যার কারণে আফগানিস্তান ছাড়তে হচ্ছে আমেরিকাকে

মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর তার স্থানে দায়িত্ব নেন সাবেক সিভিল এভিয়েশেন মন্ত্রী মোল্লা মনসুর। আর মোল্লা মনসুর মোল্লা সদরকে সহায়তা করেন তালেবান আর্মির প্রধান পদ গ্রহণে - এশিয়া টাইমস

  • মেহেদী হাসান
  • ২৫ আগস্ট ২০২০, ১৮:০১

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী গেরিলা আর্মি হলো আফগানিস্তানের তালেবান। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান অভিযানের পর ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয় তালেবান সরকার। আর প্রায় ২০ বছর পর সেই পরাজিত আর বিধ্বস্ত তালেবানদের সাথেই যুক্তরাষ্ট্রের আবার চুক্তি করতে হয়েছে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয়ার জন্য।

২০০১ সালে তালেবনারা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর লড়াই ত্যাগ করেনি। বিডি ভিউজ ইনফোটইেনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি--। কেমন ছিলো তালেবানদের সাংগঠনিক শক্তি আর এর পেছনে বা কারা ছিলো তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

তালেবানদের বিরামহীন লড়াইয়ের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ২০ বছর পর তালেবানরাই আজ আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিজয়ী শক্তি। যদিও তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর পশ্চিমা বিশ্বে শরিয়া আইনের প্রয়োগ, শিক্ষা ও নারীদের অধিকার হরন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু সেই তালবানদের ব্যাপারে নমনীয় নীতি গ্রহন করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের।

২০ বছর ধরে তালেবানদের যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই টিকিয়ে রাখা এবং বিধ্বস্ত তালেবানদের বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার পেছনের কারিগর হলেন মোল্লা ইবরাহীম সদর। বলা হয়ে থাকে মোল্লা ইবরাহীম সদরের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে হচ্ছে। তবে মোল্লা ইবরাহীম সদর আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র এবং বহির্বিশ্বে কোনো পরিচিত নাম নয়। কারণ তিনি দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সম্পূর্ণ আত্মগোপনে থেকে এবং নিজেকে প্রকাশ করতে চাননি।

মোল্লা ইবরাহীম সদর আফগানিস্তানে প্রথম যখন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হন তখন তাকে যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতা বিষয়ে একটি চরম শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল যা কখনো তিনি ভুলেননি। ঘটনটি ছিলো ২০০১ সালের শরৎ কাল। ইবরাহীম সদর ছিলেন তখন মাঝারি পর্যায়ের তালেবান ফিল্ড কমান্ডার। তার দায়িত্ব ছিল কাবুল রক্ষায় যোদ্ধাদের সংগঠিত করা। সদরের ধারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্থলভাগের সেনারা অভিযানে অংশ নেবে। তালেবানদের ওপর কেমিকেল অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে। সে কারনে সদর তার বাহনীকে প্রশিক্ষন মহড়ার সময় মুখে গ্যাস মাস্ক পরাতেন। আকাশ থেকে পরিচালিত অভিযানের বিরুদ্ধে তাদের এ কৌশল আর হাতে থাকা পুরনো অস্ত্র ছিল সম্বল।

সদরের একজন সঙ্গী হাজী সৈয়দ সে সময়কার ঘটনা স্মরণ করে বলেন, আমেরিকার একটি বোমার আঘাতে কাবুলের সব পাহাড় কেপে উঠত। যারা দৌড়ে না পালাত তারা মারা যেত। তাদের মরতে হতো হয় মাথার ওপরে চক্কর দেয়া বি-৫২ বমারের আঘাতে, নয়তো তালেবান বিরোধী মিলিশিয়াদের হাতে। মোল্লা ইবরাহীম সদর তখন বুঝতে পারলেন এখানে থেকে এভাবে যুদ্ধ করা অর্থহীন। সবাইকে অসহায়ভাবে মরতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডমে দ্রুত পতন ঘটল তালেবানদের। মোল্লা সদর তখনো জীবিত এবং তিনি চলে গেলেন দক্ষিনের কান্দাহারে। কান্দাহারে গিয়ে সদর চলে গেলেন আত্মগোপনে। কেবল মাত্র তার বিশ্বস্ত কয়েকজন ছাড়া কেউ জানতা না তার অবস্থান। আত্মগোপনে থেকে ভবিষ্যত যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করেন।

আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র বা বহির্বিশ্বে সদরের নাম তেমন কেউ জানতো না। এর কারন তার গোপনে কাজ করার বৈশিষ্ট্য। সদর হলেন তালিবান আর্মি চিফ। দেশজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর হামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। তার নেতৃত্বে তালেবানরা দীর্ঘ সময় ধরে আত্মঘাতী হামলা, রোডসাইড বম্বিং, গুপ্ত হত্যা এবং শহরাঞ্চলে ভয়াবহ সব হামলা পরিচালনা করা হয়।

২০০১ সাল যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান শুরুর পর থেকে আফগানিস্তানে সাড়ে তিন হাজারের বেশি আমেরিকান সৈন্য এবং প্রায় ১ লাখ বেসামরিক আফগান নাগরিক নিহত হয়েছে। আর এখন যুক্তরাষ্ট্র চ‚ড়ান্তভাবে আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় নেয়া, তালেবানদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য করা এবং তালেবানদের এ সফলতার পেছনের কারিগর হলেন মোল্লা সদর।তার কাছের লোকদের তার সম্পর্কে অভিমত হলো সদর কোনো সুনামের জন্য আকাঙ্খিত নন। পরিচিতি বা সুনামে তার আগ্রহ নেই। একই সাথে তিনি ইসলামী আইনের কঠোর পন্থায় বিশ্বাসী যার মাধ্যমে ১৯৯০ সাল তালেবানরা আফগানিস্তান শাসন করেছে। সদরের কাছের লোকজন সদরকে নিয়ে গর্বিত।

তালেবান আর্মির প্রধান এবং যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী প্রধান বিদ্রোহী নেতায় পরিণত হতে কয়েক দশক লেগেছে সদরের। সদরের জন্ম ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে দক্ষিনের হেলমন্দ প্রদেশের জগহারান গ্রামে। সদরের বেড়ে উঠা জেলাটি ডালিম আর পপি ক্ষেতের জন্য পরিচিত। সদরের জন্ম আলাকোজাই গোত্রে একটি পশতুন পরিবারে। পশতুনরা আফগান সমাজে অনেক সম্মানিত। সদর তার এলাকার সমবয়সীদের কাছে পরিচিত খোদাদাদ হিসেবে। ১৯৭৮ সালে কাবুলে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে কমিউনিস্টরা। পরের বছর সোভিয়েত আর্মি আগ্রাসন চালায় আফগানিস্তানে। এরপর সদরের পরিবার যোগ দেয় সোভিয়েত বিরোধী ইসলামী প্রতিরোধীকারীদের সাথে।

সদর তখন তার বাবার সাথে জমিয়তে ইসলামীতে যোগ দেন। জমিয়তে ইসলামী তখন আফগানিস্তানে অন্যতম বড় একটি মুজাহিদিন দল। সদরের সাথে তখন জমিয়তে যোগ দেয়া একজন সঙ্গী বলেন, আমাদের এ সিদ্ধান্ত তখন সঠিক ছিল।

১৯৯২ সালে আফগান মুজাহিদরা উৎখাত করে কমিউনিস্টদের। এরপর বিজয়ীদের মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। কমিউস্টিদের উৎখাতের পর মোল্লা সদর গৃহযুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তিনি চলে যান পাকিস্তানের পেশওয়ারে। ভর্তি হন মাদরাসায়। মাদরাসায় পড়াকালে তার সহপাঠীরা তার নাম দেয় ‘সদর’। ফার্সিতে সদর মানে প্রেসিডেন্ট। মোল্লা ইবরাহীমের সহজত নেতৃত্বের গুনাবলীর কারনে তারা তাকে এ নাম দেয়।

গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার আর বোরহান উদ্দিন খান রব্বানীর মুজাহেদিনদের গৃহযুদ্ধে রসাতলে যেতে থাকে আফগানিস্তান। এ দুই নেতার গৃহযুদ্ধে উত্থান ঘটে তালেবান বা মাদরাসা ছাত্রদের । হেকমতিয়ার আর রব্বানীর গৃহযুদ্ধে ত্যক্ত বিরক্ত আফগানরা ব্যাপকভাবে তখন স্বাগত জানায় তালেবানদের। দ্রুত জয় পেতে থাকে তালেবান যোদ্ধারা। তালেবান যারা গঠন করে তাদের কয়েকজনকে চিনতেন মোল্লা সদর। তারা সদরকে আমন্ত্রন জানায় তালেবানে যোগ দেয়ার জন্য। সদর তাদের আহবানে যোগ দেন তালেবানে। ১৯৯৪ সালে গঠনের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কান্দাহার এবং হেলমন্দ দখলে নেয় তারা।

সদরের ঘনিষ্ঠরা জানান, তালেবানে থাকা অবস্থায়ও সদর সামনে আসতেন না। তিনি তালেবান নেতৃবৃন্দের ঘনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করতেন। তিনি পদ পদবীর জন্য আগ্রহী ছিলেন না। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা কাবুল দখলে নেয়। এসময় সদর সামনে আসতে বাধ্য হন। তাকে কাবুলের এয়ারপোর্ট ফোর্সের প্রধান করা হয়। সোভিয়েত পরিত্যক্ত যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার গানশিপ এবং পরিবহন বিমান নিয়ে গঠিত তালেবানদের প্যাচওয়ার্ক ফ্লিট দেখাশুনারও দায়িত্ব দেয়া হয় সদরকে।

অন্যান্য তালেবান নেতাদের মত সদরও তখন মার্জিত ধার্মিক পোশাক পরতেন এবং সম্মানজনক জীবন যাপন করতেন। অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনের সময়ও তিনি সালওয়ার কামিজ এবং কালো পাগড়ী পরতেন। তবে তার ক্যারিশমা এবং উচ্চ লক্ষ্য ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। কাবুল এয়ার ফোর্স এবং আশপাশের এলাকার কমান্ডার থাকাকালে ইবরাহীম সদর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। দেশীয় তালেবান বিরোধীদের তিনি গুড়িয়ে দিয়েছেন।

কাবুল এয়ারফোর্সের দায়িত্ব পালনকালে সদর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সংস্পর্শে আসেন যা তার পরবর্তী আত্মগোপন জীবন এবং যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী বিদ্রোহে কাজে লাগে। তালেবানদের ভবিষ্যৎ অনেক নেতাদের সাথে সদরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় কাবুল এয়ারফোর্স কমান্ডার থাকার সময়।

২০০১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে অভিযান চালায় তখন সদরের অবস্থান ছিল কাবুলের ঠিক উত্তরে শোমালী ফ্রন্ট লাইনে। সদর এখানে কিছু আরব যোদ্ধাদের সাথে অভিযান পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু সদর তার অবস্থান ধরে রাখতে পারছিলেন না এবং কাবুলের দক্ষিনের উপশহরের একটি ঘাটিতে সরে যেতে বাধ্য হন। এখানেই সদর তার যোদ্ধাদের গ্যাস মাস্ক বিতরণ করছিল। দীর্ঘ আত্মগোপন জীবনে তার কর্মকান্ড এখনো অজানা।

অনেকের মতে মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর ২০১৪ সালে মোল্লা ইবরাহীম সদর তালেবান আর্মির প্রধান হন। মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর তার স্থানে দায়িত্ব নেন সাবেক সিভিল এভিয়েশেন মন্ত্রী মোল্লা মনসুর। আর মোল্লা মনসুর মোল্লা সদরকে সহায়তা করেন তালেবান আর্মির প্রধান পদ গ্রহণে। ২০১৬ সালের ২১ মে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন মোল্লা মনসুর। তবে ততদিনে মোল্লা সদর পুরো তালেবানের নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেন।

২০২০ সালের শুরুতে মোল্লা ইবরাহীম সদর তালেবানদের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব পান। যে দায়িত্বে আগে ছিলেন মোল্লা ওমরের ছেলে। জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে সদরকে উল্লেখ করা হয়েছে তালিবান মিলিটারি কমিশনের প্রধান হিসেবে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সদর এমনকি ওসামা বিন লাদেনের ছেলে হামজার সাথেও সাক্ষাত করেছেন ২০১৯ সালে তার নিজ জেলা সাঙ্গিনে।

তালেবানদের বিরামহীন লড়াইয়ের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ছবি : মিলিটারি টাইমস
তালেবানদের বিরামহীন লড়াইয়ের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ছবি : মিলিটারি টাইমস

 

এর কয়েক মাস পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষনা দেন তাদের আক্রমনে নিহত হয়েছে লাদেন পুত্র হামজা। তবে ২০০১ সালে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে বেচে যান সদর এবারও তেমনি তিনি রক্ষা পান। আর এবার সদর শুধু রক্ষাই পাননি বরং তিনি এবার বিজয়ী আর যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত ।

আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য চলে যাবে এ শর্তে গত ফেব্রুয়ারিতে তালেবানদের সাথে চুক্তি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। চুক্তি অনুযায়ী শেষ আমেরিকান সৈন্যের আফগানিস্তান ত্যাগ করার কথা ২০২১ সালে। এখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর তালেবানরা বিদ্রোহ বন্ধ করে হয় আফগান সরকারের সাথে শান্তিচুক্তি করবে অথবা তাদের উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করবে। তবে এর কোনটা তারা বেছে নেবে এটা অনেকটা নির্ভর করছে মোল্লা ইবরাহীম সদরের সিদ্ধান্তের ওপর।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে