পানি ঘোলা করা খেলোয়াড়দের কথা

ইলাস্ট্রেশনটি করেছেন চ্যাড লেইস - স্মিথসোনিয়ানম্যাগ

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:২৯

বিশ্বরাজনীতির খেলোয়াড় বলতেই আমাদের মনের চোখে ভেসে ওঠে আমেরিকা-রাশিয়ার নাম। ভাবি, কেবল এরাই বুঝি পৃথিবীর সব নদীর পানি ঘোলা করছে। আসলে কিন্তু তা পুরোপুরি ঠিক নয়। এসব খেলোয়াড়ের তালিকায় আরো অনেক নাম আছে এবং রাজনীতি-কূটনীতির নোংরা খেলায় তারাও কম পারদর্শী নয়। আসুন সে রকম এক পানি ঘোলা করা খেলোয়াড়ের নানা দিক জেনে আসি।

এ তালিকায় আছে ফ্রান্স নামের দেশটিও; রাজধানী প্যারিসের কারণে যার একটি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি আঁকা আছে আমাদের মনে। আমরা ভাবি, প্যারিস নগরীর মতোই সুন্দর বুঝি ফ্রান্সের রাজনীতি কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি। আসলে তা একেবারেই নয় এবং নয় বলেই গত শরৎকাল থেকেই ফ্রান্স ও তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে শীতল হাওয়া। ফ্রান্স সরকার প্যারিসে নিযুক্ত তুর্কী রাষ্ট্রদূতকে তলব করলে এর সূত্রপাত ঘটে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তাঁর ফরাশি প্রতিপক্ষ ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ-কে ''ব্রেন ডেথ'' বলে আখ্যায়িত করলে এর প্রতিবাদ জানাতে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে ফ্রান্স।

তবে এ অশোভন অভিধাটি প্রথম ব্যবহার করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টই। সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদীদের দমনে তুরস্কের অভিযানের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ-ই এ শব্দটি ব্যবহার করেন। উভয় দেশ ন্যাট জোটের সদস্য হলেও সন্ত্রাসী অধ্যুষিত সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তুরস্কের অভিযানের তীব্র বিরোধী ফ্রান্স। 'সন্ত্রাসীদের ছিটমহল' নামে পরিচিত ওই অঞ্চলে ওয়াইপিজি ও পিকেকে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে তুরস্কের অভিযান একেবারেই সহ্য করতে পারে না দেশটি।

এর পাশাপাশি পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেও আরেক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে ফ্রান্স ও তুরস্ক। গত ১০ জুন লিবিয়ার উপকূলে দু' দেশের মাঝে এক নৌ-বিরোধ শুরু হয়। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ন্যাটো-র দ্বারস্থ হয় তুরস্ক। ফ্রান্স একেও সহজভাবে নেয় না। তারা তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের জন্য ইইউ কমিশনের প্রতি আহ্বান জানায়।

ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়া জাদুঘরকে মসজিদে রূপান্তরের তুর্কী সরকারি সিদ্ধান্তেরও প্রতিবাদ জানায় ফ্রান্স সরকার। ফরাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সেইন্ট সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরে তুরস্কের সুপ্রীম কোর্টের রায় এবং ওই রায় কার্যকর করতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ডিক্রি জারিতে ফ্রান্স গভীর দুঃখ পেয়েছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয় ফ্রান্স ও তুরস্কের মধ্যে বিরোধের অরেক ক্ষেত্র হলো লিবিয়া।

লিবিয়া নিয়েও দু'দেশের মাঝে বিরোধ চলছে অনেক দিন থেকে। লিবিয়ায় জাতিসংঘ-স্বীকৃত ত্রিপলি সরকারের পাশাপাশি তুরস্কের সামরিক উপস্থিতিরও নিন্দা করে থাকে ফ্রান্স। অথচ খোদ ফ্রান্সেরই ঐতিহ্যবাহী ও প্রভাবশালী সংবাদপত্র ''লা মঁদ'' ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক প্রতিবেদনে জানায়, লিবিয়ার বিভিন্ন স্থানে ফ্রান্স সংগোপনে তার স্পেশ্যাল ফোর্স মোতায়েন রেখেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, দায়েশ বা আইএস কখনও লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করলে তাদের সহায়তা করা। হিপোক্র্যাসি আর কাকে বলে!

অবশ্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হিপোক্র্যাসি বা দ্বিমুখী আচরণের অভিযোগ নতুন নয়। আরব বসন্তের সময় এবং তার আগে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল নিয়ে ফ্রান্সের যে রাজনৈতিক অবস্থান, তাতেও দেশটির বিরুদ্ধে হিপোক্র্যাসির অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, তিউনিসিয়ায় জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়ে স্বৈরশাসক জাইন এল আবেদিন বেন আলীর দুঃশাসনকে রক্ষা করতে চাইছে ফ্রান্স।

লিবিয়ার সাবেক একনায়ক মোয়াম্মার গাদ্দাফীর সঙ্গেও বেশ দহরম মহরম ছিল ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি-র। কিন্তু কী আশ্চর্য, ২০১১ সালে গাদ্দাফীকে উৎখাত করতে যে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়, তার সামনের সারিতেই ছিলো ফ্রান্স। এমনকি গাদ্দাফীকে হত্যার কাজটিও সেরেছে ফরাশি গোয়েন্দারা। বোঝা গেল, গাদ্দাফী ছিলেন একজন স্বৈরশাসক, তাই গণতন্ত্রের নিশান বরদার বা পতাকাবাহী হিসেবে তাঁকে উৎখাত করা ফ্রান্সের পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছে। প্রশ্ন হলো, ওই অঞ্চলে তো স্বৈরশাসকের কমতি নেই এবং তাদের সাথে ফরাশি সরকারের মাখামাখিও বড় কম নয়। তাদের ব্যাপারে ফ্রান্সের তথাকথিত গণতান্ত্রিক গলা শোনা যায় না কেন?

এহেন অনৈতিকতা শুধু-যে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতির জন্য ক্ষতি ডেকে আনছে তা নয়, বিশ্ব অঙ্গনে তাদের গ্রহণযোগ্যতারও হানি ঘটাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল, বিশেষ করে লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায় ফ্রান্সের একক ইচ্ছার পররাষ্ট্রনীতি জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। আর সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্কটকে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ যেভাবে ব্যবহার করতে চাইছেন তাতে মনে করা হচ্ছে তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব খর্ব করাই তাঁর আসল উদ্দেশ্য। সর্বসা¤প্রতিক বৈরুত বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর দেয়া তাঁর বিবৃতিতে এ অভিযোগেরই সত্যতা মেলে।

এদিকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের উপকূলে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আর তারই ফল হিসেবে উপকূলবর্তী পাঁচ দেশের মধ্যে উত্তেজনাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ফ্রান্স এসব দেশকে সাথে নিয়ে তুরস্ককে ঠেকিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা এঁটেছিল। এভাবে যে স্ট্র্যাটেজিক ল্যান্ডস্কেপ দৃশ্যমান হয় তাতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ-র উচিত 'নতুন লিবিয়া'র ভবিষ্যতকে বিবেচনায় নেয়া। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা, আগামী দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের প্রকৃত চাবিকাঠি তুরস্কের হাতেই। কেননা, তুরস্ক ইতিমধ্যেই দারুণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ইটালি ও জার্মানির সাথে। পুরনো সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে কথাবার্তা ও যোগাযোগ চলছে আমেরিকা ও রাশিয়ার সাথেও। ন্যাটো জোটের সঙ্গী হলেও এক্ষেত্রে ফ্রান্স একা।

তুরস্ক-ফ্রান্স সম্পর্ক চূড়ান্ত তিক্ততায় গড়ায় ২০১২ সালে, যখন ফরাশি সিনেটে ১৯১৫-১৬ সালের তথাকথিত আর্মেনিয়া গণহত্যার ওপর একটি প্রস্তাব পাস হয়। ওই কথিত গণহত্যার জন্য তুরস্কের ওসমানীয় শাসকদের দায়ী করা হয়ে থাকে। তুরস্কের পরবর্তী শাসকরা একে গণহত্যা বলে মানতে নারাজ।

অতীতে তুরস্ক যখনই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হতে চেয়েছে, তখনই একটি গোষ্ঠী আর্মেনিয়ার সেই আদ্যিকালের ঘটনা টেনে এনে তুরস্কের উদ্যোগকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। এ কাজে ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি বেশ সফল। এখন তারই পথ ধরে 'তুরস্ক ঠেকাও' অভিযানে নেমেছেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ।

আজকাল প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এক নতুন কূটনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছেন। নিজ দেশের রাজনৈতিক গোলযোগ এবং করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় তাঁর সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি হয়ে উঠেছেন মরিয়া। ফ্রান্সে 'ইয়েলো ভেস্ট' বিক্ষোভকারী এবং অন্যান্য সামাজিক আন্দোলন ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যা ম্যাক্রোঁ-র প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

সদ্যসমাপ্ত পৌর নির্বাচনের ফলাফল তাঁর জন্য এসেছে রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে। এর ফলে তিনি বাধ্য হয়েছেন তাঁর মধ্য-ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিতে এবং কট্টর ডানপন্থী শিবির থেকে একজন রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করতে। করোনা মোকাবিলায় সফল হয়ে এরদোয়ান যখন শক্তিশালী অবস্থানে, ব্যর্থতার দায় নিয়ে ম্যাক্রোঁ তখন কম্পমান।

ম্যাক্রোঁ-র ফ্রান্সের সামনে-পেছনে, ভেতরে-বাইরে অনেক সমস্যা। তার ঘাড়ে চেপে আছে ঔপনিবেশিক যুগে করা অপরাধের বোঝা। তাছাড়া যতই বিরুদ্ধাচরণ করুক, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় তুরস্ককে সাথে লাগবেই ফ্রান্সের। ইরানের পরমাণু হুমকি, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, লেবাননের আর্থ-রাজনৈতিক সঙ্কট, লিবিয়ার যুদ্ধ - সবখানেই। তার ওপর রয়েছে অভিবাসী ইস্যু। তুরস্ক বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোকে শরণার্থীর ঢল থেকে বাঁচিয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তুরস্কের সাফল্য উল্লেখ করার মতো।

উপ-আঞ্চলিক পর্যায়েও ফ্রান্সের জাতীয় ও নিরাপত্তা স্বার্থ প্রায়-ভূলুণ্ঠিত। দেশটির ঘরের দরজায় অবস্থিত মাগরেব ও সাহেল অঞ্চলের কথা বলা যায়। এমন অবস্থায় ফ্রান্সের উচিত তুরস্কের সাথে নমনীয় সর্ম্পক তৈরি করা। তাহলেই তারা লিবিয়া থেকে শুরু করে পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ফ্রান্সের তুরস্কের সহায়তা পেতে পারে। ফ্রান্স-তুরস্ক সহযোগিতা থেকেও লাভবান হতে পারে ফ্রান্স। এ সত্যটি ফ্রান্স দেশ এবং তাদের নেতা ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারেন, ততোই মঙ্গল। আর এর ফলে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ায় কিছুটা হলেও এগিয়ে যাবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে