আরেকবার হেরে গেলো ফ্রান্স

কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আরেকবার হেরে গেলো ফ্রান্স - রয়টার্স

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০২ নভেম্বর ২০২০, ১৫:১৭

বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ ফ্রান্স। এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ তুরস্ক আবার মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ফরাশি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে আরব দুনিয়া। সব মিলিয়ে বলা যায়, একটা যুদ্ধংদেহী অবস্থা চলছে। ফ্রান্স ও তুরস্কের মধ্যে কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো জানাবো সেই বিশ্লেষণ

সম্প্রতি ফ্রান্সের একটি স্কুলে ক্লাস নেয়ার সময় একজন শিক্ষক তার ছাত্রদের একটি কার্টুন দেখান। কার্টুনটি মহানবী (সা)-কে ব্যঙ্গ করে আঁকা। প্রিয় নবীর এমন সহ্য করতে না-পেরে এক চেচেন শিক্ষার্থী হত্যা করে ওই শিক্ষককে।

এ ঘটনার স্বাভাবিক পরিণতি হতে পারতো এমন যে, ওই শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করা। কিন্তু ফরাশি সরকার ওই স্বাভাবিক পথে না-হেঁটে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে-দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর। তারা বহু মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার বন্ধ করে দিল, অনেক মুসলিমকে দেশ থেকে বহিষ্কার করলো।

ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বিপণীকেন্দ্রে 'হালাল' খাবার বিক্রির তীব্র সমালোচনা করলেন। তবে সবচাইতে এগিয়ে থাকলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্র। চরম ঔদ্ধত্যের সাথে তিনি বললেন, মুসলিমদের প্রিয় নবীকে ব্যঙ্গ করে এরকম কার্টুন প্রকাশ চলতেই থাকবে। কারণ, এটা নাকি বাকস্বাধীনতার অংশ।

এটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র। বলেছেন, ইসলাম সারা বিশ্বে 'সমস্যায়' আছে। তাই এর 'সংস্কার' প্রয়োজন, যাতে ধর্মটি ফরাশি প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে।
ফরাশি প্রেসিডেন্টের এমন বল্গাহীন বক্তব্যে মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। মুসলিম দুনিয়ার উদীয়মান পরাশক্তি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান বললেন, ফরাশি প্রেসিডেন্টের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে কেউ ইসলামের মতো একটা স্বীকৃত ধর্মকে 'সংস্কার' করার মতো উদ্ভট কথা বলে? তার উচিত মানসিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।

ফ্রান্সের বামপন্থী লা ফ্রান্স ইসসৌমিজ দলের নেতা ও সংসদ সদস্য জো লুক মেলানচোনও প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ-র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতির ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু কেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। নাকি এর পেছনে কাজ করছে ভিন্ন কোনো কৌশল। এর সাথে তুরস্কের সাথে ফ্রান্সের ভূরাজনৈতিক বিরোধের সর্ম্পক কতখানি। আসুন জেনে নেই।

এমনিতে লিবিয়ার যুদ্ধ থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অনেক বিষয়ে ফ্রান্স ও তুরস্কের মধ্যে মন কষাকষি চলে আসছে অনেক দিন থেকে। এর মাঝে নবী-অবমাননার ইস্যু যেন দু'দেশের নাজুক সম্পর্কের আগুনে ঘি ঢেলে দিলো। ফ্রান্স ও তুরস্কের দুই প্রেসিডেন্ট জড়িয়ে পড়েছেন তীব্র মতবিরোধে ।

প্রথমেই বলতে হয় ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের কথায়। তুরস্কের রাজধানী আংকারায় এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, ''আমি আমার দেশবাসীর কাছে আবেদন জানাই, ফরাশি পণ্যের দিকে তাকাবেন না। ওসব পণ্য কিনে একটি টাকাও নষ্ট করবেন না।''

স্পষ্টতই এটা ছিল ফরাশি পণ্য বর্জনের ডাক। এর ক'দিন পরই আরব বিশ্ব ফরাশি পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। আর ফ্রান্স বলে, তারা এ রকম কার্টুন আঁকা চালিয়ে যাবে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র-র পাগলামি দেখে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ে এই লোকের সমস্যাটা কোথায়? তার উচিত, মানসিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।
এই ইস্যু ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে এরদোয়ানের মুখোমুখি অবস্থানে আছেন ম্যাঁক্র। লিবিয়ায় যেমন, তেমনই আজারবাইজানেও তুরস্কের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়েছে ফ্রান্স। গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ম্যাঁক্র তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এরদোয়ানকে। বলেন, আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানী বাহিনীকে ''লাগামহীন ও বিপজ্জনকভাবে'' মদদ দিচ্ছেন তুরস্কের নেতা। এটা মেনে নেয়া যায় না।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আরো অভিযোগ করেন যে, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান চলমান যুদ্ধে আজারবাইজানী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে সিরিয়ান যোদ্ধা পাঠাচ্ছে তুরস্ক। এর আগে গত জানুয়ারী মাসে তিনি বলেছিলেন, লিবিয়ায় সরকারী বাহিনীর পক্ষে লড়তে সিরিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা পাঠাচ্ছে তুরস্ক।

ইতোমধ্যে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান যুদ্ধে নাগারনো কারবাখের বিরাট অংশ দখল করেছে আজারবাইজান। তুরস্কের ড্রোন তছনছ করে দিয়েছে আর্মেনিয়ার সামরিক সামর্থ্য। এ নিয়ে রাশিয়াকে সাথে নিয়ে তুরস্কের ওপর চাপসৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে ম্যাক্রো। তাতে বড় কোনো সুবিধা অর্জন করতে পারেনি। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সংঘাতের বাইরেও তুরস্কের সাথে আরো বেশ কিছু বিষয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে ফ্রান্সের।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে তীব্র বিরোধ রয়েছে ফ্রান্স ও তুরস্কের মধ্যে। স¤প্রতি কাস্টেলারিজো দ্বীপের কাছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য জাহাজ পাঠায় তুরস্ক। এতে ক্ষেপে যায় ফ্রান্স। বলে, তুরস্ককে অবিলম্বে ওই এলাকায় তেল-গ্যাস খোঁজা বন্ধ করতে হবে। কারণ, ওটি বিতর্কিত এলাকা। ওখানে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের অধিকার তুরস্কের নেই।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে বলা হয়, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সাময়িকভাবে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করে পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখবে ফ্রান্স, যেন ওই এলাকায় কেউ আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করতে না-পারে। শুধু তাই নয় ফ্রান্স পূর্ব ভুমধ্যসাগরে এর আগে বিমানবাহী রনতরী পাঠিয়েছে। কিন্তু ফ্রান্সের এসব তৎপরতা কোনো আমলে নেয়নি তুরস্ক। এরমধ্যে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে বিরোধটি মূলত তুরস্ক ও গ্রীসের। ফ্রান্স এখানে খামোখাই নাক গলাচ্ছে। এর ফলে ওই অঞ্চলে যুদ্ধ লেগে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আসলে তুরস্কের সাথে বিরোধের অংশ হিসাবে গ্রিসের পক্ষে সামরিক শক্তি নিয়ে নেমে পড়ে ফ্রান্স। শুধু তাই নয় গ্রিসের কাছে রাফালে যুদ্ধ বিমান বিক্রি করেছে ফ্রান্স। চালিয়েছে সামরিক মহড়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের জন্য নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। যদিও ফ্রান্সের এসব তৎপরতায় অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো সাড়া দেয়নি। যা ম্যাক্রোর মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। এসব ব্যর্থ প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে দেশটির মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে।

তবে সত্যিকার যুদ্ধ শুরু না-হলেও ফ্রান্স ও তুরস্কের দুই নেতার মধ্যে বাগযুদ্ধ কিন্তু চলছেই। প্রেসডেন্ট ম্যাক্রঁ গত সেপ্টেম্বরে তুরস্কের বিরুদ্ধে ''স্পষ্ট ও শক্ত'' অবস্থান নিতে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতি আহবান জানান। এর জবাবে এরদোয়ান তাঁর দেশের সাথে ''গন্ডগোল'' না-করতে হুঁশিয়ার করে দেন ম্যাক্রোঁকে।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধেও ফ্রান্স ও তুরস্ক পরস্পরের বিপরীত অবস্থানে। এ নিয়েও দু' নেতার মধ্যে কথার লড়াইয়ের শেষ নেই। গত জুনে এরদোয়ানের নিন্দা করে ম্যাক্রঁ বলেন, লিবিয়ায় তুরস্ক এক ''বিপজ্জনক খেলায়'' জড়িয়ে পড়েছে। দেশটি বার্লিন সম্মেলনে দেয়া তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেছে। ওই সম্মেলনে সবাই একমত হন যে, বিদেশী কোনো রাষ্ট্রই লিবিয়ার যুদ্ধরত কোনো পক্ষকে অস্ত্র সরবরাহ করবে না। কিন্তু তুরস্ক এখন তা থেকে সরে এসেছে। আমরা তুরস্কের এ কাজ সহ্য করবো না।
মজার ব্যাপার হলো, তুরস্কের বিরুদ্ধে ফ্রান্স যে অভিযোগ তুলছে, একই অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে। তারা লিবিয়ার জঙ্গি নেতা খলিফা হাফতারকে সামরিক সহায়তা দিয়ে চলেছে। তাদের মদদ পেয়েই ২০১৯ সালের এপ্রিলে হাফতার বাহিনী রাজধানী ত্রিপলী প্রায় দখলই করে ফেলেছিল।
এ ক্ষেত্রে চমৎকার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে তুরস্ক। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের কৌশল হলো, ফ্রান্সকে ভুল পথে ঠেলে দেয়া এবং দেশে-বিদেশে দেশটির যেসব সমস্যা রয়েছে সেদিকে নজর দেয়ার সময় না-দেয়া। এভাবে এরদোয়ান চেষ্টা করছেন ফ্রান্সকে একঘরে এবং ইউরোপকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলার। এ কাজে তিনি তাঁর সবরকম অস্ত্রই প্রয়োগ করে চলেছেন।

ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের বিরোধের জায়গা ছিলো পূর্ব ভুমধ্যসাগর ও লিবিয়া। কিন্তু এই বিরোধের আরো নতুন জায়গা তৈরি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আফ্রিকার অনেক দেশ ছিলো ফ্রান্সের ঔপনিবেশ। এসব দেশে বাড়ছে তুরস্কের প্রভাব। এরমধ্যে ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্যর কারণে গোটা মুসলিম বিশ্বে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এর পুরো সুযোগ নেবেন এরদোয়ান। ফলে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আরেকবার হেরে গেলো ফ্রান্স।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে