ইউরোপের সাথে কেমন হবে ট্রাম্পের সম্পর্ক

বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া দূরের কথা তাদের অবস্থান কোনমতে ধরে রাখার আপ্রান লড়াইয়ে করছে - দ্যা পলিটিক্যাল সাইন্সক্লাব

  • মেহেদী হাসান
  • ১৯ জুলাই ২০২০, ২১:৪৬

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর অনেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আরেকবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সমাপ্তি ঘটতে পারে ন্যাটোর। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় বসার পর থেকে সামরিক ব্যয় বাড়াতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছেন। একইভাবে বাণিজ্য নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর তীব্র সমালোচনা করে আসছেন। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর সাথে ট্রাম্পের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর অনেক কর্মকর্তা মনে করেন ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউজে ফিরে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউরোপের টানা ৭০ বছরের সম্পর্কের যবনিকাপাত ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কের অবনতির ফলে ভবিষ্যতে বদলে যেতে পারে কৌশলগত রাজনীতি।

৭০ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের পাশে দাড়িয়ে আছে বড় ধরনের এক সহায়ক শক্তি হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ইউরোপকে উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে বিপুল বাজেটের মার্শাল প্লান। সাবেক বিশ্ব সাম্রাজ্য যুক্তরাজ্যের সাথে ভাষা ও সংস্কৃতিতে মিল থাকায় দুই দেশের সম্পর্ক সব সময়ই ছিল অটুট আর গভীর। তবে ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ এই সম্পর্ক সম্ভবত আর আগের মত থাকছে না। আটলান্টিকের উভয় পারের দেশগুলা এখন তাদের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে তাদের নিরাপদ দেশের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে । ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্লকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিক আমন্ত্রিত নন। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই তালিকায় রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত প্রধান শত্রু চীনের নাম। আর যে চীন থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বিরোধ চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করা হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে সেফ তালিকায় না রাখা কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয় বরং স্বাস্থ্যগত কারনেই এটা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরে অনেক বার ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আক্রমন করে আসছেন। চীন, মেক্সিকো, কানাডা, দক্ষিন কোরিয়া, জাপানের বিরুদ্ধে বানিজ্য নিয়ে বিরোধ আর হুমকি ধামকির পর ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও তোপ দাগানো শুরু করেন।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকনোমকি ফোরামে ট্রাম্প বলেন, তার প্রশাসন ব্রাসেলস এর সাথে বানিজ্য চুক্তির জন্য আগ্রাসী পদক্ষেপ নেবে। ব্রাসেলস তাতে রাজি না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গাডির ওপর ২৫ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করবেন। এ ছাড়া ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা অন্যান্য পন্যের ওপরও উচ্চ ট্যারিফ আরোপের হুমকি দেন ট্রাম্প।

দাভোসে সিএনবিসিকে ট্রাম্প বলেন, আমরা প্রথমে এটি চীন আর মেক্সিকোর সাথে করতে চেয়েছি। এখন আমরা ইউরোপীয় উনিয়নের সাথে এটা করতে চাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্য অনুসারে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২০১৮ সালে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১ দশমকি ৩ লাখ কোটি ডলারের বানিজ্য সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পন্যের সবচেযে বড় বাজার ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশ।

২০১৬ সালে নির্বাচনের জয়লাভের আগে থেকেই ট্রাম্প ইউরোপের সাথে বানিজ্য চুক্তির কথা বলে আসছিলেন। ট্রাম্পের এ ট্যারিফ আরোপের হুমকি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এতে করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ উভয়ের মধ্যে শুধু রাজনৈতিক সম্পর্কই খারাপ হবে না বরং উভয় অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকনোমক্সি এর সিনিয়র ফেলো চাদ বন বলেন, ইউরোপ জাপান নয়। ইউরোপ চীনও নয়। ট্রাম্প যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পন্যের ওপর জবরদস্তি উচ্চ ট্যারিফ আরোপ করেন তাহলে ইউরোপের রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ বদলে যাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বসে থাকবে না। পাল্টা পদক্ষেপ নেবে। কারন তাদের অর্থনীতিও সম্মিলিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমান ।

যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপদ তালিকার বাইরে রাখায় আটলান্টিকের দুই পারেরর সম্পর্ক ফাটলের একটি প্রমান হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওয়াশিংটনের কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গুরুত্ব কমে গেছে এটা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। ফলে ইউরোপের দেশগুলো স্বাধীন ক‚টনীতির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রে জোর দিচ্ছে।

ট্রাম্প হোয়াইট হাইজে প্রবেশের তিন মাসের মাথায় সামরিক ব্যয় নিয়ে ন্যাটে সদস্যদের প্রতি অভিযোগ তুলতে শুরু করেন। ২০২০ সালের ২৫ মে বেলজিয়ামে ন্যাটে হেডকোয়র্টারে যোগ দিয়ে তিনি সেখান থেকে এ অভিযোগ শুরু করেন। আর গত জুন মাসে ট্রাম্প ন্যাটোতে অর্থ দেয়া নিয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, জার্মানি যদি ন্যাটোতে অর্থ দেয়া না বাড়ায় তাহলে জার্মান থেকে তিনি আমেরিকান সৈন্য কমিয়ে আনবেন।

হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা জানেন, ন্যাটোতে অর্থ না দেয়ার ব্যাপারে জার্মানি হলো কুকর্মকারি। বছরের পর বছর ধরে তারা এ কুকর্ম করে আসছে। ন্যাটো তাদের কাছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাবে। তাদেরকে এ অর্থ দিতে হবে। আমরা জার্মানিকে রক্ষা করছি আর তারা এ কুকর্ম করে যাচ্ছে।

জার্মানিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪ হাজার সৈন্য রয়েছে। ট্রাম্প রাখঢাক না করেই বলেন যদি জার্মানি ন্যাটোতে অর্থ দেয়া না বাড়ায় তাহলে এ সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে। জার্মানির বিরুদ্ধে বানিজ্য নিয়েও বিষোদগার করে ট্রাম্প বলেন, তাদের কারনে যুক্তরাষ্ট্রের শত শত বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে বছরের পর বছর।

ন্যাটোর সুপারিশ হলো সদস্য দেশগুলোর জাতীয় আয়ের কমপক্ষে শতকরা ২ ভাগ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবে । কিন্তু জার্মানি তা না করায় ট্রাম্প জার্মানির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করছেন। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালানোর পর ন্যাটো এ সুপারিশ করে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৯ সদস্যের মধ্যে মাত্র ৯টি দেশ এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে।

জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সরানোর হুমকিকে বড় ধরনের ঘটনা হিসেবে দেখছে ন্যাটো। এটি ন্যাটো সংহতির প্রতি বড় আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর ফলে রাশিয়ার হুমকির মুখে পড়েবে জার্মানী।

যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ আর্মড সার্ভিসেস কমিটির দুই ডজনের অধিক রিপাবলিকান সদস্য ট্রাম্পকে জার্মানী থেকে সৈন্য না সরানোর ব্যাপারে লিখিতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন । তারা মনে করেন এতে রাশিয়া আগ্রাসনে উৎসাহিত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে জার্মানিতে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য শুধু জার্মান বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রেরও নিরাপত্তার অংশ।

ট্রাম্প তার সিদ্ধান্তে অনঢ় রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। জার্মানীর চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেলকে না জানিয়ে সাড়ে ৯ হাজার সৈন্য সরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প জার্মানিকে বানিজ্য প্রতিদ্বদ্বী মনে করেন। সুতরাং দ্বিতীয়বার তার হোয়াইট হাউজে আসা মানে জার্মানির সাথে তার উত্তেজনা বাড়বে।

অপর দিকে ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে প্রবেশের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে তা ভালো ভাবেই অনুধাবন করছে ন্যাটো। ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে মাল্টায় ন্যাটোর এক জরুরি বৈঠকে বসে। ইইউ কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট টাস্ক নেতৃবৃন্দকে এক চিঠিতে লেখেন- ওয়াশিংটনে পরিবর্তন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। নতুন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ বছরের পররষ্ট্রনীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।

ন্যাটোর শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করেন আরেক বার ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে প্রবেশের ফলে ন্যাটোর সমাপ্তি ডেকে আনতে পারে। আরেক বার ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে খুবই খারাপ খবর ন্যাটোর জন্য। অপর দিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে চীনের সম্পর্ক বৃদ্ধিও ভাল চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাকর্ড , ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি, চীনের ৫জি ও হুয়াওয়েসহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে ।

ব্রাসেলস মনে করে চীনসহ অন্যান্যদের সাথে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব গড়ার মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারে। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র নি:সঙ্গ আর একঘরে একটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমনটি আর ঘটেনি আগে। বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতিতে সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকার দরকার ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন তার মিত্রদের কাছে অনির্ভরযোগ্য এক বন্ধু।

বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া দূরের কথা তাদের অবস্থান কোনমতে ধরে রাখার আপ্রান লড়াইয়ে করছে। যুক্তরাষ্ট্র বড় রকমের নেতৃত্ব সঙ্কটে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে এমন একজন প্রেসিডেন্ট রয়েছেন যাকে নিয়ে দেশটির অনেক মানুষ নিজেদের বিব্রত মনে করেন। ট্রাম্পের অধীনে সাড়ে তিন বছরে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজের ব্যাপক ধ্বস নেমেছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে