ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব

চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনেশিয়েটিভের একটি চেহারা - ওয়ানবেল্ট ওয়ান রোড ডটনিউজ

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৫ জুলাই ২০২০, ১৩:৫২

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে, স্বপ্ন দেখিয়ে। বলা হয়েছিল, এর লক্ষ্য হলো বিশ্বশান্তি ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা এবং চীন ও প্রকল্পভূক্ত সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এতে সংশ্লিষ্ট সব দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের পারস্পরিক বিরোধ মীমাংসারও অঙ্গীকার করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে একটা উইন-উইন পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলা হয়, যেখানে কেউ হারবে না, সবাই হবে জয়ী। তবে বাস্তবতা হলো, মুখে বলা বা কাগজে-কলমে লেখা যত সহজ, লক্ষ্যে পৌঁছানো কখনওই অত সহজ হয় না। বিআরআই প্রকল্পের বেলায়ও হয়নি, হচ্ছে না। চীনের এই বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প নিয়ে কী ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে তার কিছু দিক আমরা তুলে ধরবো।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা সেই চিরকালীন বাস্তবতাকেই নতুন করে তুলে ধরছে আমাদের সামনে। শুধু তা-ই নয়, এ বাস্তবতায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে বিআরআই প্রকল্পের ভবিষ্যতও। এজন্য আমাদের দেখতে হবে , পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ নিয়ে সৃষ্ট সা¤প্রতিক উত্তেজনার চেহারাটি কেমন। মনে রাখতে হবে এ বিরোধটি শুধু আঞ্চলিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, এর প্রভাব বৈশ্বিক রাজনীতি পর্যন্ত প্রলম্বিত।

বিরোধটির আঞ্চলিক চেহারা দেখা যায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাসের বিবৃতিতে। তারা যৌথভাবে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের কথা বলেছেন। অপরদিকে মিশর জেদ ধরেছে এতে দক্ষিণ সাইপ্রাসকেও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। তুরস্ক আবার এতে রাজি নয়। এর মধ্য দিয়েই পরিষ্কার হয়ে যায়, ইস্যুটির প্রভাব কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি এবং তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের মার্কিন হুমকি এ ইস্যুকে দিয়েছে ব্যাপকতা। তার ওপর রয়েছে সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য এবং সে-দেশে রুশ সৈন্যদের উপস্থিতি। এসব সামরিক কর্মকান্ড পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার রাজনৈতিক পরিবেশকে করে তুলেছে জটিল।

এমন পরিস্থিতিতে চীনের পররাষ্ট্র নীতি সাম্প্রতিক বিশ্বব্যবস্থাকে উল্টে দেয়ার এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যেকার পুরনো বন্ধুত্বকে জটিল করে তোলার হুমকি সৃষ্টি করেছে বলেই অনেকে মনে করেন। সেটা কীভাবে - খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই, চীনের সা¤প্রতিক যে উত্থান, তার সূচনা হয়েছে মূলত তেং শিয়াও পিং-এর ওপেন ডোর পলিসি বা মুক্ত দ্বার নীতির হাত ধরে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে দেশটির সক্ষমতা উপনীত হয় বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব রাখার স্তরে। তৃতীয় ও শেষ পর্যায়ে, বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্প গ্রহণের পর বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ যাবত কালের সবচাইতে জটিল ভারসাম্য বিধানের ক্ষেত্রে চীনের সক্ষমতার প্রশ্নটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে।

প্রশ্ন হলো, বৈশ্বিক রাজনৈতিক অঙ্গনকে কতোটা প্রভাবিত করতে পারবে চীন? লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে চীনকে বারংবার চিহ্নিত করা হচ্ছে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি প্রধান হুমকিরূপে। তার ওপর চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধকালে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, যদি চীন তার অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে সুসংহত করতে চায় তাহলে তাকে তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বাড়াতে হবে। এ অর্থে বিআরআই প্রকল্প স¤প্রসারণকে চীনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ক্ষমতা সুসংহত করার পদক্ষেপ বলে মনে করা যেতে পারে।

চীন যে তার আশপাশের দেশগুলোর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রভাব বিস্তারের কাজে বিআরআই প্রকল্পকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং তাইওয়ান প্রশ্নে দু' দেশের বিরোধ তীব্র হলে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট হয় চীন। এসব দেশ দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলে অবস্থিত। এ ছাড়া বিআরআই-কে চীন তার কূটনীতির অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করেছে, যাকে বলা হয় ''ঋণ কূটনীতি''। অর্থনৈতিক দুর্দশাগ্রস্ত 'বন্ধু' দেশগুলোকে বিপুল অর্থ ঋণ দিয়ে একরকম কব্জা করে ফেলেছে চীন।

প্রাচীন সিল্ক রোড-হিস্ট্রি ডটকম
প্রাচীন সিল্ক রোড-হিস্ট্রি ডটকম

 

দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশেও চীন অর্থনৈতিক কূটনীতি সফলভাবে কাজ করেছে। এছাড়া মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে নির্মান করেছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এর ফলে চীনের বিআরআই প্রকল্পের বিরোধী ও চীনকো মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসাবে পরিচিত ভারত অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি লাদাখে দুদেশের সৈন্যদের মধ্যে সীমান্ত সংঘাতের পর এই দিকটি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দক্ষিন এশিয়ার ছোট দেশগুলো ভারতের পাশে না দাড়িয়ে নীরব রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে এসব দেশের ওপর চীনের প্রভাব আরো বাড়ছে।

এবার দেখা যাক পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা এবং বিআরআই প্রকল্পের সম্পর্কটা কী? এখানে চীনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রয়েছে। কেননা এ অঞ্চলে চীনের আছে একাধিক সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। কিভাবে চীন এই বন্দরগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রন করছে আসুন জেনে নেই

এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ন বন্দর হচ্ছে পোর্ট পিরাউস। ইউরোপের সাথে চীনের বাণিজ্যের একটা বড় অংশ হয়ে থাকে এ বন্দর দিয়ে। এ বন্দরের সাথে মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের সড়ক, মহাসড়ক ও রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠায় চীন তাই বিনিয়োগ করেছে বিপুল অর্থ।

এ ছাড়াও তুরস্কের ইজমীর বন্দর নিয়ে দেশটির সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে চীন। আর বিআরআই প্রকল্প বাস্তবায়নে তুরস্কের রয়েছে বিরাট কৌশলগত গুরুত্ব। মিশরের সুয়েজ খাল এশিয়া-ইউরোপ বাণিজ্যের একটি বড় সেতুবন্ধন। তাই মিশরের সাথে সম্পর্কও চীনের কাছে বিশেষ গুরুত্ববহ। পাশাপাশি ইসরাইলের আশদদ বন্দরটিও ৪৯ বছর পর্যন্ত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে চীন।

মজার ব্যাপার হলো, এসব বন্দরের সবগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। তারা সবাই পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য থেকে আরও বেশি সুবিধা পেতে চায়। কিন্তু এ এলাকা দিয়ে চীনের বাণিজ্য এবং এখানে চীনের বিনিয়োগের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি।

এমন অবস্থায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার গ্যাস আহরণ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ চীনের 'গোয়িং গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজি'র প্রথম পর্যায় তৈরি করেছে। দেখে মনে হচ্ছে, চীন এ অঞ্চলের রাজনীতিতে আরও নিরপেক্ষ থাকাই ভালো মনে করছে। মনে হচ্ছে, দেশটি ঐতিহাসিক 'ওয়েট অ্যান্ড সি' অর্থাৎ 'অপেক্ষা করা ও দেখা'র কৌশল নিয়েছে।

অন্যদিকে নিজ স্বার্থ হানি না-হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের বর্তমান সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রাখার এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার কৌশল নিয়েছে চীন। এর অংশ হিসেবে তারা মিশরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কেননা, ইউরোপের সাথে বাণিজ্যে মিশরের সুয়েজ খাল চীনের খুবই দরকার। এছাড়াও চীন যদি মিশর, তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যেকার বিরোধ নিরসনে সহায়তা না-করে, তাহলে পরিণামে বিআরআই প্রকল্পের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।

সম মিলিয়ে বলতে হয়, বিআরআই-র বাণিজ্য স্বার্থ নিশ্চিত করার স্বার্থে কেবল পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকাই চীনের জন্য যথেষ্ট হবে না, তাকে এসব দেশের মধ্যে সম্ভাব্য যে-কোনো সংঘাত ঠেকানোর লক্ষ্যেও কাজ করে যেতে হবে। দেশটির জন্য এখন দরকার হবে তার কূটনীতিতে এমন লক্ষ্য অর্জনের পদক্ষেপ গ্রহন করা।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে