জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে দলে নজিরবিহীন বিদ্রোহ

ক্রমেই স্বৈরতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করতে শুরু করেছেন শি জিনপিং - রয়টার্স

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩১ আগস্ট ২০২০, ১৪:৫৮

চীনের দীর্ঘ ঐতিহ্য ভেঙে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আজীবন ক্ষমতায় থাকার পথ আগেই পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন। এখন তিনি ক্রমেই স্বৈরতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাকে দমন করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই কথা বলতে শুরু করেছেন। জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলে নজিরবিহীন বিদ্রোহ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস ও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আজ আমরা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরের কিছু দিক তুলে ধরবো।

চীনের অভিজাত সেন্ট্রাল পার্টি স্কুলের সাবেক একজন অধ্যাপক জিনপিংয়ের নজিরবিহীন সমালোচনা করেছেন। তিনি বলছেন, জিনপিং দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আরও অনেকেই এখন দল ছাড়তে চাচ্ছেন। কাই শিয়া নামের ওই নারী অধ্যাপক চীনের কমিউনিস্ট নেতাদের পড়াতেন। জিনপিংয়ের কঠোর সমালোচনার একটি অডিও ফাঁস হওয়ার পর সম্প্রতি তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে তিনি আর চীনে নেই। তিনি এখন অবস্থান করছেন আমেরিকায়।

১৯৯২ সাল থেকে কাই শিয়া এই স্কুলে পড়াতেন। তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ অভিযোগ তুলছে যে তার মন্তব্যে দেশের ক্ষতি হয়েছে এবং এতে জটিল রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তবে কাই শিয়া বলেছেন, তাকে বরখাস্ত করায় তিনি খুশি।

তিনি বলেন, জিনপিংয়ের শাসনে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এখন আর দেশটির প্রগতির পক্ষের শক্তি নয়। এটা বরং চীনের উন্নতির অন্তরায়। আমি বিশ্বাস করি আমি একাই শুধু দেশ ছাড়তে চাইনি। আরও অনেকেই দল ছাড়তে চায়। তিনি বলেন, তিনি আরও বহু আগেই দল ছাড়তে চেয়েছিলেন। কারণ তার মত প্রকাশের কোনো সুযোগ ছিল না।

অথচ ৬৭ বছর বয়সী কাই শিয়া ছিলেন চীনের এস্টাব্লিসমেন্ট বা ক্ষমতাবলয়ের লোক। তিনি যে স্কুলে পড়াতেন সেই সেন্ট্রাল পার্টি স্কুলের প্রধান ছিলেন দেশটির কয়েকজন সাবেক প্রেসিডেন্ট। মাও সেতুং, হু জিনতাও ও জিনপিং তাদের অন্যতম। কাজেই কাই শিয়ার এই দলত্যাগ চীনের নেতার জন্য উদ্বেগজনক।

জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য সম্প্রতি যেসব বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাদের অন্যতম হলেন কাই শিয়া। কাই শিয়া বলেছেন, জিনপিংয়ের শাসনে চীন বিশ্বের শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। তার এই বক্তব্য দলে এবং দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারণ চীনে প্রেসিডেন্ট বিরুদ্ধে সমালোচনার কোনো নজির নেই।

কাই শিয়া চীনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে জানান। তিনি এখন মনখুলে কথা বলতে চান। কারণ এখন তার কোনো ভয় নেই এবং আমেরিকার মত দেশে কথা বলার স্বাধীনতা আছে। তিনি এখন শুধু বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। তিনি জানান কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে কিন্তু কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কেউ কথা বললেই তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃংখলা ভঙের অভিযোগ এনে দুর্নীতি মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে। জিনপিংয়ের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই এখন আর চীনে নেই। তিনি একাই সব সিদ্ধান্ত নেন। ফলে অনেক ভুলভ্রান্তি হয়। কভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব এর একটি।

অভিযোগ রয়েছে, উহানে করোনার প্রাদুর্ভাবের খবর চীন লুকিয়েছিল। ডিসেম্বরে রোগটি দেখা দিলেও তার কয়েক সপ্তাহ পর চীন স্বীকার করে যে রোগটি সংক্রামক। প্রকাশ্যে এটি স্বীকার করার আগেই জিনপিং বিষয়টি জানতেন। এরপর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তা স্বীকার করা হয়নি। এমনকি করোনা যে মাত্রায় চীনে আঘাত হেনেছে সেই তথ্যও দেশটি বিশ্ববাসীকে জানায়নি। নিহতের সংখ্যা অনেক কম দেখিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। কাই শিয়া বলেন, জিনপিং এ রোগ সম্পর্কে জানার পরও তা জনগণকে জানাননি। কাজেই এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না।

কায় শিয়া ২০১৬ সাল থেকেই চীন ছাড়ার পরিকল্পনা করেন। কারণ দলে কথা বলার সুযোগ দিনদিনই সংকুচিত হয়ে পড়ছিল। চীন যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার জন্য জিনপিং দায়ী করেন তিনি। তার অভিযোগ জিনপিংয়ের কেউই বিরোধীতা করতে পারে না। তিনি এখন অসীম ক্ষমতার মালিক।

শি জিনপিং চীনকে বিশ্বের শত্রুতে পরিণত করেছেন বলেন ভিন্নমতাবলম্বীরা দাবি করে থাকেন। দেশের অভ্যন্তরের বড় বড় সমস্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারও প্রেসিডেন্টের ওপর। আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ যে কোনো বিষয়ে তার সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বলার সুযোগ কারো নেই। আর একক সিদ্ধান্তে ভুলভ্রান্তি হওয়াটা অবধারিত।

কাই শিয়া চীনের পরিস্থিতিতে একটা দুষ্টচক্রের সাথে তুলনা করেছেন। তার মতে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তার ফল তো ভাল হয় না। তবে জিনপিংয়ের অধস্তন কেউ এটা নিয়ে কথা বলতে সাহস করে না। ফলে ভুল সিদ্ধান্ত চলতেই থাকে যতক্ষণ না পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই দুষ্টচক্রে দেশের বিপর্যয় ঠেকানোর কোনো পথ নেই।

কমিউনিস্ট পার্টিতে এখন অসন্তোষ ব্যাপকবিস্তৃত, বিশেষ করে তার প্রজন্মের মধ্যম ও উচ্চপদস্থ কমর্কর্তাদের মধ্যে। তাদের অনেকই ২০-৩০ বছর দলে কাটিয়েছেন। তারা বিলক্ষণ বুঝতে পারেন যে কোন পথ সঠিক আর কোটি বিপর্যয়কর।

জিনপিংয়ের নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেই বিপদ অনিবার্য। তার দুই সমালোচক আইনের অধ্যাপক জু জাংগ্রুন এবং বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী রেন জিকিয়াংয়ের বিরুদ্ধে গত মাসে ব্যবস্থা নিয়েছে চীন সরকার। অধ্যাপক জুকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর রেনকে দল থেকে বহিস্কার করে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ফৌজদারি অপরাধের মামলা রুজু করা হয়েছে।

তারা জিনপিংয়ের করোনা পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলেছিলেন। কাই শিয়া বলেন, একজন প্রবীণ অধ্যাপককে এভাবে চরম অসহায় অবস্থায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। চীনের অন্য শিক্ষাবিদদের ভয়ের বার্তা দিতেই তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একটি পত্রিকার সাবেক সম্পাদক ও কমিউনিস্ট স্কুলের শিক্ষক ডেং ইউয়েন বলেন, কাই শিয়ার মত অনেক সংস্কারবাদীই এখন দলীয় কর্মকান্ডে হতাশ। জিনপিংয়ের ভুলকে কেন্দ্র করে তারা সংগঠিত হওয়ার আশা করছেন। সাবেক এই সম্পাদকও এখন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছেন।

২০১৮ সালে জিনপিং তার আজীবন ক্ষমতায় থাকার পথ সুগম করার পরই পশ্চিমা দেশগুলো চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায়। এতে চীনের ভাবমূর্তিরও অনেক ক্ষতি হয়। এ নিয়ে কাই শিয়া বলেন, চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি যেভাবে হচ্ছে তার সঙ্গে তাল রেখে রাজনৈতিক সংস্কার হচ্ছে না।

চীনে ভিন্নমত পোষণ করলেই করুন পরিণতি ভোগ করতে হয়। দেশটির পরিবেশবাদী নেতা লেই ইয়াং ২০১৬ সালে পুলিশের হেফাজতে মারা যান। তবে তার চরিত্রহননের জন্য পুলিশ দাবি করে যে তিনি পতিতার সঙ্গে ছিলেন। অনেকেই বলছেন, তার মৃত্যুর পর সৃষ্ট জন-অসন্তোষ প্রশমনে তার চরিত্রে এ ধরনের কালিমালেপন করা হয়।

জিনপিং তার ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে প্রতিপক্ষকে দুনীতি মামলা জেলে পাঠাচ্ছেন। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরেই দলের ২ লাখ ৬৬ হাজার নেতাকর্মীকে জেলে পাঠান দুর্নীতির অভিযোগে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দলের প্রভাবশালী নেতা।

কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম ন্যাশনাল কংগ্রেসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ছবি : রয়টার্স
কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম ন্যাশনাল কংগ্রেসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ছবি : রয়টার্স

 

জিনপিংয়ের এই দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চীনের জনগণের মাঝে খুব জনপ্রিয়তা পায়। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি অভিযানের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি মূলত সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সরানোর জন্য এই অভিযান ব্যবহার করেছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তা সান ঝেংকাইকে ঘুষ নেয়ার দায়ে ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।

সাবেক পলিটব্যুরোর সদস্য ও দলটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মেগা-সিটি চোংকিং শাখার প্রধান সান ঝেংকাই বিশিষ্ট সাত সদস্যের পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে এই পলিটব্যুরোই দেশ পরিচালনা করে। পলিটব্যুরোর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সানকে জিনপিংয়ের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হতো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জিনপিং যেভাবে নিজের ক্ষমতাকে সংহত করেছেন, তাতে তাকে চ্যালেঞ্জ করে চীনে টিকে থাকা অসম্ভব। তাই অনেকেই তার বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করলেও তার মসনদ আপাতত বহালই থাকছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে