দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংকে রুখে দিচ্ছে দুই দেশ

দক্ষিণ চীন সাগরে নজর রাখছেন এক চীনা নৌসেনা - টুইটার

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৪ জুন ২০২০, ২০:০৪

আন্তর্জাতিক আদালতের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরের পুরোটাজুড়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া চীন সরকার। তবে বেইজিংকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। এতে জাকার্তা ও কুয়ালালামপুরের পাশে দাঁড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

সিএনএনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দক্ষিণ চীণ সাগর নিয়ে ভূরাজনীতির নানা দিক তুলে ধরা হলো-

চলতি বছরের শুরুতে চীন ও মালয়েশিয়ার জাহাজ এক মাসের বেশি সময় ধরে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। দক্ষিণ চীন সাগরের বর্নিও দ্বীপে এ ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়।

মালয়েশিয়ার অনুমোদিত যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী জাহাজ ওয়েস্ট কাপেলা ওই স্থানে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানে নিয়োজিত ছিল। তবে বেইজিংও এ জায়গার মালিকানা দাবি করে থাকে। এ সময় চীনের একটি জরিপকারী জাহাজ তাদের কোস্ট গার্ডের জাহাজের সহায়তায় ওই এলাকায় প্রবেশ করে। তারা সেখানে নজরদারি শুরু করে। এশিয়া মেরিটাইম ট্রান্সপারেন্সি ইন্সটিটিউট অথবা এএমটিআইর স্যালেটাইল চিত্রে এ দৃশ্য ধরা পড়েছে।

এ অবস্থায় মালয়েশিয়া সেখানে নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েন করে। পরে সেখানে উপস্থিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী। সেটি তখন যৌথ মহড়ায় অংশ নিতে দক্ষিণ চীন সাগরেই ছিল।

বেইজিংয়ের দাবি, তারা সেখানে তাদের সীমানায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাচ্ছিল। তবে বহু বছর ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিযোগ, তারা দক্ষিণ চীন সাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে গেলেই চীনা জাহাজের বাধার মুখে পড়ে। চীন এসব এলাকাকেও নিজেদের বলে দাবি করে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন দক্ষিণ চীন সাগরে জবরদস্তির নীতি অনুসরণ করে থাকে। এতে আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মত দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে সংঘাতের আশংকা দেখা দিচ্ছে বলে মনে করে এএমটিআইর পরিচালক গ্রেগ পোলিং।

তিনি বলেন, এসব দেশের গুরুত্ব আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। তাই সেখানে চীনা জাহাজের তৎপরতাও বেড়েছে। বেইজিং দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জসহ আধুনিক স্থাপনা তৈরি করছে। এসব দ্বীপের কারণে চীন সুবিধাজনক অবস্থানে পৌছেছে। তবে এতে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াও মুখোমুখি অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো দিন স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জে চীনা কোস্টগার্ডের ডজন খানেক জাহাজ আর মাছ ধরার শত শত নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দক্ষিণ চীন সাগর বিশ্বের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ অঞ্চল। চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, তাইওয়ান ও ইন্দোনেশিয়া এর মালিকানা নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। বছরে ৫ লাখ কোটি ডলারের পণ্য পরিবাহিত হয় এই সাগর দিয়ে।

চীন এই সাগরের মালিকানার দাবি করে থাকে। চীনা মানচিত্রে একে নাইন ড্যাশ লাইন নামে দেখানো হয়। এতে প্রায় পুরো সাগরটাই চীনের বলে দাবি করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে চীনের এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই। ২০১৬ সালে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত চীনের এই মালিকানার দাবি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। তবে অন্যান্য দেশের দাবি নাকচ করে দিয়ে চীন ২০১৫ সাল থেকে এই সাগরে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ ও প্রবালপ্রাচীরসহ নানা স্থাপনা তৈরি করে আসছে।

দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিং বিমান অবতরণের সুবিধা, পোতাশ্রয় ও রাডার বসিয়ে সামরিকীকরণ করেছে। এর মাধ্যমে এই সাগরে বেইজিং তাদের মালিকানার দাবি জোর করে হলেও প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

এএমটিআইর গ্রেগ পোলিং বলেন, এই দ্বীপপুঞ্জে চীনের নজরদারি ক্ষমতা রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে যাই কিছু ঘটুক না কেন চীন তা দেখতে পায়। আগে চীন এমন সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল না। অন্য কোনো দেশের জাহাজ সেখানে অনুসন্ধান কাজে নিয়োজিত থাকলে তা জানতে পারত না। এখন তারা নিশ্চিতভাবেই তা জানতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন কোস্ট গার্ড ও মাছ ধরার নৌকার একটি বহর তৈরি করেছে শুধু দক্ষিণ চীন সাগরে মোতায়েনের জন্য। এগুলোর কাজ অন্য দেশের জাহাজকে হয়রানি ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এলাকায় ঘোরাঘুরি করা।

এমন নয় যে চীন এই সাগরে চলতি বছর শুধু মালয়েশিয়ার অনুসন্ধানকারী জাহাজেরই মুখোমুখি হয়েছে।

দক্ষিণ চীন সাগরে বছরের শুরুতেই ইন্দোনেয়িশার মুখোমুখি হয়েছিল চীনা জাহাজ। দক্ষিণ চীন সাগরের এক প্রান্তে অবস্থিত নতুনা দ্বীপপুঞ্জের মালিকানাও দাবি করেছে চীন। ইন্দোনেশিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার মধ্যেও চীনা মাছ ধরার জাহাজ ঢুকে পড়ে। এতো দুই দেশই মুখোমুখি অবস্থান নেয়। অবশেষে জাকার্তা সেখানে এফ-সিক্সটন জঙ্গিবিমান ও নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েন করে। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো নিজেই এলাকায় চলে যান। এর মাধ্যমে জাকার্তা চীনকে নজিরবিহীন শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে।

দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়মিত টহল দেয় মার্কিন যুদ্ধজাহাজ- গেটি ইমেজ
দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়মিত টহল দেয় মার্কিন যুদ্ধজাহাজ- গেটি ইমেজ

 

গত এপ্রিলে চীনের নজরদারি জাহাজ চীন সাগরের বিতর্কিত প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের কাছে ভিয়েতনামের একটি মাছ ধরার বোটকে ধাক্কা মেরে ডুবিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ভিয়েতনাম জাতিসংঘে ক‚টনৈতিক নালিশ দেয়। তারা দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার সার্বভৌমত্ব লংঘনের অভিযোগ দেয়। তখন বেইজিং কড়া ভাষায় জবাব দেয় যে এ অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য চীন প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে। ভিয়েতনামের দাবিকে অবৈধ বলেও মন্তব্য করে বেইজিং।

দীর্ঘদিন ধরেই চীন দক্ষিণ চীন সাগরে প্রতিবেশী দেশগুলোর জাহাজকে হয়রানি করে আসছে। বিশেষ করে ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের জাহাহ প্রায়শই এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার জাহাজ মাঝেমাঝেই চীনা জাহাজের রোষানলে পড়ে। আগে অবশ্য চীনা কূটনীতিকরা ক্ষুব্ধ দেশগুলোর ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করতেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংকটের পর চীনের আগ্রাসী বা নেকড়ে ক‚টনীতির উত্থানের ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের এই ভারসাম্য ভেঙে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন এখন শক্তির কূটনীতির পথ ধরেছে। তাদের বিবৃতিগুলো এখন আক্রমণাত্মক। তারা বলছেন, এ অঞ্চলে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান জবরদস্তিমূলক নীতির মুলে রয়েছে করোনাভাইরাস মহামারি। এর ফলে চীনের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চীনের সুনাম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু বছরের মধ্যে চীনে এবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো করোনাভাইরাস সংকটের শুরুতে চীনের লুকোচুরির নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।এ নিয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে তাদের উত্তেজনা বাড়ছে।

এসব কারণে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণও শিথিল হয়ে পড়েছে। ফলে তারা এখন জাতীয়তাবাদী সুর চড়াতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এর অন্যতম বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র ফেলো ইয়ান স্টোরি বলেন, বেইজিং এখন এই প্রচারণা চালাচ্ছে যে বিশ^মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। এই সুযোগে এই অঞ্চলে চীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা চীন সাগরের মালিাকানা দাবিকারী দেশগুলোকে বোঝাতে চাইছে যে আমেরিকার সামরিক ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে তারা তোমদের কোনো সাহায্যে আসবে না।

এতে বোঝা যাচ্ছে চীন অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে তাদের নীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না।
এখন পর্যন্ত অবশ্য মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া চীনের সঙ্গে সর্ম্পব বজায় রাখার ক্ষেত্রে দক্ষিণ চীন সাগরকে একমাত্র ইস্যু বানাতে আগ্রহ দেখায়নি। তবে চীন যেভাবে এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাতে তাদের এই নীরব ক‚টনীতি বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। চীনের আগ্রাসন কোন পর্যায়ে পৌছলে তারা নীরব থাকবে সেটাও তো একটা প্রশ্ন।

নিজেদের দোরগোড়ায় চীনের বাহুবল দেখে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বেইজিংয়ের উপস্থিতি ঠেকাতে জোট বাধতে পারে। তবে ইয়ান স্টোরির মতে, এক্ষেত্রে সমস্যা হলো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো করোনাভাইরাস সংকট ও নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে বেকায়দায় আছে। ফলে এখনই আসিয়ানের দেশগুলো চীনের বিরুদ্ধে একজোট হবে বলে মনে হচ্ছে না। এই সুযোগ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্ববাদী আচরণের আপাতত পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তিনি।

এএমটিআইর গ্রেগ পোলিং বলেন, মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। তাই ইতোপূর্বে চীনা জাহাজের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানের খবর যতটা সম্ভব গণমাধ্যমের আড়ালে রেখেছে কুয়ালালামপুর।

তবে ইন্দোনেশিয়া চীনা জাহাজে গুলি চালিয়ে তাদের সমুদ্র সীমা ছাড়তে বাধ্য করেছে। গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট উইদোদোর নতুনা দ্বীপপুঞ্জে আকস্মিক সফর এই বার্তাই দিচ্ছে যে তারা মুখ বুঝে চীনের আগ্রাসী আচরণ মেনে নেবে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনও সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়।

ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিউটের সিনিয়র ফেলো ফেলিক্স চ্যাং গত জানুয়ারিতে এক নিবন্ধে লিখেছেন, বেইজিং মনে করছে যে ইন্দোনেশিয়ার এই বিরোধীতা তারা দমন করতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার মত জাকার্তাও চীনের সঙ্গে আপোষরফায় আসবে।

তবে চীনের জন্য বিষয়টি এতো সহজ নাও হতে পারে। দক্ষিণ চীন সাগরে চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কঠোর অবস্থান নিয়েছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের মহড়া গত বছরের চেয়ে দ্বীগুণেরও বেশি বেড়েছে।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তাও বেড়েছে। গত মাসেই মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীকে প্রথম ব্যাচের নজরদারি ড্রোন সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নেতারা বলছেন, দক্ষিণ চীন সাগর চীন যত কঠোর অবস্থান নেবে যুক্তরাষ্ট্রও ততই শক্ত হবে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে