ইলহাম আলিয়েভ : মধ্য এশিয়ার স্ট্রংম্যান

নির্বাচিত হয়ে প্রথম বছরেরই এক লাখ ৩৫ হাজার কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেন ইলহাম আলিয়েভ - ইন্টারনেট

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০২ নভেম্বর ২০২০, ১৬:২১

নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে লাইমলাইটে এসেছেন ইলহাম আলিয়েভ। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট তিনি। এবারের যুদ্ধের শুরু থেকেই তার কণ্ঠে ছিল আর্মেনীয় দখলদারিত্ব থেকে ভূখন্ড উদ্ধারের দৃঢ় প্রত্যয়। সৈন্যদের সাহস যোগাতে আর নাগরিকদের ভরসা দিতে প্রায় নিয়মতিই যুদ্ধ নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে বক্তৃতা করেছেন মধ্য এশিয়ার এই স্ট্রংম্যান। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন তুমুল জনপ্রিয় এই নেতা।

দীর্ঘদিনের শাসনে নামের পাশে কিছু সমালোচনা জমা হলেও ইলহাম আলিয়েভের প্রশংসার পাল্লাটাই ভারি। অর্থনীতির পাশাপাশি সামরিক শক্তিতেও আজারবাইজানকে পাল্টে দিয়েছেন তিনি। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবারের যুদ্ধে। আজারবাইজান কোনঠাসা করে ফেলেছে আর্মেনীয় সৈন্য ও তাদের সমর্থিত নাগোরনো-কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। তিনটি শহরসহ অনেক অঞ্চল পুনরোদ্ধার করেছে আজেরি সৈন্যরা। আর আই সাফল্যের পেছনে একটাই কারণ- আজারবাইজানের সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি।
তুরস্কের টিআরটি ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টারের বিশ্লেষক তুরান গাফারলি বলেছেন, আজবারবাইজানের সেনাবাহিনী আর সেই ১৯৯০ এর দশকের অবস্থানে নেই। গত এক দশকে দেশটি তার প্রতিরক্ষা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। বছরে খরচ হয়েছে দুইশো কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।

এই বিশ্লেষক মনে করেন এই সময়ে রাশিয়া, তুরস্ক আর ইসরাইল থেকে আজারবাইজান এমন কিছু যুদ্ধ প্রযুক্তি আর সমরাস্ত্র এনেছে, যা তাদের আঞ্চলিক শক্তিতে রুপান্তর করেছে। আর এই রূপান্তরের প্রধান কারিগর ইলহাম আলিয়েভ। আর্মেনীয়ার সাথে দীর্ঘ ৩০ বছরের সঙ্ঘাত নিয়ে আজারবাইজান যে সঙ্কটে আছে, সেটি থেকে উত্তরণের লক্ষ্য নিয়েই ইলহাম তার দেশকে সামরিক শক্তিতে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। যার ফলও পেয়েছে এবার দেশটি। সারা বিশ্ব দেখেছে আজারবাইজানের হামলায় কতটা বিপর্যস্থ হয়েছে আর্মেনীয়া। আকাশে অত্যাধুনিক ড্রোন আর মাটিতে স্থলবাহিনীর উন্নত সব সমরাস্ত্র- দুইয়ে মিলে আজারবাইজানের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি আর্মেনীয়রা।

নিজে যুদ্ধের ময়দানে না থাকলেও বলতে গেলে সামনে থেকেই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ইলহাম আলিয়েভ। নিয়মিত গণমাধ্যমে বক্তৃতা করেছেন যুদ্ধ নিয়ে। শুরু থেকেই নিজেদের ভূখন্ড উদ্ধারের প্রত্যয় ছিলো তার কণ্ঠে । টুইটারে নিয়মিত যুদ্ধের আপডেট দিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছে সৈন্যদের। আবার বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনেও তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন নিজেদের নৈতিক অবস্থান। পাশাপাশি ক‚টনীতিতেও দেখিয়েছেন সফলতা।

এবারের যুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নৈতিক সমর্থন আছে আজারবাইজানের দিকে। তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইউক্রেন তো সরাসরিই আজারবাইজানকে সমর্থন দিয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকাও আজারবাইজানের অবস্থানের বিপক্ষে যেতে পারেনি। আর এটির পেছনে ছিলো বাকুর দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা। যেটি কাজে লাগিয়ে তারা এবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়েছে। আর্মেনীয়ার সাথে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা চুক্তি থাকলেও ভ্লাদিমির পুতিন স্রেফ বলে দিয়েছেন নাগোরনো-কারাবাখে রুশ সৈন্যরা লড়াই করতে আসবে না।

এটি বুঝতে পেরে আর্মেনীয় হামলা শুরু করেছিল আজারবাইজানের কয়েকটি শহরের বেসামরিক এলাকায়। উদ্দেশ্য ছিলো এর মাধ্যমে আজারবাইজানকেও আর্মেনীয়ার মূল ভূখন্ডে হামলায় উস্কানি দেয়া। তাহলে রাশিয়াকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার সুযোগ ছিলো; কিন্তু সেই ভুল করেননি ইলহাম আলিয়েভ। তার দেশের সৈন্যরা আর্মেনীয়ার মূল ভূখন্ডে হামলা চালায়নি। আবার নাগরনো-কারাবাখের বেসামরিক এলাকায়ও হামলা করেনি। আলিয়েভ বারবারই বলেছেন, আজারবাইজান তার ভূখন্ড থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে চায়। অন্য কোন উদ্দেশ্যে তারা যুদ্ধে নামেনি। এবং শেষ পর্যন্ত সেই কথাতেই অটল থাকতে পেরেছে তার দেশের সামরিক বাহিনী। যে কারণে এই যুদ্ধকে অন্য দিকে টেনে নিতে পারেনি আর্মেনীয়া। এই কৃতিত্বও দিতে হবে প্রেসিডেন্ট আলিয়েভকে।

সামরিক খাতের মতো অর্থনীতিতেও দক্ষতা দেখিয়েছেন ইলহাম আলিয়েভ। আজারবাইজানের আছে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে যেমন শক্ত ভীতের ওপর দাড় করিয়েছেন তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদকেই ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে। আমেরিকা থেকে রাশিয়া, তুরস্ক এমনকি ইসরাইল সবার সাথেই সুসম্পর্ক আছে আজারবাইজানের। সম্পর্কের এমন চমৎকার ভারসাম্য বিশ্বরাজনীতিতে বিরল।

আজারবাইজানের অর্থনীতির প্রধান চালিকা খনিজ সম্পদ। দেশটির দুই তৃতীয়াংশ ভূখন্ড প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। প্রচুর তেল উৎপাদন করে আজারবাইজান। এছাড়া ককেশাস পাবর্ত্য অঞ্চলে আছে সোনা, রুপা, লোহা, তামা, টাইটেনিয়াম, ক্লোরিয়ামসহ আরো অনেকগুলো প্রাকৃতিক সম্পদের খনি। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে প্রেসিডেন্ট ইলহাম দেশকে দিয়েছেন সমৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রাতহবিলের হিসাব অনুযায়ী ২০০৫ সালে দেশটির মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি ছিলো ৬১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে সেটি বেড়ে দাড়িয়েছে ১৭১ বিলিয়ন ডলারে। ২০০০ সালে দেশটিতে বেকারত্বের হার ছিলো প্রায় ১২ শতাংশ, সেটি কমিয়ে এনেছেন ৫ শতাংশে।
দেেেশ ইলহাম আলিয়েভের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। যার প্রমাণ মেলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলগুলোতে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট পেয়েছেন ৮৬ শতাংশেরও বেশি। তার বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন ৭ জন। এর আগে ২০১৩ সালের নির্বাচনেও ভোট পেয়েছিলেন ৮৫ শতাংশ। ২০০৮ সালেও ৭ জন প্রাথীর মধ্যে ভোট পেয়েছিলেন ৮৭ শতাংশ। সেবার ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচন পর্যবেক্ষদের রিপোর্টে বলা হয়, দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আপত্তিকর কিছু ঘটেনি নির্বাচনে। এটি ছিলো তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় নির্বাচন।

ইলহাম আলিয়েভ প্রথমবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন ২০০৩ সালে। তার বাবা হায়দার আলিয়েভ ছিলেন তখনকার প্রেসিডেন্ট। স্বাস্থ্যগত কারণে হায়দার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে সড়ে দাঁড়িয়ে ছেলেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করেন। ওই নির্বাচনেও প্রায় ৭৭ শতাংশ ভোট পান ইলহাম। তবে সেবার তার পক্ষে প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছিল।

নির্বাচিত হয়ে প্রথম বছরেরই এক লাখ ৩৫ হাজার কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেন ইলহাম আলিয়েভ। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ছোট-বড় ২৭টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ব্যাপকভাবে প্রশংসীত হয় তার এই উদ্যোগ। তুরস্ক ও জর্জিয়ায় তেল সরবরাহের জন্য স্থাপন করেন বিশাল এক তেল পাইপলাইন।২০০৫ সালেতার একটি উদ্যোগ ছিলো তেল খাতের লাভের টাকায় অন্যখাতগুলোকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা। বিশ^বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার পর এই খাতগুলোকে আরো বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন এখন। প্রাকৃতিকগ্যাস উত্তোলনেও কয়েকটি বিদেশী কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে তার সরকার।

২০১৮ সালে এক গণভোটে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৭ বছর করার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিছুটা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন ইলহাম আলিয়েভ। সে হিসেবে তার প্রেসিডেন্সির চতুর্থ মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালে। ওই গণভোটে আরেকটি বিষয় ছিলো ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি। সেই পদে আবার নিয়োগ দিয়েছেন স্ত্রী মেহরিভান আলিয়েভাকে। এটিও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থীতার বয়সসীমা কমিয়েছেন। সমালোচকরা বলছেন, এর মাধ্যমে তার পুত্রকে দ্রæত রাজনীতিতে আনার রাস্তা খুলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদেশে তার সন্তানদের সম্পদ নিয়েও বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে আলোচনা হয়েছে।

নিরপেক্ষ জরিপে এখনো ইলহাম আজারবাইজানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। পিতা হায়দার আলিয়েভের গড়া দল নিউ আজারবাইজান পার্টির চেয়ারম্যানও তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক ইলহাম ১৯৬১ সালে বাকুতে জন্ম নেন। তখন আজারবাইজান ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার নিতে যান মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেসন্স-এ। স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু তার। পাশাপাশি কাজ করতে থাকেন শিল্প ও ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের সাথেও। পরবর্তীতে তার এই অভিজ্ঞতাই আজারবাইজানের অর্থনীতিকে বদলে দিতে কাজে লেগেছে।

রাজনীতি ছিল তার রক্তেই। বাবা হায়দার আলিয়েভ ছিলেন আজারবাইজান কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান। ১৯৮২ সালে মনোনীত হন সোভিয়েত ইউনিয়নের ফার্স্ট ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমে হায়দার আলিয়েভ কিছুদিন স্পিকার ছিলেন । এরপর ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

পিতার প্রেসিডেন্সির সময় মস্কো থেকে দেশে ফিরে রাষ্ট্রায়াত্ব তেল-গ্যাস কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন ইলহাম আলিয়েভ। এ সময় ১৩টি পশ্চিমা কোম্পানির সাথে তেল নিয়ে বড় একটি চুক্তি করে আজারবাইজান। এই চুক্তিটিই আজারবাইজানের অর্থনীতির ভীত গড়ে দেয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

পিতা হায়দার আলীয়েভের সরকারের তেল কূটনীতিরও অন্যতম নেপথ্য নায়ক তিনি। ২০০৩ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেন পিতা হায়দার। কিন্তু তিন মাস পরের নির্বাচনে হায়দার আলিয়েভ স্বাস্থ্যগত কারণে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করতে না পারায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন ইলহাম। আজরবাইজানে শুরু হয় তার শাসনের। যা এখনো চলছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের ওপর দু’দুটি পিএইচডি ডিগ্রিধারী ইলহাম আজারবাইজানের শিক্ষাব্যবস্থায়ও নিয়েছেন যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ। প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালনের ব্যস্ততার মাঝেও আজারবাইজানের তেলসম্পদ ও বিশ্বরাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে ইলহাম আলিয়েভের বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে