মনোবল ভেঙে গেছে আর্মেনীয়দের

আজারবাইজানের পক্ষ নিয়ে তুরস্ক মাঠে নামলেও রাশিয়া ছোট ভূমিকায় কারো পক্ষ নিয়ে নামতে চায় না। কার্টুনটি করেছেন পরেশ নাথ - পলিটিক্যাল কার্টুনস ডটকম

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০১ নভেম্বর ২০২০, ১৪:২৬

এবারের স্বাধীনতা দিবসটা একটু অন্যরকম ভাবেই পালন করেছে আজারবাইজান। ১৮ অক্টোবর ছিলো স্বাধীন দেশ হিসেবে আজারবইজানের আত্মপ্রকাশের ২৯তম বার্ষিকী। তবে আগের প্রতিটি বারের তুলনায় এবারের স্বাধীনতা দিবসটি ছিলো বাড়তি আনন্দের। ৩০ বছর ধরে আর্মেনীয়ার অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে উদ্ধারকৃত কিছু এলাকা নিয়েই উৎসব করেছে এবার আজেরি জাতি। যদিও নাগোরনো-কারাবাখের মোট ভূখন্ডের তুলনায় উদ্ধারকৃত সেই এলাকার পরিমাণ সামান্যই। তবু মুক্তির এই উপলক্ষ এবার আজেরিদের স্বাধীনতা উৎসবে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

জাবরাইল, ফাজুলিসহ অধিকৃত ভূখন্ডের কয়েকটি শহরে এবার উড়েছে আজারবাইজানের পতাকা। স্বাধীনতা দিবসের একদিন পরও নতুন করে আরো ১৩টি গ্রাম উদ্ধার করেছে আজারবাইজান। ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ভূপাতিত করেছে আর্মেনীয়ার সু-টুয়েন্টি ফাইভ ফাইটার জেট। আর্মেনীয়ার বিমান বহরে থাকা সু-টুয়েন্টি ফাইভ দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী ফাইটার জেট। কিন্তু বিমান হামলা চালাতে এসে আজারবাইজানের এস-থ্রি হান্ড্রেড আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত হয় সেটি। এর আগেও আর্মেনীয়ার একটি যুদ্ধবিমান ভ‚পাতিত করেছে আজারবাইজান।

মজার ব্যপার হচ্ছে আর্মেনীয়ার সু-টুয়েন্টি ফাইভ ফাইটার ও আজারবাইজানের এস-থ্রি হান্ড্রেড আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা- দুটোই রাশিয়ার তৈরি। অর্থাৎ এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেই আছে রুশ প্রভাব। সেই আলোচনায় একটু পরে আসছি, তার আগে বলে নেই স্বাধীনতা দিবসে এবার বাড়তি আনন্দের পাশাপাশি শোকের ছায়াও আছে আজারবাইজানে। যুদ্ধের শুরু থেকেই বেসামরিক এলাকায় একের পর এক হামলা চালিয়েই যাচ্ছে আর্মেনীয় বাহিনী। গানজা, তারতার, বারদাসহ বেশ কয়েকটি শহর লক্ষ্য করে হামলা চালায় আর্মেনিয়া। এতে এখন পর্যন্ত নিহত আজেরি বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যা একশোর কাছাকাছি পৌছে গেছে। আর্মেনীয়াও অবশ্য বেসামরিক লোক হতহত হওয়ার অভিযোগ করেছে। পাশাপাশি তারা সব মিলে প্রায় ৭০০ সৈন্য নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে।

ইতোমধ্যেই এই যুদ্ধে আর্মেনীয়ার মনোবল ভেঙে গেছে। দুটি যুদ্ধবিমান হারানো, ড্রোন হামলায় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়া, অনেক ভ‚খন্ড হারানো এছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সর্বোচ্চ নেতা আরায়িক হারুতানিয়ান আহত হয়েছেন আজেরি হামলায়। আর্মেনীয় সেনাদের পাশাপাশিবিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বঘোষিত প্রশাসন নাগোরনো-কারাবাখে মার্শাল ল’ জারি করেছে।

আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পুরুষদের বাধ্য করা হচ্ছে যুদ্ধে যেতে। নব্বুইয়ের দশকের যুদ্ধের বুড়ো হয়ে যাওয়া সেনাদেরও এবার পাঠানো হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। তাদেরই একজন স্পেশাল ফোর্সের সাবেক কর্নেল আরতুর আলেকসানিয়ান। গত ১৫ বছরে তিনি কোন অস্ত্রই ধরেননি হাতে। কয়েকদিন আগে একটি অপারেশন হয়েছে পেটে। এই অবস্থায়ই তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে।

নিউইয়র্ক টাইমসকে এই যোদ্ধা বলেন, নব্বইয়ের দশকের সেই রাইফেল নির্ভর যুদ্ধ এখন আর নেই। আজেরি সৈন্যরা এত কৌশলি যে আমরা ফাঁদ পেতে তাদের আটকাতে পারি না। আমরা যে ভীত হয়ে পড়েছি সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। সত্যিই আমরা ভয় পেয়ে গেছি। তিনি বলেন, অগ্রসর হতে চাইলেই আমাদের সহজেই টার্গেট করতে পারছে আজেরি সৈন্যরা। সহযোদ্ধাদের অনেকের লাশও আমরা সংগ্রহ করতে পারিন। যুদ্ধক্ষেত্রেই পচে যাচ্ছে সেগুলো।

সম্মুখ সমরে টিকতে না পেরে আর্মেনীয়া নিয়েছে বেসামরিক এলাকায় হামলার কৌশল। মনে করা হচ্ছে যুদ্ধকে অন্য দিকে প্রবাহিত করার একটি আর্মেনীয় কৌশল এটি। তারা এর মাধ্যমে আজারবাইজানকেও বেসামরিক এলাকায় হামলা করতে উস্কানি দিচ্ছে। আজারবাইজান যদি আর্মেনীয়ার মূল ভ‚খÐে হামলা চালায় তাহলে রাশিয়ার সাথে আর্মেনীয়ার যে প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে সে অনুযায়ী রুশ সৈন্যরা আর্মেনীয়ার হয়ে যুদ্ধে নামতে পারবে।

আর্মেনীয়া অবশ্য আরো অনেকভাবেই যুদ্ধকে অন্যখাতে প্রবাহিত করতে চাইছে। শুরু থেকেই তারা দাবি করে আসছে যে, আজারবাইজানের হয়ে এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছে কয়েকশো সিরীয় বিদ্রোহী। তারা তুরস্ক হয়ে আজারবাইজানে প্রবেশ করেছে। যদিও এর পক্ষে কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। এরপর আর্মেনীয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান জড়িয়েছেন পাকিস্তানকে। গত সপ্তাহে তিনি বলেছেন, আজেরি বাহিনীর পাশাপাশি এই যুদ্ধে লড়াই করছে পাকিস্তানের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা। যথারীতি পাকিস্তানও এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে।

পাকিস্তান শুরু থেকেই এই যুদ্ধে আজারবাইজানকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, তার দেশ চায় ভ্রাতৃপ্রতীম আজারবাইজানে আর্মেনীয় দখলদারিত্বের অবসান। কিন্তু আজারবাইজানের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, তার সেনাবাহিনী দেশের ভ‚খÐ রক্ষায় যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের বিদেশী সাহায্য দরকার নেই।

এখন পর্যন্ত অবশ্য বিদেশী সাহায্য ছাড়াই এ পর্যন্ত এসেছে আজারবাইজান। বিদেশী সাহায্য দরকার হলে সবার আগে তুরস্কই আজারবাইজানের পাশে দাড়াবে। শুরু থেকেই তুরস্ক এই যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ। কোন রাখঢাক না রেখেই আঙ্কারা পাশে দাড়িয়েেেছ বাকুর। যুদ্ধে আজারবাইজানের যে সফলতা তার নেপথ্যেও তুর্কি সমরাস্ত্র।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান পশ্চিমাদের অভিযুক্ত করেছেন আর্মেনীয়াকে সহযোগিতার জন্য। এরদোয়ান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও রাশিয়া আর্মেনীয়ার পাশে দাড়িয়েছে এবং তাদের অস্ত্র দিয়েও সহযোগিতা করছে।তিনি বলেন, অতীতে ইরাক, সিরিয়া ও বলকান অঞ্চলে যা হয়েছে বর্তমানে লিবিয়া ও কারাবাখে তাই হচ্ছে। বৈষম্য আর বিচ্ছিন্নতাবাদ রক্ত আর অশ্রæ ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমাদের আজেরি ভাইয়েরা দখল দারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করছে- এরচেয়ে নৈতিক অবস্থান আর কী হতে পারে?

এরদোয়ান এই সঙ্ঘাতের দায় চাপিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সের কাধে। ৩০ বছরেও তারা আলোচনা শেষ করতে পারেনি এবং আজারবাইজানি জনগনের ভূখন্ড তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাশিয়ার ভূমিকা অবশ্য এই সংঘাতের শুরু থেকেই রহস্যজনক। তাদের মধ্যস্ততায় দু দফা যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলেও তা টেকেনি। উভয় পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করার অভিযোগ করছে। রাশিয়াও যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের জন্য খুব একটা চাপ দিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে না। রাশিয়া উভয় দেশেরই প্রধান অস্ত্রের জোগানদাতা। আর্মেনীয়া ও আজারবাইজান- দুটি দেশই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। মস্কো উভয় দেশের সাথেই সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে।

আর্মেনীয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই তাই রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেও মস্কোর পক্ষে সম্ভব হয়নি সরাসরি কারো পক্ষ নেয়া। ভ্লাদিমির পুতিন বলে দিয়েছেন, তার দেশ নাগোরনো-কারাবাখে আর্মেনীয়ার পক্ষে যুদ্ধে নামবে না। রুশ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক পাভেল লুজিন মনে করেন, রাশিয়া আসলে কারো পক্ষ নিয়ে ছোট ভূমিকায় মাঠে নামতে চায় না। মস্কোর এখন একটাই লক্ষ- সেটি হলো বিশ্বরাজনীতির বড় খেলোয়াড় হিসেবে অবস্থান আরো মজবুত করা।

রাশিয়ার অবশ্য অস্ত্র বিক্রিরও একটি স্বার্থ আছে ককেশাস অঞ্চলে। আর্মেনীয়া, আজারবাইজান উভয় দেশই তার অস্ত্রের ক্রেতা। একটিকে সমর্থন দিলে অন্যটিকে হারাতে হতে পারে। অস্ত্র রফতানি করে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা রাশিয়ার অর্থনীতির বড় একটি ভ‚মিকা পালন করে। ঝানু রাজনীতিক পুতিন চাইছেন না সেটি নিয়ে কোন ঝুঁকি নিতে। আবার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভ‚ক্ত দেশগুলোর কোনটিকেও দূরে সরাতে চাইছেন না। এতে আবার পশ্চিমাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে যে কোনো একটি দেশ।

আজারবাইজানের কাছে রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রিতে অবশ্য নাখোশ আর্মেনীয়া। ২০১৪ সালে আর্মেনীয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সার্জ সারগাশিয়ান বলেছিলেন, আমাদের জন্য খুব যন্ত্রণদায়ক বিষয় যে আমাদের কৌশলগত মিত্র আজারবাইজানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে।

নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে দুই দেশের যুদ্ধে এমন রহস্যময়আচরণ আরো আছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে একটি মুসলিম দেশ তার ভূখন্ড উদ্ধারে যুদ্ধে নেমেছে অথচ আরব রাষ্ট্রগুলো যেন সেটি দেখেও না দেখার ভান করে আছে। এর পেছনে দুটি কারন আছে বলে মনে করা হচ্ছে এক. আর্মেনীয়ার সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক, দুই. আজারবাইজানের পক্ষে তুরস্কের অবস্থান। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে তুরস্কের।

গত এক দশকে আর্মেনীয়ায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে আরব আমিরাত উল্লেখযোগ্য। সৌদি আরবের সাথে আর্মেনিয়ার আনুষ্ঠানিক কোন সম্পর্ক না থাকলেও ২০১০ সালের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হতে শুরু করেছে। আর এর প্রধান কারণ তুরস্কের প্রভাব ঠেকানো। রিয়াদ, আবুধাবির সাথে আঙ্কারার পরোক্ষ একটি লড়াই চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। মুসলিম ব্রাদারহুড, কাতার, লিবিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে তুরস্কের সাথে ছায়াযুদ্ধ চলছে আবরদের।

এছাড়া মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বাড়ুক সেট নিশ্চয়ই চাইছে না রিয়াদ ও আবুধাবি। আর সে কারণেই তারা আজারবাইজানকে সমর্থন দিচ্ছে না। আবার একই কারণে সংযুক্ত আরব আমরাতের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে চাইছে আর্মেনীয়া। গ্রিক গবেষক জর্জ মেনেশিয়ান মনে করেন, আর্মেনীয়ার সাথে যুদ্ধে আজরবাইজান জিতে গেলে সেটি যে মধ্য এশিয়ায় তুর্কি প্রভাবকে আরো জোরদার করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে