ঘরে বাইরে নিঃসঙ্গ ট্রাম্প

এতোটা নিঃসঙ্গ আর উপেক্ষিত তিনি এর আগে কখনোই ছিলেন না - রেক্স, শাটারস্টক

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১০ জুন ২০২০, ২০:৫৮

একলা চলো নীতির কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ট্রাম্পের আমন্ত্রণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। অন্যদিকে নিরপরাধ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার পর নজিরবিহীন বিক্ষোভের জেরে নিজ দল ও প্রশাসনের সমর্থনও পাচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

আমেরিকার শহরগুলো একদিকে জ্বলছে এবং করোনাভাইরাস থামার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ মহামারিতে অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি লোক মারা গেছে। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশের বাইরে ক্রমবর্ধমান সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এতোটা নিঃসঙ্গ আর উপেক্ষিত তিনি এর আগে কখনোই ছিলেন না। এখন তাকে বিদ্রুপও করা হয়। দেশটির ঐতিহ্যবাহী মিত্র ইউরোপ ট্রাম্পের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছে। এসব দেশ আর বিশ্বাস করছে না যে এই প্রেসিডেন্ট তাদের জন্য তেমন কিছু করবেন।

সম্প্রতি এটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল জি সেভেনের বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ ট্রাম্প খুব করে চাচ্ছিলেন যে চলতি মাসেই ওয়াশিংটনে এই জোটের শীর্ষ সম্মেলন হোক। এর মাধ্যমে তিনি দেখাতে চাইছিলেন যে করোনাভাইরাস তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং বিশ্ব আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে।

মেরকেলের এই সিদ্ধান্তের পরই জার্মানী থেকে সাড়ে ৯ হাজার যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলার জন্য জার্মানী সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ন্যাটোর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা অবস্থান করছে। জার্মানীতে ৩৪ হাজারের মতো সৈন্য রয়েছে। ট্রাম্প এ নির্দেশের মাধ্যমে মেরকেলকে একটি বার্তা দিতে চাইছেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে ইউরোপের দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পক আরো খারাপ দিকে যেতে পারে।

সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার জন্য করোনাভাইরাসের ক্রমবর্ধমান হুমকিকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন মেরকেল। তবে একজন ঊর্ধতন জার্মান কর্মকর্তা স্পষ্ট করেই বলেছেন, মেরকেল মনে করেনে শীর্ষ সম্মেলনের জন্য যথাযথ ক‚টনৈতিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। মেরকেল চীনবিরোধী মহড়ারও অংশ হতে চান না। এছাড়া সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আমন্ত্রণ জানানোর বিরোধিতা করেছেন মেরকেল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে যাওয়ার ট্রাম্পের একতরফা সিদ্ধান্তেও মেরকেল হতাশ হয়েছেন। ট্রাম্প এই শীর্ষ সম্মেলন করে দেশে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করুন, তাও চান না তিনি।

ট্রাম্প ও ইউরোপীয় মিত্রদের ক্রমবর্ধমান এই বিরোধ হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। আমেরিকায় শুরু হওয়া বিক্ষোভের বেশ আগেই এটার সূত্রপাত হয়। তবে আমেরিকার রাস্তায় এই দাঙ্গা দেখে বিদেশিরা ভাবছেন ট্রাম্পও এই অরাজকতায় জড়িয়ে পড়েছেন।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প। ছবি : হোয়াইট হাউস
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প। ছবি : হোয়াইট হাউস

 

ট্রাম্প তার নিজ জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীকে নামানোর হুমকি দেওয়ার পর আমেরিকার ঘনিষ্ঠতম মিত্ররা তার কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করছেন । তারা বুঝতে পারছেন না ট্রাম্পের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। তারা তৃতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের নির্বাচনের সঙ্গী হতে চাচ্ছেন না।

নেদারল্যান্ডের সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য মারিৎজি স্টেক বলেন, মিত্রদেশগুলোর নেতারা ভাবছেন ট্রাম্পের সমালোচনা করা তাদের জন্য এখন সুবিধাজনক। কারণ আমেরিকার বিক্ষোভের সমর্থনে ইউরোপের অনেক শহরেই সমাবেশ হচ্ছে।

এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশনীতি প্রধান জোসেফ বরেল ফন্টেলেস এতোটাই সাহসী হয়ে উঠেছেন যে তিনি বলেই ফেলেছেন জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনায় ইউরোপ বিচলিত ও বিমর্ষ। তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগেরও নিন্দা জানান। আমেরিকাকে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আহ্বান জানান জোসেফ।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যখন এভাবে নিসঙ্গ হয়ে পড়ছেন তখন ট্রাম্পকে ফোন করেছিলেন রুশ নেতা পুতিন। দুই নেতা করোনাভাইরাস, বাণিজ্য ও জি সেভেন বৈঠক আয়োজনের অগ্রগতি নিয়ে কথা বলেন। তবে ওই বৈঠক ইতিমধ্যেই স্থগিত করা হয়েছে। ট্রাম্প ওই সম্মেলনে পুতিনকে আমন্ত্রণ জানান। বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও পুতিনের তাতে অংশগ্রহনের সম্ভাবনা কম। শুধু অতিথি হিসেবে তিনি বৈঠকে যোগ দেবেন বলে মনে হয় না। ক্রিমিয়া দখল ও পূর্ব ইউক্রেনে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়ার কারণে রাশিয়াকে এই এলিট ক্লাব থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।

ওয়াশিংটনে জার্মান মার্শাল ফান্ডের গবেষক জুলিয়ান স্মিথ বলেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের কাছ থেকে কতটা দূরে সরে গেছেন। এই লোকটি দেশে এবং বিদেশে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। এখন তিনি অন্যত্র বন্ধু খুঁজছেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে পুরনো মিত্রদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও পুতিনের মত একনায়কদের তিনি প্রশংসা করলেও তাদের সঙ্গেও তার সম্পর্কে তিক্ততা দেখা যাচ্ছে।

ট্রাম্প মনে করেন যে মিত্রদের অপমান করেও তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া যায়। তারা তার পাশেই থাকবেন। তিনি বুঝতে চান না যে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী হলেও সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে নয়। ওয়াশিংটন সফরে মেরকেলের অস্বীকৃতি অনেক বার্তা দিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে যে বিশ্বের অনেক নেতা ট্রাম্পের ওপর বিরক্ত। তারা দেখতে পাচ্ছেন যে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে তারা যে বিনিয়োগ করছেন তার তুলনায় প্রতিদান পাচ্ছেন না। করোনাভাইরাস ও দাঙ্গার কারণে আমেরিকার দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে রাজার পরনে পোশাক নেই।

জি সেভেনের শীর্ষ সম্মেলনে কয়েক দিন আগেও এক ধরনের সম্মতি দিয়েছিল ইউরোপের মিত্ররা। এর পরপরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে হঠাৎ ট্রাম্প সরে যান। তিনি এ সংস্থা থেকে সরে যাওয়ার জন্য নিজে যে সময়সীমা বেধে দিয়েছিলেন তার দুই সপ্তাহের বেশি আগেই এ সিদ্ধান্ত নিলেন।

এর আগে ইরান পরমাণু চুক্তি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, মুক্ত আকাশ চুক্তি বা ওপেন স্কাইস ট্রিটি অথবা ইউরোপ থেকে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাও একতরফাভাবেই নিয়েছেন ট্রাম্প। মিত্রদের সঙ্গে তিনি আদৌ কোনো সলাপরামর্শ করেননি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ট্রাম্পের সরে যাওয়ার ঘোষণায় বিস্মিত হন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা। এর পরপরই মেরকেল জানান যে তিনি ওয়াশিংটনে জি সেভেন শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন না। এরপর জি সেভেনে রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধাান্তের বিরোধিতায় যুক্ত হন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের গবেষক টমাস রাইট বলেন, হংকংয়ে চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান জানান দিতে এর আগে জি সেভেন শীর্ষ সম্মেলনে একমত হয়েছিলেন জোটের দেশগুলো। তবে ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ত্যাগ করার পর মেরকেল সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্পকে সমর্থন না দেয়ার। মিত্ররা দেখছেন ট্রাম্প সব জায়গায় নাক গলাচ্ছেন এবং এ কারণে তারা তাকে এড়িয়ে চলছেন।

জার্মান বিশ্লেষক উলরিচ স্টিক বলেন, মেরকেলে এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গেই কাজ করতে চান। মেরকেল মনেপ্রাণেই একজন বহুপাক্ষিক। ট্রাম্পের অনেক কাজে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। চীন নিয়ে ট্রাম্পের নীতির সঙ্গেও তিনি একমত নন। মেরকেল চান চীনের সঙ্গে ইউরোপের ঘনিষ্ঠতা। আগামী মাসে জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্ব নেবে। মেরকেল চান ইউরোপে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে চুক্তি। কয়েক মাস পরই ইইউ-চীন শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে।

জি সেভেন এখন নখদন্তহীন। ট্রাম্পের কারণে সংস্থাটির এই দশা। তিনি বহুপাক্ষিক আলোচনায় আগ্রহী নন, একতরফা সিদ্ধান্তে বিশ্বাসী। এবারের শীর্ষ সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল তার দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ফায়দা লোটা।

আবার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো তার দেশের দীর্ঘ দিনের নীতি অনুসারে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চান। তিনিও ট্রাম্পের ওপর ক্ষুব্ধ। তিনি মনে করেন ট্রাম্প করোনা সংকটে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টো প্রতিদিন বিস্ফোরক কথাবার্তা বলে ট্রাম্প মিত্রদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছেন যার সুযোগ নিচ্ছে চীন।

চার বছরের শাসনে ট্রাম্পের কোনো কূটনৈতিক সাফল্য নেই। উত্তর কোরিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সবক্ষেত্রেই ট্রাম্প ব্যর্থ। ম্যাক্রো মনে করেন ইরানের সঙ্গে বহুপাক্ষিক চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করে এবং রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি নিয়ে ট্রাম্প ইউরোপের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলেছেন। মেরকেল ও ম্যাক্রো দুজনই বহুপাক্ষিকতার অনুসারি।

মেরকেল অনেক থেকেই যুক্তরাষ্ট সফর এড়িয়ে চলছেন। তিনি মনে করেন ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করলে মার্কিন নেতা তাকে তার স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করবেন। মেরকেল সেই সুযোগ দিতে চান না।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে