশটিতে নতুন যে আইন করা হচ্ছে তাতে নিপীড়নের ভিডিও ধারণ করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। কেউ মোবাইলসহ কোনো মাধ্যমে পুলিশি নিপীড়নের ভিডিও ধারণ করে প্রচার করলে তার এক বছরের কারাদন্ড এবং প্রায় অর্ধকোটি টাকা জরিমানা হবে। বিতর্কিত এ আইন নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

ফ্রান্সের বামপন্থী নেতা জঁ-লাক মেলেঙ্কন বলেছেন, এটা কর্তৃত্ববাদী সরকারের কাজ। নাগরিক স্বাধীনতার মূল কথা হলো ক্ষমতাধরদের হাত থেকে নাগরিককদের রক্ষা। বিতর্কিত এই খসড়া আইনের বিরুদ্ধে দেশটিতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। রাজধানী প্যারিসে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা দোকান ভাংচুর এবং যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করছে।

সরকারবিরোধী ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলনের কয়েক হাজার সদস্য শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ মিছিল করার সময় মুখ ঢাকা ও কালো পোশাক পরা একদল বিক্ষোভকারী দাঙ্গা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এসব মিলিয়ে গত কয়েক দিনে ধরেই পরিস্থিতি সহিংস আকার ধারণ করে। পুলিশ বহু বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে।

বিলটির সমালোচকেরা বলছেন, পুলিশের কর্মকান্ডের ছবি তোলা বা ভিডিও ধারণ করতে না দিলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হবে। কেননা ফ্রান্সের পুলিশের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ রয়েছে। আইনটি নিয়ে সমালোচনা মুখে ক্ষমতাসীন দল জানায়, এটি সংশোধন করা হবে। তবে এতেও বিরোধীরা শান্ত হয়নি। কয়েকদিন ধওে চলা আন্দোলন আরও জোরদার হচ্ছে।
ম্যাক্রোর কথিত ইসলাম সংস্কারের উদ্যোগে বিশ্ব সমর্থন দেয়নি। বরং মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ফ্রান্স। বিশ্বব্যাপী ইসলাম সমস্যার মধ্যে আছে বলে ম্যাক্রোর মন্তব্যর পর মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো। মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোতে ফরাসি পন্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছিলো। এতে ফ্রান্সের অর্থনীতিতে বড় আকারের ধাক্কা লেগেছিলো। এখন দেশটি অতীত বর্বরতারও চর্চা শুরু হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট কারেন আতিয়াহ মনে করেন , একসময়ের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ফ্রান্স বিশে^র বিভিন্ন দেশে বেশুমার নৃশংসতা চালিয়েছে।

কৃষ্ণাঙ্গ, আরব ও মুসলিমদের ওপর তাদের সেই বর্বরতার কথা মনে করে এখনো মানুষ দেশটিকে ভয় পায়। দেশটিতে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফ্রান্সের পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গ ও আরবদের ওপর নিপীড়ন চালায়। দেশটির মোট কারাবন্দিদের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই মুসলিম। ওয়াশিংটন পোস্টে আতিয়াহ লিখেছেন, ফ্রান্স আবার অন্ধকার পথে পা বাড়াচ্ছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে